যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু

পিংকু দাশ | রবিবার , ৭ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৫০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এসেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন বাংলাদেশের সর্বত্র ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির ক্ষতচিহ্ন। দেশের নাগরিকদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব। কলকারখানার উৎপাদন প্রায় বন্ধের পথে। ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা। এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনসহ কঠিন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। দেশে ফিরে আসার বিশ দিনের মধ্যে তিনি গড়ে তোলেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা মিশন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ। অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার, সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা, পুনর্বাসন দ্রুততর করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা যাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে, কর্মসংস্থান তৈরি হয়। যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও পরিবহন খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের যে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে – একমাত্র সরকারি খাতে বস্তুগত মূলধন এবং দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা প্রায় ২৭৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কৃষি খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৩৭৬ কোটি টাকা। ব্যবসা বাণিজ্যে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এসব ক্ষয়ক্ষতির সাথে আছে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুজনিত ক্ষতি এবং লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংসজনিত ক্ষতি। এসব প্রতিকূলতাকে সামনে রেখে তিনি শূন্য হাতে শুরু করেছিলেন প্রিয় বাংলাদেশ গড়ার।
জন্ম থেকেই এদেশের মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থাকা বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়’।
বঙ্গবন্ধু শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালে জাতির সামনে মোট চারটি বাজেট পেশ করেন। প্রথম তিনটি বাজেটে প্রাধান্য পায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও শরণার্থী পুনর্বাসন কর্মসূচি। এই তিনটি বাজেটের অর্থমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। চতুর্থ ও শেষ বাজেট পেশ করেন পরবর্তী অর্থমন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। এই বাজেটে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়।
তিনি শুধু বাজেট প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত হননি, স্বল্পতম সময়ের মধ্য একটি সংবিধানও প্রণয়ন করেন। এক বছরের মধ্যে প্রণীত এই সংবিধানে ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর তিনি সই করেন। এই সংবিধান সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য এক পবিত্র দলিল। গণতান্ত্রিক বিশ্বে অন্যতম সুন্দর এই সংবিধানে জাতীয় চার নীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করলেও সেখানে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন পাঁচটি মৌলিক বিষয়- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা।
বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করেন তাজউদ্দীন আহমদ, ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য পেশ করেন ৭৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বাজেট। অর্থনীতি পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনীয় খাতগুলোর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। খাতগুলো হচ্ছে পরিবহন, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষি -বন- মৎস্য- সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন, শিল্প, শিক্ষা, গৃহ নির্মাণ,স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ ও শ্রম, পানি ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ইত্যাদি। সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয় যুদ্ধে বিধ্বস্ত পরিবহণ খাতে যা বাজেটের প্রায় ৪৮.৬৭%। এরপর কৃষি এবং বিদ্যুৎ স্বাভাবিক করে তুলতে সামগ্রিক পুনর্গঠন পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য বাজেটের ৪.৭৮% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মুক্তির প্রবর্তক। সংবিধানেই স্থান দিয়েছেন দারিদ্র্য মুক্তির পথ নির্দেশনা। দারিদ্র্য দূরীকরণের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষি ও শিল্পের পুনর্গঠন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান এবং সমবায় চেতনা বিকাশে নানা কর্মযজ্ঞ।
সদ্য স্বাধীন দেশে উন্নয়নের অভিযাত্রার অংশ হিসেবে তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্যঃ ১. দারিদ্র্য দূরীকরণ। এজন্য কর্মহীন লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। ২. উৎপাদন বৃদ্ধি করে জনগণের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের (খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, ভোজ্য তেল, কেরোসিন ও চিনি) চাহিদা মেটানো। ৩. কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত কাঠামোতে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয় যাতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়। কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে এবং শ্রমশক্তির শহরমুখী অভিবাসন বন্ধ হয়। ৪. বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে, আমদানিনির্ভরতা কমাতে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করা। ৫. জাতীয় আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে আয় বণ্টনের সমতা আনয়নের জন্য আর্থিক ও মুদ্রানীতি প্রণয়ন।
১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে এই ভাষণে। সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির পিতা সাফল্যের সাথে দেশ পরিচালনা করার জন্য সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারের উর্ধ্বে থেকে সকলকে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শোষণহীন সমাজ বঙ্গবন্ধুর উন্নয়নের মূল ভিত্তি। সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকারি সেবা জনসাধারণের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা, নারী জাগরণ কর্মসূচী ছড়িয়ে দিতে সবসময় জাতির পিতা ছিলেন সচেষ্ট। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য তিনি প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃতি ও পরিমাণ নির্ধারণ করেন।
১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে জিডিপি ছিল ৬২৮ কোটি ডলার, মাথাপিছু আয় ছিল ৯৪ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য। বিনিয়োগ ছিল জিডিপির মাত্র ৯ শতাংশ। শূন্য হাতে শুরু করলেও তাঁর সুদৃঢ় নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে জিডিপি ১৯৪৪ কোটি ডলারে এবং মাথাপিছু আয় ২৭৮ ডলারে উন্নীত করেছিলেন। এত অল্প সময়ে কোনো দেশের মাথাপিছু আয় তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৭২ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, – ১৩.৯৭% হতে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে যথাক্রমে ৩.৩২% এবং ৯.৫৯% এ উন্নীত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার মর্মান্তিক মৃত্যুর ফলে জিডিপিতে ধস নেমে আসে। ঐ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে -৪.০৮৮% এ নেমে আসে।
উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধু দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ব্যবস্থা করেন। শিল্প কারখানা পুনরুজ্জীবনের জন্য থোক অর্থ বরাদ্দ ও কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত করেন। উন্নয়নের অভিযাত্রায় যেসব বিষয়কে জাতির পিতা অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন সেগুলো হলো- বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, নিজস্ব মুদ্রা প্রবর্তন, আমদানি রপ্তানি চালু, জনবান্ধব বাজেট প্রণয়ন, শিল্পকারখানা জাতীয়করণ, শিল্পবিনিয়োগ নীতিমালা ঘোষণা এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। বৈদেশিক সাহায্যের উপর নিভর্রশীলতা কমানোর জন্য পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক ও বীমা চালু করার ব্যবস্থা করেন। এতে করে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। তিনি ঘোড়াশাল সার কারখানা ও আশুগঞ্জ সার কারখানা কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ শুরু করেন এবং বন্ধ শিল্প কারখানা চালু করে একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গঠনের ভিত রচনা করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দুটি মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। এর একটি হচ্ছে এদেশের সোনার মাটি ও অপরটি হচ্ছে এদেশের সোনার মানুষ। এই সোনার মাটি ও মানুষকে কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে’।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আর্থসামাজিক উন্নয়নে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন স্বাধীনতা বিরোধী চক্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য নির্মমভাবে হত্যা করে জাতির পিতাকে। বাঙালির কলংকময় দিন, চরম শোকের দিন ১৫ আগষ্ট। ওই দিন খন্দকার মোশতাকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং ফারুক রশিদ চক্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করে, ক্ষমতা দখল করেন খন্দকার মোশতাক। বিশ্বের দরবারে বাঙালি হারাল তাঁর সম্মান।
তথ্যসূত্র : উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ (প্রকাশনায়, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ), দশ দিগন্তে বঙ্গবন্ধু (রাশেদ রউফ), ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক (মোতাহার হোসেন সুফী)।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও রাজনীতিবিদ আবু ছালেহ