রবীন্দ্রনাথের বিদেশি ফুল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ৫ আগস্ট, ২০২৩ at ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম-/, ‘কি তোমার নাম?’/ হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তরে,/ নামেতে কি হবে।/ আর কিছু নয়,/ হাসিতে তোমার পরিচয়।”

রবীন্দ্র সাহিত্যের বিশাল অঙ্গন জুড়ে রয়েছে জীবন ও জগৎ, প্রকৃতি আর প্রেম, কল্পনা আর বাস্তবের অভূতপূর্ব এক সম্মিলন। ১৯২৩ সালে জাপান সফরকালে কবি পেরু যাবেন ‘গেস্ট অব অনার’ হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে। তিনি ১৯২৪ সালে লিওনার্দো এলমহাটর্স্টকে সাথে নিয়ে ‘হারুনা মারু’ জাহাজে চড়ে রওনা হলেন। কিন্তু, জাহাজ আর্জেন্টিনার বুয়েনোস এয়ারিসএ নোঙ্গর করার পর কবি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন চিকিৎসকের পরামর্শে কবিকে বিশ্রামের জন্য বুয়েনোস এয়ারিস নেমে যেতে হয়। কবি হোটেল প্লাজাতে উঠেন বিশ্রামের জন্য। বিশ্বকবির হোটেল প্লাজায় উঠার খবর ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎ গতিতে। সে খবর বুয়েনোস এয়ারিসের স্বনামখ্যাত লেখক, অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং পরমা সুন্দরী নারী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কানে পৌঁছালে তিনি কবির সাথে দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এই দেখা করার স্পৃহার যথেষ্ট কারণ ছিল। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কবির ‘গীতাঞ্জলী’ র কবিতাগুলো পড়েই বিস্মিত হয়েছিলেন। ধ্যানে জ্ঞানে তিনি কবিকে তাঁর চিন্তা চেতনায় ও মননে ধারণ করেছিলেন। তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন। আর সে সুযোগ যখন হাতের কাছে এসেই গেল, তিনি খুশিতে আত্মহারা ছিলেন। কবির সাথে তাঁর দেখা হলো হোটেল প্লাজায়। প্রথম সাক্ষাতেই ওকাম্পো কবিকে তাঁর ‘সান ই সিদ্রোর ’ অবকাশ যাপন কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিতার অনুমতি না মেলায় ওকাম্পো নিজের হীরের মুকুটএর বিনিময়ে ‘সান ই সিদ্রো’ র অদূরে নদীর পাড়ে তাঁর এক আত্মীয়ের বাগানবাড়িতে কবিকে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কবি তা সানন্দে গ্রহণ করেন। ‘মিরালরিও’র ্‌এই বাড়িতে ওকাম্পোর সান্নিধ্য আর আতিথেয়তায় খানিকটা অসুস্থ কবি আরোগ্য তো লাভ করলেনই, বরং বাড়ির বাগানের রকমারি ফুল, সবুজের অবিরাম সুন্দর, নদীতীরের শোভা, বাড়িটির দ্বিতলের অলিন্দে বসে উপভোগ করতেন। ওকাম্পোও যেন হয়ে উঠলেন মাত্র কয়েকদিনে তাঁর নতুন জীবনদাত্রী, সাহিত্যের প্রেরণাময়ী, কল্যাণময়ী এক মানবীতে।

ওকাম্পোর আসল নাম ‘সিনোর ভিত্তোরিয়া দ্য এস্ত্রেদা।’ ১৮৯০ সালে বুয়েনোস এয়ারিসের এক ধনি পরিবারে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর জন্ম হয়। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর জন্মের ঠিক এক বছর পরে তাঁর পিতা বুয়েনোস এয়ারিসের অদূরে সান ই সিদ্রোতে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করেননি। বাড়িতে বসেই শিক্ষক এসে তাঁকে পড়িয়ে যেতেন। তিনি লিখতেন, বিশ্ব সাহিত্য পড়তেন, নারীমুক্তির কথা ভাবতেন। তিনি আর্জেন্টিনার সাহিত্য অঙ্গনে সুপরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে ‘সুর’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিধায় তিনি সুধী মহলে প্রশংসিত ছিলেন। ওকাম্পো সুন্দরী তরুণী, কবির বয়স তখন প্রায় ৬৩ বছর। পিতার বয়সী এই মহান ব্যক্তির সান্নিধ্য ওকাম্পোর চেতনাকে নাড়া দিয়েছিল নিঃসন্দেহে। কারণ, তিনি ‘গীতাঞ্জলী’র কবিতাগুলো পড়েই মোহাচ্ছন্ন ছিলেন। কবি, তাঁর আতিথ্য গ্রহণের দ্বিতীয় দিনে একটি পুরনো কবিতা লিখে তা অনুবাদ করে ওকাম্পোর হাতে দেন। কবিতাটি হলো :

আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।/ তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী।।’/ কবিতাটি পড়ে তরুণীর হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। তিনি কবির প্রেমে মোহাবিষ্ট হন। তিনি উপলব্ধি করলেন, এই সম্পর্ক আর অনুভূতি তো নিতান্তই একপেশে। তাঁর হৃদচেতনার কম্পন তো কবি কোনদিনও জানতে পারবেন না। এই সম্পর্ককে তিনি ‘বোধ’ হিসাবেই আখ্যায়িত করেন। কবিও তাঁর ‘অতিথি’ কবিতায় বলেন,

প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী,

মাধূর্যসুধায়:কত সহজে করিলে আপনারই

দূরদেশী পথিকেওে; যেমন সহজে সন্ধ্যাকাশে

আমার অজানা তারা স্বর্গ হতে স্থির স্নিগ্ধ হাসে

আমারে করিল অভ্যর্থনা। নির্জন এ বাতায়নে

একেলা দাঁড়ায়ে যবে চাহিলাম দক্ষিণগগনে

ঊর্ধ্ব হতে একতানে এলো প্রাণে আলোকেরই বাণী;

শুনিনু গম্ভীর স্বর! “তোমারে যে জানি মোরা জানি;

কবি তাঁর ‘পূরবী’ কাব্য গ্রন্থটি ওকাম্পোকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন, “বিজয়ার করকমলে।” এই বিজয়া কবিচিত্তে আমৃত্যু লালিত ছিলেন। কখনো প্রেয়সী, কখনো প্রেরণাদাত্রী, কখনো বিজয়িনী। আর্জেন্টিনায় রুগ্নদশায় এই বিদেশিনীর সান্নিধ্যে কবি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। লিখেছিলেন একের পর এক গান আর কবিতা। কবিতা আর গানের মধ্য দিয়েই তিনি আমাদেরকে চিনিয়েছেন সিন্ধুপারের বিদুষী এই বিদেশীনিকে। আর ভিক্টোরিয়া তাঁর প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন, সান ই সিদ্রোতে অবস্থানকালে কবি তাঁকে কিছু বাংলা শব্দ শিখিয়েছিলেন। এই সব শব্দমালার মাঝে কেবল একটি শব্দই তাঁর চিরদিন মনে থাকবে। আর সেই শব্দটি হলো ‘ ভালোবাসা’। কবি জীবনের শেষ গগনে এসে এই বিদেশিনীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। আর সেই বিদেশিনীক তিনি গানে, সুরে , বাণীতে ধ্বনিতে বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় করে রেখে গেছেন। তিনি ‘ক্ষণিকা’ কবিতায় লেখেন,

খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা

খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা।।

কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে

গোধূলীবেলার পান্থ জনশুন্য এ মোর প্রান্তরে

লয়ে তব ভীরু দীপশিখা।

দিগন্তের কোন্‌ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঘরে-বাইরে গৃহিণীর কর্মব্যস্ততা
পরবর্তী নিবন্ধচার ভিক্ষুককে পুনর্বাসন, এতিম, রোগী ও ঋণ গ্রহীতাদের প্রায় ২৩ লাখ টাকা অনুদান