মোসাদ-নুর সম্পর্কের রহস্য কী?

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১৫ জুলাই, ২০২৩ at ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্টের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের বৈঠকের সংবাদে তার রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদসহ দেশব্যাপী উদ্বেগআশঙ্কার চিত্র অতিশয় দৃশ্যমান। ঐ বৈঠক শেষে নুর মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছে বলে দলের সদস্যদের অভিযোগ। তাদের দাবি; দলের নামে তহবিল এনে সেই টাকা কাতারেই এক প্রবাসীর গাড়ি ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাছাড়াও দলের কয়েক জন নেতা তার বিরুদ্ধে দেশের একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া, বিভিন্ন ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ ও দলের জন্য প্রবাসীদের পাঠানো টাকার হিসাব না দেওয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগ উত্থাপন করে। দলীয় আলোচনা সভায় দলটির আহ্বায়ক ইসরায়েলি মেন্দি এন সাফাদি ও তার বাংলাদেশি বন্ধু শিপন কুমার বসুর সঙ্গে নুরের বৈঠক প্রসঙ্গে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘দুবাইয়ে মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে মিটিং করতে নুর ট্যাক্সি দিয়ে যাননি। তাকে দুবাইয়ে গণপরিষদের নেতারা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছেন। তারাই কনফার্ম করেছে যে এ রকম মিটিং হয়েছে এবং মিটিং শেষে নুর একটি কালো ব্যাগ নিয়ে ফিরেছেন। তবে কালো ব্যাগে কী ছিল, সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমাদের প্রশ্ন হলো, তুমি ইসরায়েলিদের সঙ্গে মিটিং করছ, এটার কারণ কী? কারণটা আমাদের বলো?’

তিনি আরও বলেন, ‘নুর এত গাড়ি কোথায় পায়! এর আগে বলা হয়েছিল কাতারের সভাপতি গাড়ি দিয়েছে। এভাবে চলতে পারে না। কাতারের সভাপতি কেন গাড়ি দেবে? তাহলে কি সংগঠন অন্যদের মতোই হবে। এরপর যে নেতা হবে, সেও এ রকম গাড়ি পাবে। গাড়ি দিলে তাকে কেন সভাপতি বানাতে হবে। সভাপতি বানানোর বিনিময়ে কেন গাড়ি নিতে হবে। নিয়ম অনুসারে বিদেশের কমিটি দুজনের দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা না করে সব কমিটি একাই করছ। লাখ লাখ টাকা আসে, সেই টাকা তুমি কী করো? এক টাকাও তো দলে দাও না।’ দলটির একজন যুগ্ম আহ্বায়ক অভিযোগ করে গণমাধ্যমকে জানান, ‘এর আগেও নুর একটি দেশের তথাকথিত এজেন্ট মাসুদ করিমের থেকে ১ কোটি টাকার চেক ও ৩০ লাখ নগদ টাকা গ্রহণ করেন। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া হওয়ায় ঐ চেক এবং ২০ লাখ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন। একটি গাড়িও নেওয়া হয়েছিল। যার জের ধরে তখন নুরকে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে বহিষ্কার করেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক।’

গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের আলোচনায় কেন্দ্রীয় নেতারা মোসাদের কাছ থেকে নুরের টাকা নেওয়ার বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ২০ জুন গণমাধ্যমে ঐ আলোচনার স্ক্রিনশটে পাওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছে। উক্ত আলোচনায় কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেছেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলের পুঁজি হলো পাবলিক পারসেপশন। মানুষ যদি জানে মোসাদের সঙ্গে আঁতাত আছে, তাহলে পাবলিক আমাদের ছাড়বে না। পরিবারপরিজন নিয়ে থাকা লাগে, সবার সামনে মাথা হেঁট হয়ে যাবে।’ সহকারী আহ্বায়ক লিখেছেন, মোসাদের সঙ্গে এমন আঁতাতের বিষয় জানলে পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু, এলাকাবাসী আমাদের জুতাপেটা করবে। যুগ্ম আহ্বায়ক জানান, ‘মোসাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি আমরা হয়তো সবাই জানতাম। এভাবে দাম্ভিকতা নিয়ে প্রত্যেকে স্বীকার করবে, এই প্রত্যাশা করিনি। খুব কষ্ট লেগেছে। এদের জন্য আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি। আমার মাথা বিক্রি করে কেউ টাকা কামাবে, এটা কীভাবে হয়!’

ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর তিন দেশ কাতার, ভারত ও দুবাইতে গিয়ে মোসাদের সাথে বৈঠক করেছেন বলে দাবি করেন ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ রামাদান। তিনি এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ২২ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের বৈঠক দেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হতে পারে। ইসরায়েলের কাছ থেকে টাকা নেয়া কেউ এ দেশের মানুষের নেতা হতে পারে না। কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ে আমরা বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে আগ্রহী হয়। কয়েকটি ছবি যোগাড় করতে সক্ষম হই। তার সঙ্গে ছিল সাফাদি (মোসাদের এজেন্ট)।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি নুর অস্বীকার করে, তবে সেটি আমার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এটি কি বাংলাদেশ সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য যথেষ্ট হবে? তিনি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে, ঠিক যেভাবে তিনি প্যালেস্টাইনের জন্য করেছেন।’ নুরুল হক নুরের দাবি রাষ্ট্রদূতের এই অভিযোগ ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ঘুষ খেয়ে অসত্য কথা বলেছেন উল্লেখ করে তার অভিযোগের স্বপক্ষে প্রমাণ হাজিরের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। তবে অভিযোগ সম্পর্কে আত্মপক্ষ সমর্থনে নুরুল হক জানায়, প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন নেতাদের অনেকেই তো সাফাদির সঙ্গে দেখা করেছেন, তা নিয়ে তো মিডিয়ায় হইচই নেই, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে এত হইচই হচ্ছে? যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় আমি সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেছি, তাহলে তাতে অসুবিধা কোথায়?

গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুর মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে বরাবর অস্বীকার করে আসলেও, এবার নুরের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি স্বীকার করে চাঞ্চল্যকর তথ্যপ্রমাণ ফাঁস করেছে ইসলাইলের সেই মেন্দি এন সাফাদি। ৪ জুলাই সংবাদ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে ইসরায়েলের নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে নুরুল হক নুরের সাক্ষাতের বিষয়টি সত্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয়ের অধীন ইসরায়েলি করপোরেশনস অথরিটিতে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ‘সাফাদি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোম্যাসি, রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস’ নামে ফেসবুক পেজ থেকে সংগ্রহ করা মুঠোফোনে গত ২৬ জুন এক ক্ষুদে বার্তায় সাফাদি এর স্বীকারোক্তি দেয়। সর্বশেষ ৮ জুলাই দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে সাফাদি নিজেই দাবি করে যে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরের নুরের সঙ্গে তার অন্তত তিন ঘন্টার বৈঠক হয়।

উক্ত সাক্ষাৎকারে সাফাদি জানায়, ‘আমরা দুবাইয়ের সিটি মলে স্টারবাকস কফিশপে দেখা করেছিলাম। তখন আনুমানিক বিকেল ৩টা, ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ। ৩ ঘন্টার বৈঠক শেষে আমরা আবারও সাক্ষাতের জন্য একমত হই এবং ক্যাম্পেইনের পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনার কথা ছিল। আগামী নির্বাচনে জিততে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য নুর আমার সাহায্য চায়। আমার আদর্শের সঙ্গে তার আদর্শের মিল রয়েছে। সে বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের দ্বার খুলতে চায়।’ সাফাদি আরও জানায়, ‘বাংলাদেশের মানুষ ফিলিস্তিনের প্রচারণায় বিশ্বাস করে এবং তারা ইসরায়েলের কথা শুনতে চায় না। নুর বোঝে ফিলিস্তিনের সংগঠনগুলো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে ভূমি দখল করতে চায়।’ বিজ্ঞজনদের মতে, ‘এত কিছু করার পরেও কেউ যদি মিথ্যাচার করে বেড়ায়, তাহলে বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে তার রাজনীতি করার কোনো ভিত্তি নেই। তার কোনো নৈতিকতা নেই। তাকে কখনো বাংলাদেশের তরুণরা গ্রহণ করবে না। দলের নামে টাকা উঠিয়ে লোভ সামলাতে না পেরে যে টাকা আত্মসাৎ করে, তাহলে সে কীভাবে নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখে।’

এছাড়াও ঐ সাক্ষাৎকারে সাফাদি কয়েক মাস আগে বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলার ব্যাপারেও স্বীকার করেছে। যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে সাফাদি বলেছিল, ‘শুভ সকাল মি. রহমান। আমি মেন্দি। আপনার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি মনে করি, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিয়ে আমরা কাজ করছি। যেসব তথ্য আমি চেয়েছি এবং যেগুলো পেয়েছি; সব বিষয়েই আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমাদের মিশন সম্পর্কে কথা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমার পিছনে যে টিম রয়েছে তারা আমাদের মিশন সফল করার জন্য কাজ করছে। এ টিম বাংলাদেশের মানুষের মুক্ত জীবন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করবে। এ টিম আপনাকে বাংলাদেশের নেতা হিসেবেও প্রত্যাবর্তন করাবে। ধন্যবাদ, আশা করি, আপনার সঙ্গে খুব শিগগির লন্ডনে দেখা হবে।’

৯ জানুয়ারি ২০২৩ মহান জাতীয় সংসদে ভিপি নুরের বৈঠকের উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের দাবি উঠেছে। তদন্ত সাপেক্ষে সংসদে ৩০০ বিধিতে সম্মানিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিও দাবি করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে নুরুল হক নুরের এসব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ঢাকার শাহবাগ থানাসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন থানায় মামলার আবেদন করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শাহবাগ থানায় অভিযোগ করেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি। উক্ত অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ গণ অধিকার পরিষদ নামক তথাকথিত রাজনৈতিক দলের সদস্যসচিব নুরুল হক নুর ওমরাহ হজ করার কথা বলে বিদেশে গেছেন। এই সফরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অস্বীকৃত ইসরায়েল রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার উৎখাতে দেশরাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে নুরুল হকের ছবি ও স্বীকারোক্তিমূলক কথোপকথন এরই মধ্যে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নুরুল হক বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সরকার ও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে হীন চক্রান্তে লিপ্ত।’

চলতি মাসের ৯ তারিখ সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীও ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৯৬ ধারার বিধান মোতাবেক গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা রুজুর অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশীয় চক্রান্তষড়যন্ত্রের সাথে আন্তর্জাতিক অপশক্তি নিগূঢ়ভাবে সম্পৃক্ত। আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানামুখী বৈশ্বিক অপচেষ্টা কতটুকু তৎপর তা সহজেই অনুমেয়। দেশের আপামর জনগণের দেশপ্রেমের কঠিন ঐক্যবদ্ধতায় সকল অন্ধকারের শক্তির কদর্য কর্মযজ্ঞ পরাভূত হবেই নিঃসন্দেহে তা দাবি করা যায়।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধকাগজের বৃষ্টি