অভিভাবকত্ব

রিমঝিম আহমেদ | শনিবার , ২৭ মে, ২০২৩ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন সেদেশের সংবিধান। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮()-এ বলা আছে ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ অথচ আমাদের প্রচলিত আইন তথা সমাজবাস্তবতায় নারী কি আদতে পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করতে পারেন?

একজন নারী সন্তান জন্মদান থেকে শুরু করে লালনপালন যে গুরুত্ব ও শ্রমের সাথে করে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তা সত্ত্বেও নারী কখনো তার গর্ভের সন্তানের আইনগত অভিভাবক নয়। সে কেবল লালনপালন, দেখভাল ও হেফাজতকারী। আমরা দেখি, নানা ঘটনা ও পরিস্থিতিতে সন্তানের প্রতি পিতৃত্বের দখলদারিত্ব ও অধিকারবোধ প্রবল হয়ে ওঠে, কেবল আইন ও সমাজকাঠামো পিতৃতন্ত্রের সহায়ক বলে। এর ফলে পিতার নানা সমস্যা থাকার পরেও মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় জিম্মাদারিত্ব। কারণ সমাজ ও প্রচলিত আইনে পিতাই সন্তানের চূড়ান্ত অধিকারী।

বন্ধন থাকলে তা ভাঙার প্রবণতাও থাকে। যেহেতু পৃথিবীর কোনও সম্পর্কই চিরস্থায়ী নয়। বিয়ে যেহেতু একটা চুক্তির উপর নির্মিত, সে কারণে সব বিয়েও চিরকাল টিকে থাকে না। নানা কারণে তা বিচ্ছেদে রূপ নিতে পারে। কিন্তু স্বামীস্ত্রীর বিচ্ছেদের পর সব থেকে বেশি দোটানায় পড়ে যদি তাদের সন্তান থাকে, তারা। সন্তান বাবার কাছে থাকবে, না কি মায়ের কাছে সেটা নির্ভর করে আইনের ওপর এবং অনেকাংশে আইন কি সঠিক সুরাহা করতে পারে!

ধরা যাক, কোনও বাবা সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় স্ত্রীকে রেখে চলে গেল, আর খোঁজখবর নিলেন না, মা তার সন্তানকে জন্ম দিলেন, লালন পালন করলেন, কিন্তু স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্ট ইত্যাদিতে বাবা মুখ্য চরিত্র হয়ে ওঠেন। কেবল জৈবিক ভূমিকা ছাড়া যে বাবার আর কোনও ভূমিকা নেই সন্তানের পেছনে সেখানেও বাবা হয়ে ওঠেন প্রধানতম অভিভাবক। সেটা একজন মা ও তার সন্তানের জন্য নিঃসন্দেহে অপমান ও অসম্মানের।

অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০এর বিধান অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সী সন্তানকে নাবালক বিবেচনা করা হয়েছে। আর অভিভাবক হলেন তিনি, যিনি কোনো নাবালকের শরীর অথবা সম্পত্তির অথবা সম্পত্তি ও শরীর উভয়ের তত্ত্বাবধান এবং ভরণপোষণ প্রদানে আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত।

উক্ত আইন অনুযায়ী নাবালকের স্বাভাবিক এবং আইনগত অভিভাবক হলেন পিতা। পিতার অনুপস্থিতিতে বা অভিভাবক হিসেবে অযোগ্যতায় মাতা বা আদালতে আবেদনের প্রেক্ষিতে নিয়োজিত ব্যক্তি নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবক হতে পারেন।

তবে নাবালকের সার্বিক মঙ্গল ও কল্যাণের কথা ভেবে জিম্মাদারিত্বের বিষয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইন অনুযায়ী সন্তানের মাকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের জিম্মাদারিত্বের অধিকার দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ছেলে শিশু হলে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মা তার জিম্মায় রাখার অধিকারী।

তবে সন্তান যার কাছেই থাকুক না কেন নিয়মিত দেখাশোনা, খোঁজ খবর নেওয়া ও ভরণপোষণ প্রদানে পিতা বাধ্য থাকবেন। তবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করে আদালত সে জিম্মাদারিত্ব পুনর্বহাল করতে পারেন শিশুর নির্দিষ্ট বয়স শেষ হবার পরেও।

বাস্তবতা হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে বাবা ও আইনের ক্ষমতার কাছে কখনো কখনো শিশুর স্বার্থ বা মঙ্গল পরিপন্থী হয়ে উঠতে পারে জিম্মাদারিত্বের সিদ্ধান্ত । তখন নারী ও পুরুষের লড়াই হয়ে ওঠে মুখ্য। জিতে যায় পিতৃতন্ত্র।

অপরদিকে, অভিভাবক হিসেবে পিতাও অযোগ্য হতে পারেন। অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০এর ১৯ ধারা মতে অভিভাবক হিসেবে পিতাও অযোগ্য হতে পারেন। যদি বাবা চারিত্রিকভাবে অসৎ হন, সন্তানের মা অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ প্রদর্শন করেন, প্রকাশ্যে লাম্পট্য করেন, দুস্থ অথবা নিঃস্ব হন, মাদকাসক্ত বা অধার্মিক হন, শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর হন, ভরণপোষণে অবহেলা করেন কিংবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন তবে এসব কারণ পিতাকে অভিভাবক হিসেবে অযোগ্য বিবেচনা করবে।

মুসলিম আইনের ৩৫৯ নং ধারার বিধান অনুসারে নিন্মলিখিত ব্যক্তিগণ ক্রমানুসারে নাবালক সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবক হওয়ার অধিকারী।

() পিতা

() পিতার উইল দ্বারা নিযুক্ত এক্সিকিউটর

() পিতার পিতা অর্থাৎ, দাদা

() দাদার উইল দ্বারা নিযুক্ত এক্সিকিউটর

এ চারজন ব্যক্তিকে নাবালকের আইনগত অভিভাবক বলা যাবে। আপনজনের অধিকার বলে অন্য কোনো নিকট আত্মীয় নাবালকের সম্পত্তির অভিভাবক হতে পারবে না। এমনকি নাবালক সন্তানের মা, আপন ভাই, বা আপন চাচাও না।

তবে নাবালকের পিতা বা দাদা জীবিত অবস্থায় মা, ভাই বা চাচাকে উইল দ্বারা এক্সিকিউটর নিযুক্ত করতে পারেন। তবে পিতার অবর্তমানে নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবকত্ব সরাসরি আদালতের মাধ্যমে সরকারের ওপর চলে আসে। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, মা কেবল একজন তত্ত্বাবধায়ক। তিনি নাবালক সন্তানের সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন না, যদি না আদালত কর্তৃক সম্পত্তির অভিভাবক নিযুক্ত হন। মা বা নারীর সামর্থ্য ও ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সন্তানের অভিভাবক হতে পারেন না আইনগত নানা বাধার কারণে।

যেসব কারণে একজন মা সন্তানের জিম্মাদারিত্ব হারান:

() নীতিহীন জীবন যাপন করলে

() যদি এমন কারো সাথে বিয়ে হয়, যিনি শিশুর নিষিদ্ধস্তরের মধ্যে ঘটলে তার ওই অধিকার পুনর্জীবিত হয়

() সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে বা দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে

() বিয়ে থাকা অবস্থায় বাবার বসবাসস্থল থেকে দূরে বসবাস করলে

() যদি মা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে

() যদি সন্তানের জিম্মা থাকা অবস্থায় শিশুকে তার বাবার সাথে দেখা করতে না দেয়

মুসলিম আইন ছাড়াও অন্যান্য, যেমন হিন্দু আইনেও বৈধ সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক তার বাবা। মা কেবল হেফাজতকারী। তবে অবৈধ সন্তানের ক্ষেত্রে সন্তানের অভিভাবক মা। যেহেতু পিতার ধর্মই সন্তানের ধর্ম তাই পিতা ধর্ম ত্যাগ করলেও তার অভিভাবত্ব হারায় না। আবার অবৈধ সন্তানের পিতার পরিচয় পাওয়া গেলে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে বাবা অগ্রগণ্য হবেন। সেক্ষেত্রে মা হবেন জিম্মাকারী। একইভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও হিন্দু আইন প্রযোজ্য।

অভিভাবকত্ব ও নাবালক সন্তানের জিম্মাদারিত্বের জন্য পারিবারিক আদালতে আবেদন করা যায়। এছাড়া আদালতের বাইরেই সালিসি ও সমঝোতার ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। আদালতের মাধ্যমে প্রতিপাল্যের বিষয়ে কোনো আদেশ প্রদান করা হয়ে থাকলে যদি কেউ আদালতের এখতিয়ারের সীমা থেকে নাবালককে সরিয়ে নেয়, তাহলে আদালতের আদেশে ওই ব্যক্তি অনূর্ধ্ব ১ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ছয় মাস পর্যন্ত দেওয়ানি কারাবাস ভোগ করতে বাধ্য থাকবেন। ওই কারাবাসের খরচসহ মামলার খরচ এই আইন মোতাবেক হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রণীত কোনো বিধিসাপাক্ষে যে আদালতে মামলাটি চলছে তার বিবেচনার উপর নির্ভর করে আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

সুতরাং বোঝা যায়, অনেকাংশে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপরেই মূলত অভিভাবকত্বের বিষয়টি নির্ভর করে। মা যতদিন না সন্তানের পুরোপুরি স্বাভাবিক ও প্রকৃত অভিভাবক হিসেবে আইনগতভাবে স্বীকৃতি পাবেন না ততদিনই এই আশংকাও থাকে যে, এইসমস্ত সিদ্ধান্ত শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনায় রাখা বহুলাংশে সম্ভব নয়।

মায়ের দুর্ভাগ্য যে তিনি যত কিছুই করুন না কেন, এই সমাজে মা সন্তানের ‘অভিভাবক’ নন। যেহেতু মায়ের গর্ভ থেকেই সন্তানের জন্ম, কাজেই মায়ের পরিচয়ই সন্তানের প্রথম পরিচয় হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয়নি, এতগুলো বছরে বাংলাদেশের মায়েরা কোনো ক্ষেত্রেই সন্তানের অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। সব দায়দায়িত্ব পালন করার পরও শুধু মাই থেকে গেছেন, অনেকটা অন্যের জিনিস হেফাজত করার মতো। কিন্তু অভিভাবক হতে পারেননি।

তবে আশার কথা এই, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত একটি দ্বৈত বেঞ্চ একটি যুগান্তকারী রায় দেন। পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের অভিভাবক হবেন মা। শিক্ষার ক্ষেত্রেও মাকে আইনগত অভিভাবক হিসেবে যুক্ত করা হবে। এখন থেকে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকেও স্বীকৃতি দিয়েছে এই রায়।

শিক্ষাক্ষেত্রে মায়ের অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি দিয়ে উচ্চ আদালতের এই রায় নারীর অধিকার অর্জনের প্রথম ধাপ বলা যায়। কারণ, বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে সব ফরমে এখন থেকে অভিভাবকের ঘরে মা, বাবা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম লেখা থাকবে বলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। সব ফরমে তিনটি বিকল্প বাধ্যতামূলকভাবে সংযুক্ত করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। যদিও এটি পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের ক্ষেত্রে।

পিতৃপরিচয়হীন বলতে আদালতে যা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা হচ্ছে যৌনকর্মীর সন্তান, সারোগেসি/আইভিএফ টেকনোলজির মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী সন্তান, ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তান বা ধর্ষণকারীর ওরসজাত সন্তান, বাবার ফেলে যাওয়া সন্তান বা বাবার পরিচয় দিতে না পারা সন্তান।

শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী, প্রবেশন কার্যালয়, সমাজসেবা অধিদফতর, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধকমিউনিটি ক্লিনিকের বিশ্বস্বীকৃতি
পরবর্তী নিবন্ধযে অর্থে নারীর মুক্তি…