রিজোয়ান মাহমুদ-এর ‘হাইকু-চাদেঁর ফ্রক’

কাব্য-আলোচনা

| রবিবার , ২০ জুন, ২০২১ at ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ

জাপান মানবসভ্যতায় সংযোজন করেছে বহুবিধ সম্ভার-যা তাদের সংস্কৃতি, জীবনাচার ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতার ফসল। সুসভ্য এই জাতির হাজার হাজার বছরের স্বকীয় ও সমৃদ্ধ শিল্প-সংস্কৃতির পরিচিতি-স্মারক বা ট্যাগ হয়ে আছে কবিতার বিশেষ ফর্ম ‘হাইকু’ এবং নাট্যচর্চা নো-থিয়েটার ও কাবুকি থিয়েটার। আবিশ্ব যুগে যুগে আপ্লুত ও অভিভূত হয়েছে কাবুকির মুখোশনৃত্যের অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও পরিশীলিত রুচির সংস্কৃতিচর্চায়। কেবল প্রাচ্য নয়। পাশ্চাত্যও জাপানের এই মৌলিক নাট্যশৈলী-চর্চা আত্মীকরণ করে আসছে এবং আগামীতেও অবশ্যই অব্যাহত থাকবে।
এবারের একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে শক্তিমান কবি রিজোয়ান মাহমুদ রচিত হাইকু সংকলন-হাইকু চাঁদের ফ্রক। আশ্চর্যজনকভাবে সাফল্যের চুড়ো স্পর্শ করেছেন রিজোয়ান। যেখানে রবীন্দ্রনাথ হাইকু রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, সেই বাস্তবতায় পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের পৃথক রচনার চেষ্টার মধ্যে দুঃসাহসের দুরূই অভিযাত্রা প্রকটিত।
হাইকু চাঁদের ফ্রক গ্রন্থের নান্দীপাঠে কবি ও প্রাবন্ধিক মনিরুল মনির যা লিপিবদ্ধ করেছেন এ পুরোটাই উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি হাইকুর শিল্পকৌশল, রচনারীতি, জ্যামিতিক বিন্যাস চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
মনিরুল মনির লিখেছেন, ‘রিজোয়ান মাহমুদ দীর্ঘদিনের নিরন্তরচর্চা ও আবিরাম স্বপ্নবিদ্য অভিজ্ঞতায় হাইকু তেপায়া ছুঁয়ে যাওয়া এক মানবিক অন্তরাত্মা। মূল হাইকুর মোরাস ধ্বনি এবং নির্মাণশৈলী অক্ষুণ্ন রেখে নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে সাম্প্রতিকতম এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত বাহু হাইকু পদ।
অত্র গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ১১২টি হাইকু। হাইকু’র লাইন বিন্যাস স্বতন্ত্র। মাত্র ৩ লাইন। বাংলা কবিতায় (ইংরেজি কবিতায়ও) ত্রিপদী নামে একটি দস্তুর রয়েছে। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ট্রিওলেট। কিন্তু ত্রিপদী ট্রিওলেট-এর লাইন-এর পরিসর অনেক দীর্ঘ।
হাইকুর চারিত্রেই রয়েছে একটা আলো আঁধারি-অস্পষ্টতা, এক ছায়াচ্ছন্ন আবহ। আমাদের চর্যাপদের সান্ধ্যাভাষা’র প্রতিরূপ বুঝি বা। দৃষ্টান্ত দেওয়া থাক। যেমন ৬২ শীর্ষক হাইকু-
চন্দ্রাবতী লো/ সীসাবোড়া দেহে কী/ বাজনা বাজে। অথবা ১০০ নং হাইকু-কবর পাখি/ ডাকে না বৃক্ষশাখা/ পাপের ঝিলে। ১০২ নং হাইকু-
বাকবাকুম/ পায়রার ডানার/ হস্তিনাপুর।
অত্র পঙ্‌্‌ক্তিসমূহে রয়েছে এক ধরনের রহস্যময়তা, দূরাগত ধ্বনি, অতলান্ত সুর ও আবিষ্কারের আনন্দ সম্ভোগ। যেন ‘না বলা বাণীর ঘন যামিনী’র আলো-আঁধারি। এখানেই হাইকু বা কবির সাফল্য ও সার্থকতা।
রিজোয়ান মাহমুদ কেবল ফুল, পাখি, চাঁদ জোসনার বায়বীয় মনোজগৎ-এ সীমাবদ্ধ থাকেননি। তার আঙুলের ডগায় এসে ঝলসে ওঠেছে রক্তাক্ত কাবুল, আল জাজিরার সাম্প্রতিক বেলেল্লাপনা বা নখরামিও।
তিনি গভীরতাস্পর্শী ধ্যানগভীর উচ্চারণ করেন- সেতার তার/পাঁজরের প্রহার/গলির মোড়ে।
এতদ পঙ্‌ক্তিসমুদয় আপাত অর্থ ছাপিয়ে গভীর-গভীরতের ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত। আবার বিবেকের তাড়না থেকে তিনিই ঘোষণা করেন-
তাবিগামি সে, সে/ অগ্নিখণ্ড কাশ্মীর / সে-কে বাঁচাবে! অথবা, জম্মু কাশ্মীর/ কেন এতো অধীর/ নিঃশ্বাস বন্ধ।
রিজোয়ানের হাইকুতে, যেমন অবলীলায় অখিলবন্ধু এসে ঠাঁই নেয়, পাশাপাশি, পক্ষান্তরে দেহের বীণা’র মতো মামুলি চযৎধংব ‘পাহাড়ের ছাদ’ ‘দিগন্তে পূর্ণতা’, ‘পাথরের ক্রন্দন’ কিসিমের বর্জিত, বহুল ব্যবহৃত, গতানুগতিক ইত্যাকার, শব্দ বন্ধের কারণে আমাদের হোঁচড় খেতে হয়।
কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় রিজোয়ান মাহমুদের এই নবতর কাব্যিক পারফরমেন্স সার্থক ও বহুস্তর ভাবনার যোগানদার। জাপানি আরেক কবিতামাধ্যম ‘জেন কবিতা’র মতো অপর ইঙ্গিতময়তায় আকীর্ণ এই হাইকু পদ বাংলা কবিতার ইতিহাসে আলোচনার দাবি করতে পারে-এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
লাল-হলুদ-এর দৃষ্টিনন্দন ও চিত্তাকর্ষক প্রচ্ছদ রচনা করেছেন মনিরুল মনির। মাত্র ১০০ টাকা মূল্যের এ গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৫০ বছরের অর্জন সরকার শেষ করে দিয়েছে: ফখরুল
পরবর্তী নিবন্ধমনের ভরাডুবি