ঘরে-বাইরে গৃহিণীর কর্মব্যস্ততা

নাজনীন বেগম | শনিবার , ৫ আগস্ট, ২০২৩ at ১১:০১ পূর্বাহ্ণ

পুরোদমে বর্ষাকাল চলছে। তবু দেখা নেই বৃষ্টির। তিনি এলেও একটুখানি ভিজিয়ে গরম বাড়িয়ে আবার চলে যাচ্ছেন। চলছে খরতাপের নিদারুণ অস্থিরতা। অস্বস্তিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বাইরে যাদের বের হতে হয় তারা জানে প্রখর রোদের কি পরিমাণ দাবদাহ। আর যারা ঘরে থাকেন? তারাও কি খুব আরামে কিংবা স্বস্তিতে কাটাতে পারছেন? বিশেষ করে ব্যস্ততম গৃহিণীরা। আমাদের দেশে সিংহভাগ মানুষই নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পর্যায়ে যাপিত জীবন অতিবাহিত করেন। যেখানে এসি কিংবা আইপিএসের বাহুলতা নেই বললেই চলে। কারণ গরমে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট প্রতিকূল পরিস্থিতির নির্মম শিকার। সংগত কারণে সারাদেশের বেশিরভাগ গৃহিণী অসহনীয় গরমে নিতান্ত ক্রান্তিকাল পার করছেন। প্রথমত সকাল থেকে রাত অবধি, খাবারের আয়োজন করা প্রত্যেক গৃহকর্ত্রীরই দারুণ কর্মব্যস্ততা। সেখানে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত কিংবা শীত, বসন্তের কোনো ব্যাপারই নয়। চরম দাবদাহে যেমন ঘরের গৃহিণীকে রান্না বান্নার পাট চুকাতে হয় তেমনি তীব্র শীতের কাঁপুনিতেও গৃহকর্ত্রীর আরাম অবকাশের কোনো সুযোগই নেই। তবে কিছু ফারাক তো থাকেই ঋতু বৈচিত্র্যের এ অঞ্চলে। পরিবেশ শান্ত, স্নিগ্ধ কিংবা বৃষ্টিস্নাত থাকলে কাজকর্মে উৎসাহ উদ্দীপনা তো থাকেই। বাড়তি যোগ হিসেবে সফলভাবে, ঠাণ্ডা মাথায় গৃহের সামগ্রিক কর্ম সম্পাদন করাও এক অনন্য স্বস্তি। অসহ্য গরমে প্রকৃতি এখন দারুণ খরতাপ বিকিরণ করছে। এবারের বৈশাখজ্যৈষ্ঠ মাস চরম খরতাপে জনজীবনকে অতিষ্ঠের শেষ ধাপে নিয়ে যায়। ভাবা যায় গৃহকর্ত্রীকে কি পরিমাণ কষ্ট করে জ্বলন্ত উনুনের পাশে দাঁড়িয়ে ঘরের মানুষদের জন্য রাঁধতে হয়েছে? পাকের ঘরে ফ্যান থাকলেও তা চালানোর সুযোগই নেই। ফ্যানের বাতাসে চুলাই তো জ্বলবে না।

শুধু কি রান্না? সব কিছুর যোগাড় করতে বেশ সময়ও লাগে বলাই বাহুল্য। কাটাকুটি কিংবা ধোয়ামোছা করার সময় ফ্যান ছাড়া যায়। কিন্তু গরমে যে মাত্রায় লোডশেডিং থাকে তাতে গৃহিণীরাই পড়েন সবচেয়ে বেশি নাকালে। রান্নার আয়োজন কিংবা চুলা জ্বালানোই নয় অনেকেই আবার নিজের হাতে বাজার করতেও পছন্দ করেন। সেভাবে বাজার পর্যন্ত ছুটেও যান। আগেই উল্লেখ করা হয় দেশের বেশিরভাগ লোকই নিম্ন মধ্যবিত্তের। যাদের আয় রোজগার সীমিত এবং সারামাস সঙ্কুলানেও হরেক ঘাটতি সামনে এসে দাঁড়ায়। তাই শুধু পছন্দসই বাজার নয় বাজেটও মাথায় রাখতে হয় বরাবরই। এমন সব হিসাবনিকাশ গৃহিণীরাই অনুমান করতে পারেন অনেক বেশি। যদি গৃহের কর্তা মহাশয় তার যোগ্য স্ত্রীটিকে শুধু বিশ্বাস কিংবা নির্ভরতা নয় বরং সম্মানটুকুও দিতে জানেন। সফল, দক্ষ গৃহিণীরা স্বামীর আয়রোজগারকেও আমলে নিতে ভুলই করেন না। সংগত কারণে নিজ হাতে বাজার করে গৃহিণীরা যে মাত্রায় সাশ্রয় করেন তার দামও কম কি? বাইরে শুধু সূর্যের প্রখর দীপ্তি নয় বাজারেও জ্বলছে রীতিমতো আগুন। আবার কিছু গৃহকর্ত্রী আছেন যারা শুধু গৃহিণীই নন কর্মজীবিও বটে। কোনো না কোনো পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। তবে এখন চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা কম বলা যাবে না। এই শতাব্দীর শুরু থেকে তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া সমতাভিক্তিক সমাজ বিনির্মাণে আর এক সক্ষমতা তো বটেই। নারীরা এখন সরকারি, বেসরকারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেট পেশায় নিজেদের সম্পৃক্ত করছে দর্শনীয়ভাবে। তবে সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ নামে নারীবান্ধব প্রকল্পটির শুভযাত্রা শুরু করেন। তারই কল্যাণে একদশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরম সন্ধিক্ষণে যে সফলতা অর্জিত হয় তাও নজরকাড়া।

এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারী উদ্যোক্তা ৬৫%। এর বিপরীতে পুরুষ উদ্যোক্তা ৩৫%। নারী অগ্রযাত্রায় অনন্য সফলতা অনস্বীকার্য। কর্মজীবী ও ব্যবসায়ী নারীদেরও সংসার সামলাতে হয়। সেখানেও নারীরা খুব বেশি পিছিয়ে থাকেন না। রাত দিনের সাহায্যকারী গৃহকর্মী সবার সংসারে থাকে না। কারণ নিম্ন মধ্যবিত্তের বাসায় একজন ঠিকা বুয়া থাকাই সংগত। সে চুক্তি অনুযায়ী কয়েকটা কাজ করে চলেও যায়। বাকিটা ঘরের কর্ত্রীকেই সামলাতে হয়। কর্মজীবী নারীরা সেখানেও পারদর্শিতার নজির রাখেন। তবে নিদাঘ মধ্যাহ্নে যেভাবে সংসার চালাতে হয় ঘরের কর্ত্রীকে সেটা কোনোভাবেই সুখকর নয়। কর্মজীবীদের জন্য আরও কষ্টকর। কারণ পরিবারকে যথার্থভাবে গুছিয়ে, সামলিয়ে তাকে কর্মস্থলে যেতে হয়। কর্মজীবী স্বামী তথা গৃহকর্তা কাজ শেষে যেভাবে ফুল বাবু হয়ে ঘরে স্বস্তিতে সময় পার করেন পেশাজীবী নারীর পক্ষে সেটাও সম্ভব হয় না। তার সন্তানের লেখাপড়া, দেখভালের দায়দায়িত্ব সিংহভাগই বহন করেন স্নেহময়ী মায়েরা। সকালের নাস্তা দুপুরের টিফিন সবই সুনিপুণ হাতে মায়েরই তৈরি। খুদে শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রেসটা পর্যন্ত পরিয়ে দিতে হয় মাকেই। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া কিংবা আসা সম্ভবত বাবামা দুজনে মিলেই করেন। কারণ মাকেও তো তার দাপ্তরিক কর্মযোগ সামলাতে হয়। তা না হলে চাকরি হারানোর আশঙ্কা পদে পদে। এমনকি শিশুসন্তান বাসায় রেখেও মাকে তার কর্মস্থলে পৌঁছাতে হয়। পর্যাপ্ত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র না থাকায় মায়েদের অসুবিধা হতে সময়ও লাগে না। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উঠে আসে ‘পেশাজীবী মায়েদের চাকরি হারানোর শঙ্কা।’ সংগতভাবে একজন গৃহিণীকে দশভূজায় সর্বদিক সামলাতে হয়। তিনি মা, স্ত্রী, কর্মজীবী অনেক কিছুর মধ্যে আটকে থাকা সাধারণ এক বাঙালি নারী। তার ওপর গৃহিণীর আসনটি তো নির্ধারিত ও পাকা হয়ে থাকে পরিবারের কর্ত্রীর জন্য। তাই শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কোনো ঋতুতেই তিনি স্বস্তির কিংবা স্বস্তিতে থাকেন না। দৌড় ঝাঁপের মধ্যেই কেটে যায় তার যাপিত জীবন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপরাধমুক্ত সমাজ গড়তে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান লায়ন ইমরানের
পরবর্তী নিবন্ধরবীন্দ্রনাথের বিদেশি ফুল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো