পাহাড়ে কমছে ঔষধি বৃক্ষ

প্রাকৃতিক বনকে বাগান হিসেবে গড়ে তোলার ফলে এই অবস্থা সাময়িক লাভ, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি

প্রান্ত রনি, রাঙামাটি | বুধবার , ৮ মে, ২০২৪ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

সারা দেশে যেটুকু প্রাকৃতিক বন রয়েছে; তার বিশাল অংশ দেশের পার্বত্য অঞ্চলে। এক সময়কার ঘন সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোতেও বৃক্ষ নিধনের ফলে এখন নানান প্রজাতির বনজ বৃক্ষ কমে এসেছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পূর্বের দিনে বনজ বাগান গড়ে উঠলেও এখন পাহাড়ের মানুষের আগ্রহ ফলদ বাগানে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কারণে বনজ ছেড়ে ফলদ বাগানে ঝুঁকছেন পাহাড়ের মানুষ।

প্রকৃতি গবেষকরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে লতা, গুল্ম, বিরুৎ প্রজাতিসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ এখনো টিকে আছে। তবে ক্রমশই কমছে গাছের পরিমাণ। ঘন বনকে বাগান হিসেবে গড়ে তোলার ফলে বনজ গাছের মধ্যে ঔষধি বৃক্ষও কমে যাচ্ছে। বাড়ির পাশে পাহাড়িরা আদিকাল থেকে বাগান করলেও এখন সেখানে বিভিন্ন মৌসুমে ফলে আবাদ বেড়েছে। এতে করে সাময়িকভাবে আর্থিক সচ্ছলতা দেখা দিলেও দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষতি হচ্ছে পাহাড়ে। বনজ গাছ কমে যাওয়ার ফলে পাহাড়ের মাটির পানি ধারণ সক্ষমতা কমে গেছে এবং সবুজ কমে যাচ্ছে ক্রমাগত।

স্থানীয়রা জানায়, আদিকাল থেকে পাহাড়ের চিকিৎসা পদ্ধতির অন্যতম উপায় ছিল কবিরাজি চিকিৎসা। পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষরা অসুস্থ হলে স্থানীয় বৈদ্যকবিরাজের কাছে থেকে চিকিৎসা নিতেন। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানের ফলে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রচারপ্রসার বাড়ায় কবিরাজি চিকিৎসা অনেকটা কমে এসেছে। যে কারণে স্থানীয়রা ঔষধি বৃক্ষ ও ভেজষ উদ্ভিদ সংরক্ষণের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া অর্থনৈতিকভাবে ফল বাগান গড়ে ওঠা এবং বন কমে যাওয়াও ঔষধি বৃক্ষ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েকশ প্রজাতির ঔষধি বৃক্ষ ও লতাগুল্মের উপস্থিতি দেখা যেত। যেগুলোর অনেকগুলো স্থানীয়রা ভালোভাবে চিনতেনও না। প্রায় বাড়ির আঙিনায় দেখা যেত হরিতকি, বয়রা, আমলকি, অর্জুন, ঔষধিসহ বিভিন্ন গাছ। বর্তমানে সেটি তেমন একটা দেখা যায় না। এর বিপরীতে বাড়ির পাশে আম বাগান, লিচু বাগান, ড্রাগন বাগানসহ ফলের বাড়ছে। পার্বত্য এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডেল উদ্যোগে মিশ্র ফল চাষ প্রকল্প ও কৃষি বিভাগের মৌসুমি ফল বাগান তৈরিতে উদ্বুদ্ধকরণের ফলে পাহাড়ে আশঙ্কাজনকহারে ফলদ বাগান গড়ে উঠেছে।

পাহাড়ের এখনো যেসব ঔষধি গাছ পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে তুলসি, ঢোল কলমি, জারুল, চন্দ্রমল্লিকা, দেশী গাব, গন্ধভাদালি লতা, এলাচ, থানকুনি, ইসবগুল, ঘৃতকুমারি, অর্জুন, নিসিন্দা, নিম, বাসক, পুদিনা, হরিতকি, আমলকি ও বয়রা অন্যতম। এসব বেশিরভাগ পাওয়া যাচ্ছে পাবলাখালী গেইম সেঞ্চুয়ারি, কাচালং সংরক্ষিত বন, রাইংক্ষ্যং সংরক্ষিত বন, সাঙ্‌গু সংরক্ষিত বনসহ স্থানীয়দের উদ্যোগে ভিলেজ কমন ফরেস্টে (ভিসিএফ)

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের কনসালটেন্ট (গভর্ন্যান্স) ও রাঙামাটির প্রবীণ বাসিন্দা অরুনেন্দু ত্রিপুরা আজাদীকে বলেন, পাহাড়ের কবিরাজির চিকিৎসার ব্যবহার কমায় ঔষধি বৃক্ষ সংরক্ষণ ও কমে গেছে এটা সত্য। কিন্তু ঔষধি বৃক্ষ ও বৃক্ষের লতাপাতা, নির্যাস থেকে ওষুধ তৈরির উপাদান যদি তৈরি করা যায়; সেক্ষেত্রে পাহাড়ের ঔষধি বৃক্ষ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ঔষধি বৃক্ষ উপযোগিতা হারায়নি। এ ধরনের বৃক্ষ সাধারণত স্যাঁতস্যাঁতে ও শীতল পরিবেশে ঔষধিগুণ নিয়ে বেড়ে ওঠে। দেখা গেছে উপযোগী পরিবেশ না পেলে এ ধরনের বৃক্ষ মাটি ও পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকতে পারে না। তাই এটির যথাযথ ব্যবহারে গবেষণারও প্রয়োজন রয়েছে।

প্রকৃতি বিষয়ক লেখক ও গবেষক সৌরভ মাহমুদও মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে একচ্ছত্র ফল বাগান গড়ে উঠার কারণে প্রাকৃতিক বন কমে এসেছে। এছাড়া কাঠ উৎপাদন ও বাণিজ্যের উদ্দেশে সেগুনসহ পরিবেশ অনুপযোগী গাছ লাগানোর ফলে পাহাড়ের প্রাকৃতিক বনগুলো বাগান হয়ে উঠেছে।

রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নিখিল চাকমা আজাদীকে বলেন, পাহাড়ে দিনদিন ঔষধি বৃক্ষ কমছে। প্রাকৃতিক বন কমে গেলে এ ধরণের বৃক্ষ কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। পাহাড়ের বনগুলোকে সমৃদ্ধ রাখা জরুরি। সেখানে উল্টো মানুষ বন ছেড়ে মৌসুমি ফল বাগানের দিকে ঝুঁকছেন। এটি দীর্ঘস্থায়ীভাবে ভালো লক্ষণ নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঁচানো গেল না গুলিবিদ্ধ শিশু রোমিওকে
পরবর্তী নিবন্ধ৬০০ ‘সোনার কয়েন’ কেনার পর যা হলো