বাংলাদেশে নদীনালা, খাল বিলের অভাব নয়। এসব স্থানে মৎস্য উৎপাদনের প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও নানা কারণে এখনও মৎস্য উৎপাদন খুবই নিরাশাজনক। মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার নানা কারণ বর্তমান। যেসব চাষীগোষ্ঠী বিলে মাছ চাষ করেন, তাঁরা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না যে কি পদ্ধতিতে চাষ করলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। বছরের পর বছর এভাবে অনেক উৎপাদন গোষ্ঠী বিলে মাছ চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সুতরাং কি কি কারণে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
*) সাধারণত বিলের পারগুলো উঁচু থাকে না এবং এগুলো প্রধানত অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত। *) বিলে এত বেশী জলজ আগাছার জন্ম হয় যে সেগুলোর মড়ক হলে তার পঁচনক্রিয়ার ফলে কাদার পরিমাণ বৃদ্ধি হয়। ক্রমাগত কাদার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় বটে তবে সে কাদা তুলে এগুলোর সংস্কার করার পরিকল্পণা কদাচিৎ গ্রহণ করা হয়। এর মূল কারণ হল অর্থ ও জানার অভাব। সেই কাদা ক্রমাগত থাকার দরুন এসব জলাশয়ে গ্যাসের সৃষ্টি হয়। ফলে মাছের বৃদ্ধি হয় না। প্রচুর কাদা থাকার ফলে পানির গভীরতা অনেক কমে যায় এবং বছরের পর বছর ক্রমাগত হ্রাস পায়। শুধুমাত্র বর্ষার সময় পানির গভীরতা সামান্য বৃদ্ধি পায় তবে বছরের অন্য সময় গভীরতা এক রাখা সম্ভব নয়। *) বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কীটনাশক ঔষধ ধুয়ে বিলে এসে পড়ে। কখনো কখনো পাশ্ববর্তী শহরাঞ্চল থেকে অথবা কোন কলকারখানা থেকে দূষিত পদার্থ বিলে এসে পড়ে। তার প্রতিক্রিয়া এ মাছগুলোর উপর পড়ে ফলে বিলের মাছের উৎপাদন কমে যায়। *) বর্ষার সময় পানি প্রবেশের বিভিন্ন পথ দিয়ে অসংখ্য মৎস্যভুক মাছ বিলে প্রবেশ করে। এগুলো পোনা মাছের চারা ভক্ষণ করে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এ জলাশয়গুলোর পোনা মাছের সংখ্যা ক্রমশ কমে যায়। এর ফলে পুকুরে পোনা মাছের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। *) অধিকাংশ বিলে মাছে পোনা মজুতের সংখ্যা ঠিক রাখা যায় না। প্রায় সর্বত্র অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের চারা মজুত করা হয়। এ জলাশয়গুলোতে অবস্থিত মৎস্যভূক মাছ থাকার ফলে সেই চারা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, কাজেই মাছের উৎপাদন কমে যায়। মানে জলাশয়ে অবস্থিত মৎস্যভূক মাছ, সর্প ও বিভিন্ন প্রকারের পাখি ছোট আকারের মজুত করা মাছের পোনা খেয়ে ফেলে, ফলে মাছের উৎপাদন কমে যায়। *) সব বিলে পানির গভীরতা এক থাকে না। গভীরতা অনুসারে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মজুত করা হয় না। গভীরতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাছের পোনা মজুত হয় না। ফলে কোন প্রজাতিরই মাছের বাড় ভাল হয় না। মাছের উৎপাদন কমে যায়। *) প্রতিটি বিলে এক দফায় মাছের চারা মজুত করা হয় না। যতদিন মাছের পোনা পাওয়া যায় দফায় দফায় বিভিন্ন প্রজাতির এবং বিভিন্ন মাপের পোনা বিলে মজুত করা হয়। এর ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের পোনার ক্ষতি হয়। কারণ ছোট মাছের পোনার সাথে বড় মাপের পোনার খাদ্য এবং বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। তাতে ছোট মাপের পোনার ক্ষতি হয়। সেগুলো খাদ্যাভাবে অপুষ্টিতে ভোগে এবং অবশেষে সেগুলোর মৃত্যু হয়। *) বিল সাধারণত অনেক বড় হয়। এত বড় জলাশয়ের পারগুলো পরিচর্যার অভাবে অনেক স্থানে ভেঙ্গে যায়। সে পথ দিয়ে বিলের মাছ বাইরে বেরিয়ে যায় এবং বাইরের মৎস্যভূক মাছও বিলে প্রবেশ করে। ফলে বিলে চাষের উপযোগী চারা মাছের ক্ষতি হয়। *) অধিকাংশ বিল এত বড় হয় এবং এমন স্থানে অবস্থিত হয় যেখানে এসব জলাশয় থেকে মাছ চুরি হয়। ফলে উৎপাদন কমে যায়।
প্রতিকার ঃ
(১) বিলে কাদা তোলার খরচ বেশি হলেও পর্যায়ক্রমে বিলের এক একটি অংশের কাদা তুলে ফেলুন। এর জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হবে কয়েক বছর মাছ চাষ করার ফলে সে অর্থ বেরিয়ে আসবে। (২) পারগুলো যেন যথেষ্ট মজবুত থাকে। না হলে চাষের উপযোগী পোনা মাছ বাইরে চলে আসবে এবং বাইরের মৎস্যভূক মাছ ও অন্যান্য প্রাণী বিলে ঢুকে পড়তে পারে। (৩) বিলের বিভিন্ন জায়গায় পানি প্রবেশ ও নিকাশের ব্যবস্থা থাকলে সেগুলোর মুখে জাল বসিয়ে দিতে হবে-ফলে বিলের মাছ যেমন বেরিয়ে যেতে পারবে না, তেমনি মৎস্যভুক মাছও বিলে প্রবেশ করবে না। (৪) যে কেন রকম দূষণ বন্ধ করতে হবে। বিলে যদি পাট পঁচাতে হয় তবে এ জলাশয়গুলোর এক একটি অংশে পাট পঁচানোর কাজ করবেন। বিলের যে কোন জায়গায় পাট পঁচানো যাবে না। তাতে মাছের ক্ষতি হয়। কোন কলকারখানা অথবা পাশ্ববর্তী শহরাঞ্চলের নালা-নর্দমার পানি যেন সরাসরি বিলে প্রবেশ না করে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ যে কোন প্রকার দূষণ মাছের বাড়ের জন্য ক্ষতিকারক। ঙ) কিভাবে বিলের পানির গভীরতা ঠিক রাখা যায় সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা আবশ্যক। এসব জলাশয়ের কাদা তুলে দিলে স্বাভাবিক কারণে এগুলোর গভীরতা বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী কোন পানিধার থেকে পানির উৎস থেকে নিয়মিত পানি প্রবেশের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। যাতে সারা বছরই বিলে পানির গভীরতা ঠিক রাখা যায়। চ) যেহেতু যে কোন বিলে মৎস্যভুক মাছ একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়, সেজন্য মাছের ভাল উৎপাদনের জন্য অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছের পোনা মজুত করুন। (১০-১৫ সে.মি.) ছ) পানির গভীরতা অনুসারে পোনা মজুতের হার নির্ণয় করতে হবে। পানির গভীরতা কম থাকলে সবকটি প্রজাতির পোনা মাছ চাষ করা যাবে না। তাতে কোন পোনা মাছেরই ভাল ফলন পাওয়া যাবে না। জ) বিলে সর্বদা এক দফায় মাছের চাষ করবেন। তাতে ভাল ফলন পাওয়া যায়। দফায় দফায় বিভিন্ন মাছের চারা দিলে পরের চারাগুলো ভালভাবে বাড়তে পারে না। এর ফলে অর্থের অপচয় হয়। বছরের শেষে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয় না।
প্রকৃতিজাত মৎস্য কমে যাওয়ায় বিলে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত প্রজাতির মাছ স্টক করা প্রয়োজন। বর্তমান অবস্থায় মাছের বীজ স্টক করাই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়। বেশিরভাগ বিলে দেখা গেছে যে মাছের পোনা মজুত করা হয় না। বিলের কোন সংস্কার করা হয় না। বিল সরকারীভাবে লিজ দেয়া হয়-সেগুলোতে প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদনের উপর লেছি পুরো নির্ভরশীল। লিজ বাবদ যে টাকা ধার্য করা হয় সেই টাকা মিলিয়ে যে লাভটুকু থাকল, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট। যতদিন পর্যন্তনা বিলের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে ততদিন মাছের অভাব থাকবেই। বিশ্বব্যাংকের সাহায্যে ০.০৩ হেক্টর থেকে ০.৪০ হেক্টর পর্যন্তপুকুরে মাছ চাষ বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ হলেও মাছের উৎপাদন তেমন আশানুরূপ বৃদ্ধি পাবে না।
প্রতিটি বিলের সমস্যা এক নয়। বিলের সমস্যা নির্ভর করে জলাশয়ের অবস্থান ও গুণাবলীর উপর। সুতরাং বিলের সমস্যাগুলো ভালভাবে পরীক্ষা করে কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কিছু খরচ অবশ্যই করতে হয়। মাছ চাষ একটি ব্যবসাভিত্তিক উদ্যোগ। সুতরাং এসব খাতে অর্থ লগ্নী করলে বছরের শেষে মাছের উৎপাদন হয়ে সে লগ্নীকৃত টাকা আপনার হাতে ফিরে আসবে। সুতরাং বিলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য টাকা খরচ করলে ক্ষতি হবে না বরং মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে আপনি লাভবান হবেন।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
