যে অর্থে নারীর মুক্তি…

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ২৭ মে, ২০২৩ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

পড়ছিলাম, আমাদের মুক্তি কোথায়? মুক্তির সংজ্ঞা কি? রাষ্ট্র কিভাবে মুক্তি দিতে পারে? দর্শনের জানায়, অনেক দার্শনিক ধরা দেবেন, দিচ্ছেনও। আপাতত বলছি, বিবেকের মুক্তিই আমাদের মুক্তি। বিবেকের প্রশ্নে জেন্ডার ইস্যু নেই, মানুষের মুক্তি বিরাট করে মাথা চাড়া দিলে জেন্ডার ইস্যু হবার কথা ছিল না। কিন্তু মুক্তির বিপরীতে যেমন পরাধীনতার চাপ আছে তেমনই রাষ্ট্রের পক্ষে অর্থের বা যোগানের টান আছে। যোগান কিংবা চাহিদা ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কেল্লা তৈরি করবে, চিরন্তন সত্যও। কিন্তু নারীর বিপরীতে কি পুরুষ আছে? নাকি নারীর বিপরীতে স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিই। যেমুক্তি সোনার হরিণ নয়, কিন্তু নারীর সমান্তরালে থাকা এই মুক্তিকে লাভ করার অর্থ হরেক রকমের। যে অর্থে নারীর মুক্তির গীত লিখছি সেখানে ‘মুক্তির’ অর্থের চেয়ে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে বিচিত্র ভাবনাই ধরা দেবে হয়তো।

নারীর মুক্তি কেন। নারীরা পরাধীন বা বন্দী আছেন কি? নারীদের পায়ে অদৃশ্য শিকল কি লোহার? লোহার হলে তো, জঙ ধরে ভেঙ্গেও যেত, কিন্তু এশিকল সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয়। কখনো এটি পিতা বা স্বামী কিংবা পুত্র রূপে ধরা দিলেও, নীতি একই। সহস্র বছরে নারীরাও একে অলংকার হিসেবে জড়িয়ে নিয়েছেন। এরপর হয়তো নিজেই অলংকারের যত্ন নিয়েছেন, অন্যকে হস্তান্তর করেছেন অথবা দায়িত্ব নিয়েছেন বয়ে চলার। ফলে কখনো নারীই পুরুষতন্ত্রের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেন।

তবু কোথাও মুক্তির আলো ছড়ায়। নারীরাই মুক্তির স্বাদ নিতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। নারীরা মুক্তি পাবে কেমনে! এসব পুরানো কথা, নারীরা জানেন, অর্থনৈতিক মুক্তিই তাদের একমাত্র উপায়। অর্থনৈতিক মুক্তি জরুরী এক কারণেই যে, বাঙালি সাহায্যের বিনিময় বোঝে না। যখন কোনো নারী হাত পাতে, তখন সে কেবল তার পিতাস্বামীপুত্রের কাছে ধরা খেয়ে গেলো তা নয়। তাকে হাত পাততে হয় গোটা সমাজের কাছে। ধরুন, দুটো উদাহারণ টানি, একটি যৌথ পরিবারে দ’ুজন পুরুষ যদি থাকেন, তাদের মধ্যে যে বেশি অর্থনৈতিক জ্ঞান রাখেন তিনিই বেশি ক্ষমতাধর হিসেবে প্রতীয়মান হন। অর্থনৈতিক জ্ঞান বলছি, কেননা এটি কেবল কচকচা নোট নয়, পারিপার্শ্বিক সকল কিছুকে আয়ত্তে আনার পন্থাও শেখায় বলে। ঠিক একই সময়ে দ্বিতীয় পুরুষটি অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। এখন এ দ’ুজনের স্ত্রীই যদি তাদের কাছে হাত পাতে, দুজনই ‘মেজাজ গরমের’ অজুহাতে তাদেরকে মৌখিক কিংবা শারীরিক নির্যাতন করতে পারেন। কেন? কারণ একজনের অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাকে সামগ্রীক ক্ষমতার উৎস করে তোলে অপরজনের ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতার অভাব’ শারীরিক কিংবা পুরুষের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার প্রতি যুদ্ধের আহ্বান করে। একজন নারী যদি বিবাহসূত্রে স্বামীর বাড়ি যান, তবে সে তার ফেলে আসা পরিবারের জন্যে দায়িত্বকে কি অবহেলা করবে? নিজের শখইচ্ছা কিংবা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধার না ধারলেও নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি তাকে একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের জ্ঞান দেয়। ফলে তার অর্থনৈতিক মুক্তির ধারণা আমাদের ‘সাধারণ মুক্তির ধারণা’ থেকে বদলে যায়।

একজন সুস্থস্বাভাবিক মানুষ নিজেকে অন্যের ওপর বোঝা না হতে, নিজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ রুখতে নানা কারণে অর্থনৈতিক মুক্তি দাবি করে থাকেন। আর একজন নারী যখন অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত না হন, তখন সমস্যাটা প্রকট হয়ে উঠে।

এখন নারীরা অনেক অংশেই সচেতন, অর্থনৈতিক মুক্তি পেতে ছুটে চলছে। তবে ঠিক মুক্ত কি হতে পেরেছে। নতুন কিছু সমস্যাও তৈরি হচ্ছে

কিছু সংখ্যক নারী ভাবছেন, অর্থনৈতিক যোগান দিয়ে পারিবারিক শান্তি বজায় রাখবেন, কেউকেউ ভাবছেন আমি যেহেতু অর্থনৈতিক যোগান দিতে পারছি না সেহেতু আমার খেটে পুষিয়েও দিতে হবে, কেউ ভাবছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেহেতু নেই, আমার অন্য যেকোনো চাহিদা বেমানান, পরিবারে মতামত দিতে বোধহয় অর্থনৈতিক মুক্তি আবশ্যক, যেকোনো উপায়ে অর্থনৈতিক মুক্তি চাই (ন্যায়অন্যায়) এর ধার না ধরে ইত্যাদি। কিন্তু নারীর মুক্তিতে ‘অর্থনৈতিক মুক্তির’ যে চাহিদা ছিলো তা কি এসবকে ইঙ্গিত করে?

নারীরা দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক দাপটে ছিলেন বলে, অনেকে অর্থনৈতিক মুক্তিকে ক্ষমতার উৎস করে তুলছেন, ভাবছেন ক্ষমতার প্রকাশই তাকে সুরক্ষা দিতে পারে। ক্ষমতাধর হলে, সকলকে ছুঁড়ে ফেলার প্রয়াস, একলা থাকলে বোধহয় শান্তি, নিজেকে স্বাধীন রাখার একমাত্র উপায় অর্থএধরনের বাহ্যিক ভাবনা জাগ্রত হয়। তবে ঘেঁটে দেখলে অবাক হবেন না হয়তো, পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে কুৎসিত প্রভাব এটি। পুরুষতন্ত্র তাদের অর্থনৈতিক জ্ঞানকে যেভাবে রাজনৈতিক জ্ঞানে পরিণত করেছে তার ধারাবাহিকতায় নারীও কি তার অর্থনৈতিক ক্ষমতার জ্ঞানকে কাজে লাগাবে? কিংবা ক্ষমতাসীন হরিণ হয়ে উঠবে?

নারীরা কি বুঝে ওঠে না, আমার পরিবারে মতামতের জন্যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই একমাত্র পথ নয়, আমার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই মানেই আমার পুষিয়ে দিতে হবে সবসময় তা নয়, অর্থনৈতিক চাহিদা না থাকলে বাদবাকি চাহিদা মিথ্যে হয়ে যায় না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সবার আছে, সম্পর্কের মধ্যে দুজনকেই এগিয়ে আসতে হয় যেমন তেমনই সময়ে এক পা পিছেও টানতে হয়

পুরুষতন্ত্রের একটি মজার হিসাব হলো, তারা যেকোনো পথে যেকোনোভাবে নিজের ‘কমফোর্ট জোন’ তৈরি করে নেয়। অর্থনৈতিক মুক্তির পাঠে তারাও নিজেদের সুবিধা লুফে নিলো। নারীকে এখন আর ঘরের কাজ না, অন্দরবাহির দুয়ের কাজই সামলাতে দিলো। যার ফসল ‘আমি নারীই, আমিই পারি’ বা ‘এক হাতে সব সামলে’ নেওয়ার বিষয়টি। আর কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় অর্থ উপার্জন করে আনার জন্যে অনেক নারীকেই চাপ দেওয়া হয়। নির্যাতন অব্দিও গড়ায়। নারীরা ঠিকই উপার্জন করলেও , রয়ে সয়ে চলতে গিয়ে ব্যর্থ হলে খারাপের তকমা খায়।

আদতে নারীদেরই বোধ হওয়া উচিত, কোন অর্থে তার মুক্তি। ক্ষমতাসীন হরিণ হলে কেবল সকলকে ছুঁড়ে ফেলে একলা থাকা হবে। যেমনটা ঘরের অন্য দশ পুরুষ এতকাল আমাদের চোখে ছিলেন। আর অর্থনৈতিক মুক্তি লাভের আশায় আজীবন কলুর বলদের মত খেঁটে মরতে হবে। ভয়ে চোখ নুয়ে পড়লেও মনের চোখ ঠিকই মুক্তি চাইবে। বিবেকের মুক্তি যদি একত্রে হয় তা সোনায় সোহাগা। কিন্তু পুরুষের বিবেকের মুক্তি পাওয়ার আশা করা ভার। নিজেকে যদি মুক্ত করা যায় মন্দ নয়।

আর পুরুষতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রকোপ যদি ধরা না যায়, তবে মুক্তি নেই। আজীবন নানা ভাবে নানা পন্থায় পিষে মরতে হবে। ফলে চাই সে মুক্তি যেমুক্তি আমাদের বিবেকের, যেমুক্তি মানবের

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভিভাবকত্ব
পরবর্তী নিবন্ধসাউদার্ন ভার্সিটিতে পুরকৌশল বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা