মেয়েটির ঘরে ফেরা

কাজী লাবণ্য | শুক্রবার , ১৫ মার্চ, ২০২৪ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

গাড়ির নাকটা যখন শ্বাসরূদ্ধকর জ্যামের কবল থেকে কোনোরকমে মোচড় মেড়ে মিরপুর রোড ছেড়ে শাখা রোডে ঢোকে তখন নিজের অজান্তে বুকের ভারী বাতাস বেরিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে হালকা করে দেয়। সূর্য আড়াল হয়েছে অনেক আগে, নিয়ন আলোর বন্যায় কৃস্টাল ক্লিয়ার দেখা যায় কসমোপলিটন শহরের চেহারা, অগণন যান, অকল্পনীয় ব্যস্ততা, ঊর্ধশ্বাসে ছুটন্ত বাসিন্দা।

জ্যাম থেকে মুক্তি পেয়ে গাড়ির চাকা এবার সাবলীলভাবে ঘুরতে থাকে। কিছু সময় পরে আবার গাড়ি মোড় নেয় একেবারে মেয়েটির নিজ এলাকার পথে। এবারে অজান্তে কেমন একটা খুশির বাতাস ছড়িয়ে পড়ে তার মুখ থেকে মনে, মন থেকে মস্তিষ্কে। প্রজাপতির ডানায় সে ডানের জানালায় তাকায়, ওই যে ভবন, ওই দেয়াল, এই রেলিং, দোকানপাট, এই পথ, এমনকি এই গাছপালা সবই তার চেনা। বামের জানালায় তাকায় ওই যে দেয়াল লিখন, ‘কারোর আসার কথা ছিলো না, কেউ আসেনি তবু কেন মন খারাপ হয়’এটা পড়ে মেয়ে যেন থমকে যায়, ক্ষণিক ভাবে, আবার তাকায় ওইযে ছাদবাগান, পুলিশফাঁড়ি, ফুটপাত, হকার সমস্ত কিছুই তার আপন, বড্ড আপন। ওর ভালো লাগে, কী যে ভালো লাগে! অথচ প্রতিদিন সে এপথেই বাড়ি ফেরে। আর এপথের সব্বাই একে একে ফিসফিস করে, ‘ফিরলে’! ‘মেয়ে তুমি ফিরলে’!

চলতে চলতে গাড়ি এবার কলসি কাঁখের বধুটির বাঁকা কোমরের খাঁজের মতো বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ে চিরচেনা পথের খাঁজে। এখানে ডিভাইডারের উপরের শিমুল গাছটি পাতা নাড়িয়ে আদুরে কন্ঠে বলে, ‘এলে’? শিমুলের কথা শেষ না হতেই আরেকটু এগুলে ডিভাইডারের মাথায় সোনালু বা অমলতাস কিংবা গোল্ডেন শাওয়ার তার ইয়ালো ঝুমকো দুলিয়ে একই প্রশ্ন করে ‘ফিরলে’? মেয়ের সারাদিনের ক্লান্তি, শ্রান্তি, উড়ে যায়। সকলের প্রশ্নের উত্তরে সে হাসিমুখে মাথা দোলায়।

এই পথ যেন ওর হাতের তালুর মতো চেনা। আদতে হাতের তালু কি মানুষের খুব চেনা? মানুষ কতবার তালু দেখে যে সে চিনবে, তার চেয়ে শতগুণ বেশীবার ও এই পথ দেখে। এর প্রতিটি ইঞ্চি ইঞ্চি জায়গা ওর চেনা। এমনকী এপার্টমেন্টগুলোর আলিসান গেটে অতি নিরীহ টাইপের পান খাওয়া সিকিউরিটিদের তোবড়ানো মুখগুলোও সে চেনে। যেখানে একটি শিভাস রিগ্যালের জন্য গুনতে হয় তিন আটে চব্বিশ, আর এই মানুষগুলো এক আটেই জীবনের ধারাপাত কোন এক ম্যাজিকে মিলিয়ে নিয়ে পান জর্দার ঢেঁকুর তোলে। নাগরিক সভ্যতার রাজধানীতে পানের পিক গিলতে গিলতে নিঃশব্দ শ্বাস ফেলে, নিজ নিজ ভাষায় নিজ উচ্চারণে বলে ‘আইলেন বাহে! আপ্নে আইলেন’! মেয়ে স্মিত হাসে।

শীত শেষ হয়েছে, বইমেলাও। পত্রহীন বৃক্ষশাখায় সবুজ সবুজ কুশি আর আমগাছে বোল এসেছে থোকা থোকা। ধুলোয় ধুলোয় ধূলিময় শহর।

লন্ড্রি পেরিয়ে, কফির দোকান ছাড়িয়ে, ফলের দোকান পেছনে ফেলে গড়াতে গড়াতে চার চাকা এবারে চলে আসে মসজিদের সামনে। আচ্ছা মসজিদ কী আসলেই আল্লাহর ঘর? এমন ঝকঝকে টাইলস, চোখ ধাঁধানো পাথর, ঝিলিমিলি আয়না বসানো ঘরেই আল্লাহ থাকেন? মসজিদ ভবনের আসমানজুড়ে ফেরেশতারা আনাগোনা করে, তারা যেমন বিস্ময় মানে পৃথিবীর মানুষের ঔদার্যে, আবার ব্যথিত হয় সেই মানুষেরই ক্রুরতায়, তারাও নিশ্চিন্ত হয়, ‘যাক মেয়েটা নিরাপদে ফিরে এলো’!

এরপর বৌছি খেলার বাকি পথটুকু টপকে সাঁই করে চলে আসে আসমানী রঙ বিশাল গেটটার সামনে। সারাটা দিনের শত তিতা, শত অবসাদ, ধোঁয়া, জমাট মলিনতার কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না, বরং হাস্নাহেনা বা কামিনীর সৌরভের মতো ফুরফুরে মেয়ে গলা বাড়িয়ে প্রহরীর গেট খোলা দেখে। শীর্ণ হাত দু’টি দিয়ে ভারি গেটটি ঠেলে ঠেলে সরালে সে অন্দরে প্রবেশ করে।

নিজেকে কার্পাস তুলোর মতো হালকা মনে হয়। মনে হয় এইতো কয়েক গজ এগিয়ে তিনফুট বাই ছয় ফিটের স্টেইনলেস স্টিলের বক্সটির ভেতর ঢুকে সুইচ টিপে দিলেই লহমায় ওকে তুলে নিয়ে যাবে ওর পরম কাঙ্ক্ষিত দরজার সামনে। সেখানে দরজাও স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলবে, ‘অবশেষে ফিরলে’!

আঙুলের স্পর্শ পাওয়ার আগে কলিং বেলটাও বলে ওঠে ‘কন্যা তুমি এলে’! ভেতরে সেটি টুংটাং ছন্দ তুললে একটি রিনরিনে খুশি খুশি জিজ্ঞাসা ভেসে আসে ‘আম্মু আসছ?’

অতঃপর খুলে যায় সিসিমপুরের দরজা। এইই তার ঠিকানা। ঠিকানা! সত্যিই এটা ওর ঠিকানা! তাই যদি হয় গানের কলি মনে, মাথায় গুনগুন করে কেন, ‘পরের জায়গা পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।’

ভেতরে এসে অতি দ্রুত জুতো জোড়া র‌্যাকে রেখে ঘুমঘরে যায়। ফ্রেশ হয়, ঘরের আরামদায়ক নরম কাপড়ে নিজেকে আবৃত করে ভেজা ভেজা হাত মুখ নিয়ে সোজা চলে যায় ড্রয়িংরুমের সোফায়। এর মধ্যেই ওর স্বর্ণরঙ থালাটায় খুব সামান্য নৈশাহার সাজিয়ে দিয়েছে মায়াবতী মেয়েটি। টার্কিস সিরিয়াল ‘বাহার’ এ চোখ রেখে সে থালা হাতে নেয়। হাতে নেওয়া মাত্র কি যে হয়, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে ক’ফোটা নোনতা জল, মনে হয় এই যে নষ্ট শহরের তুমুল মৃত্যুফাঁদ পেরিয়ে ও ঘরে ফেরে, কেউ একবার উদ্বেগ প্রকাশ করে না, ‘তুমি কদ্দুর’?

ব্যাগের ভেতর চুপ করে থাকা ফোনের রিংটোন শোনার জন্য সে সারাটা পথ অপেক্ষা করে, জ্যাম ঠেলে ঠেলে অপেক্ষা করে, কার কাছে ফিরব? কেন ফিরব? কোথায় ফিরব? ভাবতে ভাবতে অপেক্ষা করে, ফিরতি পথে হদয় নিংড়ানো ভালোবাসাময় প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অপেক্ষা করে কিন্তু যান্ত্রিক মাধ্যমে কোনো কন্ঠের ব্যাকুলতা শোনা যায় না ‘তুমি কি ফিরছ’ ‘আজ বুঝি খুব জ্যাম’!

শূন্য থালা সিংকে রেখে, জমে ওঠা বিষাদের নোনতা মেঘ গাঢ় হবার আগেই হাত ধোয়া জলের সাথে বিষাদকে সুয়ারেজ লাইনে পাঠিয়ে দেয়। ঝুলন্ত টাওয়েলে হাত মুছে নিজ ঘরের দরজার ভারি পর্দার সামনে দাঁড়ায়, ভেতরে ওর জন্য অপেক্ষমাণ রাশি রাশি বই, ল্যাপটপের উজ্জ্বল স্ক্রিন, অত্যাধুনিক ফোন, কবিতা, গান, সুর, নিশ্চিত ঘুমের আরামদায়ক পরিপাটি পালঙ্ক

তবে তার আগে,

হ্যাঁ, তার আগে নিত্যকার দায়িত্ব পালন করতে পাশের ঘরের দরজায় মৃদু টোকা দেয়। কেয়ারটেকার ছেলেটা দরজা খুলে দিলে সেখানে সহস্র বছর ধরে শুয়ে থাকা দৈব দুর্ঘটনার শিকার এক সময়ের ক্রুর এবং দোর্দন্ড প্রতাপশালী, বর্তমানে শারীরিক মানসিক সবদিক থেকে বৈকল্য স্বামীর খোঁজ নিতে যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘পবিত্র কোরআনের বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি’ গ্রন্থ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধমোছাদ্দেক হায়দার চৌধুরী