মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও রাজনীতিবিদ আবু ছালেহ

শ্রদ্ধাঞ্জলি

মোয়াজ্জেম হোসেন | রবিবার , ৭ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৫০ পূর্বাহ্ণ

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অংশগ্রহণকারী ও সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন জনাব আবু ছালেহ। পাশাপাশি ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ‘৫৮ এর আইয়ুব খাঁনের মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলন এবং ‘৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের যেকোনো দুর্যোগ মুহূর্তে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন সাবেক গণপরিষদ সদস্য আবু ছালেহ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের এক উজ্জ্বল বাতিঘর। সারাজীবন সত্যকে সত্য জেনেছেন, অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করেননি। তিনি রাজনীতিকে পরিচালিত করেছেন রাজনীতির কক্ষপথে।
১৯৭০ এর নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে গণপরিষদ সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন জনাব আবু ছালেহ। জনাব আবু ছালেহ পেশাগত জীবনে একজন ব্যাংকার ছিলেন। পাকিস্তান আমলে হাবিব ব্যাংকে চাকরি করেছেন, ৮০’র দশকে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন।
তিনি দেশ স্বাধীনের পর দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি দায়িত্বে ছিলেন। আবু ছালেহ এর আপন বড় ভাই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি সততা নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিজ দায়িত্ব পালন করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বাছাই করা ১৫ সদস্য বিশিষ্ট ডক্টর খুদরত এ খোদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য করেন। ১৫ সদস্যের এ শিক্ষা কমিশন ডক্টর খুদরত-ই-খোদা সহ সাতকানিয়া সরকারি কলেজ পরিদর্শনে আসেন।
আবু ছালেহর জন্ম সাতকানিয়া পৌরসভা ৮নং ওয়ার্ড ইছামতিকুল গ্রামে। তার পিতার নাম মরহুম আনু মিয়া। ১৯৭১ সালে ৩১ বছরের যুবক তিনি দেশকে শত্রু মুক্ত করতে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা শুধু নিজে যুদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট অঞ্চলে ছুটে বেড়িয়েছেন দিনের পর দিন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেইসব স্মৃতি মনে পড়লে এখনো শিউরে উঠি। ১৯৭১ সালে ২৩ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্রবাহী সোয়াত জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসলে আমরা সেই জাহাজ ঘেরাও করি। ২৭ মার্চ নগরীতে হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিই। ৩০ মার্চের পরে পাকিস্তানি সেনা ও বিমান বাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণে চট্টগ্রাম শহরে আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়ি। ফলে সহযোদ্ধাদের নিয়ে চলে আসি সাতকানিয়ায়। কিছু দিনের মধ্যেই বাঁশখালী চলে যাই। সেখানে দেখি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এলাকায় নেই। পরে কোনো উপায়ান্তর না দেখে স্ত্রীকে মির্জাখীল শ্বশুর বাড়িতে রেখে ভারত যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করি’। এমএনএ আবু ছালেহ ভারত যাওয়ার স্মৃতি বর্ণনা করে বলেন, ‘তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি পথে ভারত যাওয়া খুবই কষ্টদায়ক ছিল। বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে যন্ত্রণা থাকলেও মনে ছিল প্রচণ্ড জেদ। যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানিদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। টানা সাতদিন পাহাড়ি পথ পেরিয়ে ভারতের মিজোরাম দারুলছড়ি পৌঁছলাম। সেখানে শরণার্থী ক্যাম্পের পাশে বিএসএফ ক্যাম্প। তখন ক্যাম্পে লাখ লাখ শরণার্থী। শরণার্থী ক্যাম্পের দুই হাজার যুবক নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর তারার নেতৃত্বে গেরিলা ট্রেনিং শুরু হয়। পরবর্তীতে একজন কমান্ডারের নেতৃত্বে গ্রুপ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এসব মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হয়’। তিনি আরো বলেন ‘মে মাসের কলকাতা থিয়েটার রোডে এমএনএ ও এমপিদের ডেকে পাঠান অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার। সেখানে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। আমি সেখান থেকে দেমাগ্রি এসে বিএলএফ কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এবং নিজস্ব মুক্তিযুদ্ধ কমান্ড স্থাপন করি। সেই থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও এককভাবে সমগ্র দক্ষিণ অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ছিল আমার হাতে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারত সরকারের হেলিকপ্টার গানশিপ নিয়ে বান্দরবানে অবতরণ করেই স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলন করি। এরপর সহযোদ্ধারাসহ আমরা কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে এসে ক্যাম্প স্থাপন করি। ডিসেম্বরে দোহাজারি ও পটিয়ার ইন্দ্রপুলে পাক বাহিনীর সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে আমাদের দু’জন সহযোদ্ধা নিহত হন এবং পাক বাহিনীর অনেক সদস্য হতাহত হন। পরে সেখান থেকে আমি মেরিন একাডেমিতে শেল্টার নিই’।
তিনি আরো বলেন, ‘দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ শত্রুমুক্ত হলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার জারি করা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে অফিস আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়’।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নিষ্ঠার সাথে তিনি দায়িত্ব পালন, দেশ পুনর্গঠন, এলাকার উন্নয়ন ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতে পেরে গর্ববোধ করেন।
তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম ১২ আগস্ট ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। বর্তমানে তার তিন মেয়ে রয়েছে। মেয়েরা সবাই বিবাহিত ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। নগরীর মোমিন রোডে জীর্ণ প্রায় পাকা ঘরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। নাছিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে তার নামে বরাদ্দকৃত প্লট তার জীবদ্দশায় তিনি বুঝে পাননি। তিনি বর্তমান সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের যেকোনো ক্ষেত্রে সম্মানিত করা হচ্ছে জানিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রাজনীতি সত্যিকার রাজনীতিবিদের কাছ থেকে দুর্বৃত্ত পুঁজিপতিদের হাতে চলে যাওয়ায় তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, প্রত্যেক বাঙালি যাতে সমান সুযোগ নিয়ে বসবাস করতে পারে, তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের আসল উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
বর্ষীয়ান নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ছালেহ গত ০৩ আগষ্ট বুধবার বিকাল ৪টায় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতাল (সিএসসিআর) এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। নগরীর কদম মোবারক মসজিদ মাঠে বাদে এশা প্রথম জানাজা এবং ৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় সাতকানিয়া মডেল হাইস্কুল মাঠে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। চট্টগ্রাম জেলা থেকে আগত চৌকশ পুলিশ বাহিনির এএসআই মুজিবুরের নেতৃত্বে বিয়গল বাজিয়ে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করে ও ১ মিনিট নীরবতা পালন করার মাধ্যমে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানালো হয়। এসময় তার কফিনে জাতীয় পতাকা ও ফুল দিয়ে গার্ড অব অনার প্রদান করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমা-তুজ-জোহরা ও সাতকানিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার আবু তাহের এলএমজি, সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ তারেক মোহাম্মদ আবদুল হান্নান। তার উভয় জানাজায় দলীয় নেতা কর্মী, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা অংশগ্রহণ করেন।
তাঁর মৃত্যুতে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ. ন. ম. মিনহাজুর রহমান, সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান এম. এ. মোতালেব সিআইপি, সহ-সভাপতি মাস্টার ফরিদুল আলম মোজাম্মল হক, সাতকানিয়া পৌর মেয়র মোহাম্মদ জোবায়ের, চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম- মুক্তিযুদ্ধ ‘৭১ সংগঠনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম মন্টু, মুক্তিযোদ্ধা ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী, সাতকানিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ড এর কমান্ডার আবু তাহের এলএমজিসহ অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী ও রাজনীতিবিদ গভীর শোক এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু
পরবর্তী নিবন্ধহযরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিপীড়িত মানুষের প্রেরণা