মুক্তিযুদ্ধ ও বিদেশি সংবাদপত্র

রেজাউল করিম | বুধবার , ২১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সাল, বাঙালি জাতীয় জীবনের জন্য অবিস্মরণীয় অধ্যায়। লাখ লাখ মানুষের গগনবিদারী স্লোগানের উদ্দামতায় বসন্তের মাতাল হাওয়ায় সেদিন পত পত করে উড়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা। ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা -‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্‌। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সেদিন শুধু বাঙালি নয়, অনেক বিদেশি ও গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। মেডিসন স্কয়ারে জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাংলাদেশ কনসার্ট আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করে, তেমনি বিদেশি গণমাধ্যম অন্যতম ভূমিকা রাখে।

বাংলার মাটিতে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তার ছিল আন্তর্জাতিক গুরুত্ব, বিশ্বের দুই পরাশক্তি ছিল বিবদমান দুই পক্ষে। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে এ শুধু তৃতীয় দুনিয়ার কোনো আঞ্চলিক সংঘাত ছিল না, ছিল প্রথম দুনিয়ার দেশের জন্যও প্রভাবসঞ্চারী। পাশাপাশি এটিও লক্ষণীয়, ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তখন বিদেশি সংবাদদাতাদের উপস্থিতি ও আনাগোনা ছিল ব্যাপক। যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহেও তাঁরা যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ব্যাংকক, নমপেন, সায়গন, হংকংয়ে তখন গড়ে উঠেছিল এফসিসি বা ফরেন করেসপনডেন্ট ক্লাব, যা ছিল শহরের এলিটদের জন্যও এক আকর্ষণীয় মিলনস্থল।

সেই সঙ্গে সাংবাদিকরা তো ছিলেনই, যাঁদের বেশির ভাগ তখন স্বল্প পরিচিত। তাঁদের অনেকে পরবর্তী সময় পুলিৎজার পুরস্কারসহ অনেক ধরনের পুরস্কার পেয়েছেন, সাংবাদিকতার আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে সিডনি শনবার্গ, ম্যালকম ব্রাউন, মার্ক টালিসহ অনেকে। এ ক্ষেত্রে অকালে ঝরে পড়া তরুণ আলোকচিত্র সাংবাদিক মিশেল লরেন্টসের কথাও স্মরণ করতে হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী সব বিদেশি সাংবাদিককে অবরোধ করে পরদিন বিমানে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। হত্যালীলার সংবাদ যেন বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সেটাই ছিল তাদের লক্ষ্য। এটা তো সর্বজনবিদিত, কিভাবে ডেইলি টেলিগ্রাফের সাইমন ড্রিং নজর এড়িয়ে থেকে গিয়েছিলেন ঢাকায় এবং পরে প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদভাষ্য তিনিই প্রকাশ করেন, ট্যাংক নামিয়ে পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছে মানুষদের। এর সঙ্গে ঢাকার রাজপথে পড়ে থাকা রক্তাক্ত লাশের ছবিও ছাপা হয়েছিল, যা তুলেছিলেন এএফপির তরুণ ফটোগ্রাফার মিশেল।

সিডনি শনবার্গ, বহিষ্কৃত হলেও বারবার ফিরে এসেছেন সীমান্ত এলাকায়, কখনো প্রবেশ করেছেন মুক্তাঞ্চলে, বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন অনেক রথী-মহারথীর সঙ্গে। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ট্যাংকে সওয়ার হয়ে প্রবেশ করেছেন ঢাকায়, উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে। ২৫ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর দুয়েরই তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, মাঝখানে ৯ মাসজুড়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বহু রিপোর্ট। পরে সিডনি শনবার্গ খ্যাতি অর্জন করেন কম্বোডিয়ার গণহত্যার সংবাদভাষ্য প্রদান করে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা ঘিরে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য কিলিং ফিল্ডস’ জিতে নেয় কয়েকটি অস্কার পুরস্কার।

৭ মার্চের ভাষণের পর বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে নিউজউইকের বঙ আইটেম ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ এমনই এক উদাহরণ, চলমান ঘটনার ভাষ্য যখন তাৎপর্যে ছাপিয়ে যায় সমসাময়িকতা। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের দুই পৃষ্ঠাজুড়ে রিপোর্টের শিরোনাম দিয়েছিল সানডে টাইমস ‘জেনোসাইড’, মোটা হরফে শুধু ওইটুকুই। কিন্তু সেই রিপোর্ট ও হেডিং তো এক ইতিহাস হয়ে উঠেছে।

সামরিক জান্তার নজরদারি এড়িয়ে কাজ করেছেন সাংবাদিকরা। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ বেগ পেতে হয়নি, দেশের মানুষের সহায়তা এ ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর হয়েছিল। এমনই রিপোর্ট করেছেন মহিলা সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ, টাইমের ড্যান কগিন এবং আরো অনেকে। মুক্তিযুদ্ধকালীন রিপোর্টিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে গ্রন্থ রচনা করেছেন অনেকে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ডেভিড লোশাক, জন পিলজার, ম্যালকম ব্রাউন প্রমুখ।

জন পিলজারের ‘হিরোজ’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ভিয়েতনাম, ফিলিস্তিন, আফ্রিকা, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশসহ নানা স্থানে নানা সংকটের রিপোর্টিংয়ে অর্জিত তাঁর সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ লন্ডনের ‘দ্য অবজারভার’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। টাইম সাময়িকী ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল নিউজউইক ‘একটি আদর্শের মৃত্যু’ শিরোনামে একটি নিউজ ছাপে। লন্ডনের দ্য অবজারভার ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল ‘স্বপ্নভঙ্গের পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক নিউজ প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন দ্য সানডে টাইমস ‘গণহত্যা’ নামে ১৪ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন ছাপে যার লেখক ছিলেন সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ১৯৭১ সালের ২০ জুন দ্য সানডে টাইমস ‘পাকিস্তানে সংঘবদ্ধ নির্যাতন’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। টরন্টো টেলিগ্রাম ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এক সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে ৩০ লাখ টন খাদ্য ও ভারতে ৮০ লাখ শরণার্থীর খাদ্যের ব্যবস্থা করতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে।

নয়াদিল্লি থেকে ‘দ্য উইকলি নিউ এজ’ পত্রিকা ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘বিজয় নিশ্চিত’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর টাইম সাময়িকী ‘যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপে। এতে তারা লেখে, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’। তা ছাড়া আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পঙ্কজ সাহা, উপেন তরফদার, এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’, স্টেটম্যান পত্রিকার মানস ঘোষ প্রমুখ। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে এরকম অনেক বিদেশি গণমাধ্যম ও সাংবাদিক আমাদের পরম বন্ধু হিসেবে কাজ করেছেন। তাদের জানাই সংগ্রামী অভিবাদন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে করোনার চতুর্থ ডোজ টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু
পরবর্তী নিবন্ধশোভনদন্ডী ডিগ্রি কলেজে আলোচনা সভা