মিরাজের ব্যাটে রূপকথা সিরিজ বাংলাদেশের

ভারতকে হারাল টানা দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে

ক্রীড়া প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

নানা নাটক, উত্থান আর পতন। দিনের শুরুতে বাংলাদেশ খাদের কিনারায়। প্রথম সেশন শেষে পাহাড়ের চূড়ায়। দ্বিতীয় সেশনের শুরুতে ভারত ব্যাকফুটে। আবার একেবারে শেষ বেলায় ভারত চলে আসে লাইম লাইটে। আর শেষ পর্যন্ত বিজয়ের হাসি বাংলাদেশের। তেমনই নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের টানা দ্বিতীয় ম্যাচ জিতে নিল বাংলাদেশ। আর তাতেই নিশ্চিত হয়ে গেল সিরিজও। দীর্ঘ ৭ বছর পর আবারো ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে সবশেষ নিজেদের মাটিতে ভারতকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেবার ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। এবার এরই মধ্যে ২-০ নিশ্চিত করেছে টাইগাররা। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো ম্যাচটি শেষ হয় চরম রোমাঞ্চ জাগিয়ে। আর সে রোমাঞ্চকর ম্যাচে বাংলাদেশের জয় ৫ রানে। প্রথম ম্যাচেও খাদের কিনারা থেকে দলকে টেনে নিয়ে জয় উপহার দিয়েছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ।

গতকালও এই অল রাউন্ডার টানলেন দলকে। তুলে নিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। গড়লেন নানা রেকর্ড। অপরদিকে হাতের আঙ্গুলে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চলে যাওয়া যে রোহিত শর্মার মাঠে ফেরারই কথা ছিল না সেই রোহিত শর্মা এসে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের বুকে। যদিও শেষ পর্যন্ত মোস্তাফিজের বীরত্বে শেষ হাসিটা বাংলাদেশেরই। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা মোস্তাফিজের কাটারে পুড়েছিল ভারত।

এবারেও শেষ ওভারের সব নাটক থামিয়ে দিলেন সেই মোস্তাফিজই। যদিও ম্যাচের সেরা নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। ব্যাট হাতে যেমন কচু কাটা করেছেন তিনি ভারতীয় বোলারদের তেমনি বল হাতেও ছিলেন দুরন্ত দুর্বার। সব মিলিয়ে ঐতিহাসিক এক ক্ষণ উপহার দিলেন মিরাজ বাংলাদেশের ক্রিকেটে। উড়তে থাকা বিশ্বের সেরা দল ভারতকে মাটিতে নামিয়ে বাংলাদেশ জিতে নিল ।

ঐতিহাসিক ওয়ানডে সিরিজ। এখন টাইগারদের সামনে লক্ষ্য প্রথমবারের মতো ভারতকে হোয়াইট ওয়াশ করা। সিরিজ জয়ের সুখ স্মৃতি নিয়ে চট্টগ্রামে আসা টাইগাররা অপেক্ষায় সেই মহেন্দ্রক্ষণের।

মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে টসে জিতে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ শুরু থেকেই বিপর্যয়ে। অধিনায়কের সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণ করতে পারেনি দলের টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা। দলের খাতায় ১১ রান যোগ করতেই ফিরেন ওপেনার এনামুল হক বিজয়। আগের ম্যাচে রানের খাতা খুলতে না পারা এনামুল ফিরেছেন ১১ রান করেই। অথচ দ্বিতীয় ওভারে মোহাম্মদ সিরাজকে দারুণ দুটি চার মারেন এনামুল। এক বল পরই ফিরে যান স্লিপে রোহিতের হাতে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান তিনি। তবে জীবন কাজে লাগাতে পারেননি। এলবিডব্লিউ হয়ে যান পরের বলেই। শুরু থেকেই ভারতীয় পেসারদের স্বস্তিতে খেলতে পারছিলেন না লিটন ও শান্ত। সিরাজের ফুল লেংথ বলের লাইন মিস করে বোল্ড হন লিটন। আউট হন ২৩ বলে ৭ রান করে।

একইভাবে উমরান মালিকের ১৫১ কিলোমিটার গতির ডেলিভারি এলোমেলো করে দেয় শান্তর স্টাম্প। ৩৫ বলে ২১ রান করেন শান্ত। ভারতীয় পেসারদের স্বস্তিতে খেলতে পারেননি অভিজ্ঞ সাকিব আল হাসানও। অবশ্য সাকিবের হন্তারক স্পিনার ওয়াশিংটন সুন্দর। ২০ বলে ৮ রান করা সাকিবকে ফেরানোর পর তিনি পরের ওভারে পরপর দুই বলে বিদায় করেন মুশফিকুর রহিম ও আফিফ হোসেনকেও। মুশফিক ১২ রান করলেও আফিফ পারেননি রানের খাতা খুলতে। ম্যাচের তখন ১৯ ওভার মাত্র। বাংলাদেশের খাতায় জমা পড়েছে ৬৯ রান। উইকেট নেই ৬টি। মাহমুদউল্লাহ ও মিরাজের লড়াই শুরু সেখান থেকে। উইকেটে যাওয়ার পরপরই দারুণ দুটি চারে দুজন যেন নিজেদের উইকেটের সাথে মানিয়ে নেন। আগের ম্যাচে ব্যাট হাতে জয়ের নায়ক মিরাজ শুরু থেকেই ছিলেন সাবলিল।

আর মাহমুদউল্লাহ যেন তার অভিজ্ঞতাটাকে কাজে লাগাচ্ছিল। এ দুজনের কার্যকর একটি জুটি গড়ে ওঠে আস্তে আস্তে। দাঁতে দাঁত চেপে, মাটি কামড়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে দুজন মিলে দলকে নিয়ে যান রানের পাহাড়ে। ধৈর্য্যের চরম পারাকাস্টা দেখিয়ে দুজন টানলেন দলকে। ১০, ২০, ৫০ করে জুটিটাকে নিয়ে গেলেন ১৪৮ রানে। ভারতের বিপক্ষে যে কোনো উইকেটে যা বাংলাদেশের সেরা জুটি। দলকে ২১৭ রানে পৌঁছে দিয়ে মাহমুদউল্লাহ ফিরলেন ৭৭ রান করে। উমরান মালিকের বলে কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে রাহুলের হাতে ক্যাচ দেন মাহমুদউল্লাহ। তার ৯৬ বলের ইনিংসে ছিল ৭টি চারের মার। এরপর দলকে আরো টেনেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ।

দলকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করার পাশাপাশি শেষ সময়ে দ্রুত রানের দাবিও মেটান তিনি চোখ ধাঁধানো সব শটে। ইনিংসের শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে শতরান পূরণ করেন মিরাজ মাত্র ৮৩ বলে। শেষ পর্যন্ত ১০০ রানে অপরাজিত থাকেন মিরাজ। ৮ টি চারের পাশাপাশি ৪টি ছক্কা মেরেছেন তিনি। আট নম্বরে নেমে ওয়ানডে ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় সেঞ্চুরি এটি। আগের সেঞ্চুরি করেন আয়ারল্যান্ডের সিমি সিং। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এই আইরিশ অলরাউন্ডার খেলেন ৯১ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস। আট নম্বরে নেমে বাংলাদেশের হয়ে আগের সর্বোচ্চ ইনিংসটিও ছিল মিরাজেরই।

গত ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর অপরাজিত ৮১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। আট নম্বরে নেমে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি (৩টি) পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার রেকর্ডও এখন মিরাজের। ১১ বলে ১৮ রান করে অপরাজিত থাকেন নাসুম আহমেদ। দুজনের জুটিতে ৫৪ রান আসে মাত্র ৩.৫ ওভারে। শেষ ১০ ওভারে আসে ১০২ রান। আর তাতইে খাদের কিনারা থেকে বাংলাদেশের স্কোর গিয়ে দাঁড়ায় ২৭১ রানে। ভারতের বিপক্ষে সেরা বোলার ওয়াশিংটন সুন্দর। ১০ ওভার বল করে ৩৭ রান দিয়ে ৩টি উইকেট নিয়েছেন তিনি।

২৭২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শিখর ধাওয়ানকে নিয়ে ইনিংস শুরু করতে নামেন বিরাট কোহলি। দ্বিতীয় ওভারেই এবাদত হোসেনের আঘাত। কোহলির স্টাম্প এলোমেলো করে দিলেন এবাদত। পরের ওভারে শিখর ধাওয়ানকে বিদায় করেন মোস্তাফিজ। ১৩ রানে নেই ভারতের দুই ওপেনার। ওয়াশিংটন সুন্দর এবং কে এল রাহুলকেও দাঁড়াতে দেয়নি সাকিব এবং মিরাজ। এ দুজন ফিরেছেন যথাক্রমে ১১ এবং ১৪ রানে। ৬৫ রানে ৪ উইকেট নেই ভারতের।

এরপর দলের হাল ধরেন শ্রেয়াস আইয়ার এবং আঙার প্যাটেল। ১০৭ রানের জুটি গড়েন দুজন। যখনই ভয়ংকর হয়ে উঠছিল দুজন তখনই আঘাত হানেন মিরাজ। এবার তার শিকার শ্রেয়াস আইয়ার। আফিফের হাতে সীমানার কাছে ক্যাচ দিয়ে ফেরার আগে ১০২ বলে ৮২ রান করে আসেন আইয়ার। মেরেছেন ৬টি চার এবং ৩টি ছক্কা। লম্বা সময়ের সঙ্গীকে হারিয়ে আর বেশিদূর এগুতে পারলেন না আঙার প্যাটেল। এবাদত হোসেনের দ্বিতীয় শিকার হয়ে ফিরেন ৫৬ বলে ৫৬ রান করে।

১৮৯ রানে ৬ উইকেট তুলে নিয়ে জয়টাকে নিজেদেরই তখন ভাবছিল বাংলাদেশ। মাত্র দুই ওভারের ব্যভধানে শার্দুল ঠাকুর এবং দীপক চাহার ফিরলে ম্যাচ জয়টা কেবলই সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু মরা ম্যাচে হঠাৎ করেই যেন প্রাণ ফিরিয়ে আনেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। ম্যাচের শুরুতেই হাতে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চলে যাওয়া রোহিত শর্মা ব্যাট করতে নামেন দশ নাম্বারে। আর নেমেই ঝড় তুলতে থাকেন ব্যাট হাতে। শেষ তিন ওভারে দরকার ৪০ রান। ৪৮ তম ওভারটা মেডেন নিয়ে নেন মোস্তাফিজ। ৪৯ তম ওভারটা করতে আসেন মাহমুদউল্লাহ। সে ওভারেই ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওভারের দ্বিতীয় এবং পঞ্চম বলে দুবার রোহিত শর্মার ক্যাচ ছাড়েন এবাদত হোসেন এবং এনামুল হক বিজয়। সে ওভার থেকে রোহিত শর্মা নেন ২০ রান। শেষ বলে আউট হন মিরাজ। শেষ ওভারে দরকার পড়ে ২০ রানের। মোস্তাফিজের করা প্রথম বলটা ডট করেন রোহিত শর্মা। দ্বিতীয় বল থেকে নেন চার রান। তৃতীয় বলে আবার চার। চতুর্থ বল থেকে কোন রান নিতে পারেননি। কিন্তু পঞ্চম বলে ছক্কা মেরে দেন রোহিত। শেষ বলে দরকার ৬ রান। কিন্তু মোস্তাফিজের বুদ্বিদীপ্ত বলটি ঠিক মত খেলতে পারলেন না। তাই কোন রানও নিতে পারলেন না রোহিত। ফলে ৫ রানের অবিশ্বাস্য জয় দিয়ে ঐতিহাসিক সিরিজও জিতে নিল বাংলাদেশ। ২৮ বলে ৩টি চার এবং ৫টি ছক্কার সাহায্যে ৫১ রান করে অপরাজিত থাকেন রোহিত শর্মা। আর তখনই বাংলাদেশ মাতে ম্যাচ এবং সিরিজ জয়ের উল্লাসে। ব্যাটে-বলে সমান দাপট দেখানো মিরাজই জিতলেন ম্যাচ সেরার পুরষ্কার। আগামী ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হবে সিরিজের তৃতীয় এবং শেষ ওয়ানডে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনয়াপল্টনে বিএনপি কেন বাড়াবাড়ি করছে আ. লীগ জানে : কাদের
পরবর্তী নিবন্ধজনসভার টুকিটাকি