দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৭ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

হেলেনের বলার ভঙ্গিতে, সুরে আর স্বরে যে কেউ পরিষ্কার বুঝতে পারবে, এই অভিযোগের ভেতরে থাকা অতিরঞ্জনের ব্যাপারটি। ভাইপোর একগুঁয়ে দুরন্তপনার কারণে তুমুল বিরক্ত হেলেন, কি নিজের করা এই অতিরঞ্জনটুকু বুঝতে পারছে না? নাকি ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ইচ্ছে করেই করছে ও, ঐ অতিরঞ্জন। ঐ বিরক্তির কারণেই কি সে এটাও খেয়াল করছে না যে, এই সমস্ত হোটেলের বাথরুমের জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা এতোটা নিম্নমানের হয় না, যাতে পানি বাথরুম ছেড়ে রুমে ঢুকতে পারে !
ফলে ওর বিরক্তির মিটার দ্রুত নীচে নামানোর লক্ষে ব্যাপারটিকে অতিব গুরুত্বের সাথে নিয়ে চোখ মাথায় তুলে বললাম, বলিস কি? ও তো এখানে এসেছিল তখন বাইরে যাবার জন্য। আমিই তো ঠেলে ঠুলে পাঠালাম ওকে গোসল করতে। এখন বাইরে যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে বুঝি সে এই অবস্থা করেছে ! চল তো, যাই।
রুম ছেড়ে দু ভাইবোন বেরুচ্ছি যখন, তখন পেছন থেকে শোনা গেল লাজুর গলা
‘হেলেন, ঐ রুম থেকে আসার সময় তোমাদের কাপ দুটো নিয়ে এসো। চা বানাচ্ছি আমি, আসো একসাথে খাব চা’।
এ রুমে এসে দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে গলা উঁচু করে বললাম, বাবা তুমি না বাইরে যেতে চেয়েছিলে? এভাবে বাথটাবে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে বাথরুম ভিজিয়ে ফেললে তো পরে তোমাদেরই অসুবিধা হবে। যে কোনো সময় কেউ পিছলে পড়তে পারে। তাতে তো মহা একটা হাঙ্গামা হবে। এটা কি ঠিক হচ্ছে?

বেশ কিছুক্ষণের সুনসান নীরবতার পর জবাব এলো ‘তুমি কি এখনি নিয়ে যাবে? আমরা কি এখনই যাবো’?
না ঠিক এক্ষুণি যাবো না। তোমার মা চা বানাচ্ছেন, ভেবেছিলাম চা খেয়ে সাথে সাথেই যাবো। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে দেরী হবে। তোমার তো গোসলই শেষ হয়নি দেখছি। এরপর তো তোমার রেডি হতেও সময় লাগবে।
‘ঠিক আছে, বাবা তাড়াতাড়ি করছি’। আনন্দিত গলার পুত্রের এই আশ্বাস শুনে ফিরতি হাঁটা ধরলাম ঐ রুমের চা চক্রে যোগ দিতে।
রুমে ফিরে আপাতত আমাদের চারজনের চা চক্র শুরু হতেই, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ালো রাতের খাবার। সবাই দেখছি একমত যে এ হোটেলে ডিনার করা যাবে না, বা করবে না কেউ। কিন্তু কোথায় যে করবে ডিনার তার ব্যাপারে এখনো মনস্থির করতে পারছে না, অতএব বলছেও না পরিষ্কার তা কেউ। অবশ্য বলবেই বা কিভাবে? আশে পাশে কোথায় কোনো খাবারের রেস্টুরেন্ট আছে সেটাই তো আমিও জানি না। শুধু দীপ্র যেহেতু আগেই বলেছিল, রাস্তার ওপাশে একটা নুডুলস রেস্টুরেন্ট আছে আর সে ওটাই খেতে চায়, তাই শুধু ওটার কথাই জানি। আর জানি যে ম্যাক এখান থেকে খুব দূরে নয়। সে যাক এরই মধ্যে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে দিল লাজু, তা হল সে আর আজ বেরুবে না বাইরে এই ঠাণ্ডায়। যা কিছু একটা হোক খেয়ে নেবে সে রাতে, তাতেই নাকি হয়ে যাবে তার ডিনার। নাহ এরকম আধখেঁচড়া পরিকল্পনায় তো চলবে না। দরকার আমার একটা পরিষ্কার প্ল্যান। বহুকাল ধরে সবাই যাকে ঠেস মেরে বা তেরছাভাবে বলে কর্পোরেট, ঐরকম একটা চাকরি করার কারণে, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার প্লানিং বলতে যা বোঝায়, ঢুকে গেছে তা আমার হাড়ে মজ্জায়। তাই এমনকি যে কোনো পারিবারিক ব্যাপারেও চাই আমার পরিষ্কার প্লান বা রূপরেখা। না হয় বড়ই অস্বস্তিতে ভুগি। এছাড়া একেকজন যদি একেক খাবার খেতে চায়, তবে দৌড়াতেও হবে এই শর্মাকেই দিকে দিকে এই হিমরাতে! ফলে এই গণতান্ত্রিক আলোচনাটির গণতন্ত্রে কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়ে, সেটিকে নিজের সুবিধামতো ঘুরিয়ে দেবার জন্য প্রথমেই জানালাম ডিনারে রাস্তার ওপাশের রেস্টুরেন্টে গিয়ে দীপ্রর চায়নিজ নুডুলস খাওয়ার অভিলাষের কথা।
সাথে সাথেই, এক শব্দে না করে দিল এই প্রস্তাব লাজু। প্রথম কথা হল রুমের বাইরে সে যাবেই না, তাই ওখানে যাওয়ার তার প্রশ্নই উঠে না। দ্বিতীয়ত ঐ চায়নিজ নুডুলসে কি না কি মেশানো থাকে তা নিয়ে আছে তার ঘোরতর সন্দেহ। এতে আবারো আলোচনা আমার হাতছাড়া হয়ে গিয়ে ভিন্ন দিকে মোড় যাতে না নেয়, সেজন্য সাথে সাথে দিলাম পাল্টা প্রস্তাব, যে সে ম্যাক বার্গার বা কোন ম্যাক মিল খাবে কি না। তাহলে তো ওটা সহজেই নিয়ে আসতে পারি। ম্যাকের ঠিকানা তো জেনেই গেছি, আর বেশী দূরেও নয় ওটা।
আমাকে তুমুল আশ্বস্ত করে রাজি হয়ে গেল আমার ঘরের তো অবশ্যই, এমনকি জীবনেরও কর্ত্রী। হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল তাতে। আরো আশার কথা এরই মধ্যে অভ্রও নিম্নস্বরে একাত্মতা ঘোষণা করেছে মায়ের সাথে। শুধু হেলেনই এখনো কিছু বলেনি। ওর মুখের চেহারা আর দেহভাষায় বুঝতে পারছি যে, সে এখনো নিশ্চিত নয়। ফলে ফের বললাম, তাহলে চা চক্র এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুল যে, এ দলের দুই সদস্য আজ রাতে খাবে ম্যাক, একজন খাবে নুডুলস, আমি হলাম দুধভাত। মানে এই দুই রকম খাবারের যে কোনো একটাতে ঢুকে পড়বো আমি সুবিধা বুঝে, তাহলে তুই বল হেলেন, কি খাবি তুই ডিনারে?
‘ঠিক আছে আমি তোদের সাথে বেরুই আগে। মানে তুই আর দীপ্র যখন বাইরে যাচ্ছিস আমিও যাবো তোদের সাথে। যদি দেখি ঐ রেস্টুরেন্টের নুডুলস খেতে পারছি বা ওখানে অন্য কিছু আছে খাওয়ার মতো তবে ঐটা খেয়ে নেব। আর না হয় ম্যাকই খাব আমিও’।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রসঙ্গ: চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা
পরবর্তী নিবন্ধযুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু