মহাপ্রাণ মহীয়সী নেলী সেনগুপ্তা-২

ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে বৃটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের গান্ধীজির প্রস্তাব বিভাজিত ভাবে ভোটাধিক্যে পাশ হয়। অসহযোগ আন্দোলনের বাণী ও কর্মধারা শহর থেকে জেলার বহুস্থানে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। চট্টগ্রামই সারা ভারতবর্ষে অসহযোগ বা স্বরাজ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনে, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। বিশেষ করে মৌলানা শওকত আলীর উপস্থিতি, জোরালো বক্তব্য, মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে মুসলিম ছাত্র সমাজের সরাসরি অসহযোগে অংশগ্রহণ, খিলাফত আন্দোলনের সহযোগিতা- সমর্থন, ১৯১৯ইং ৬ই এপ্রিলের হরতালের প্রতি সমর্থন, চট্টগ্রামের মাদ্রাসা, সরকারী কলেজের ছাত্রদের ক্লাশ ত্যাগ ইত্যাদি ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে ‘বন্দেমাতরম’, ‘আল্লাহু-আকব’র ধ্বনিতে সমগ্র চট্টগ্রাম প্রদক্ষিণ অসহযোগ আন্দোলনকে প্রচন্ডভাবে বেগবান করেছিল।
১৯২১ সালের শেষের দিকে নাগপুরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব পূর্ণভাবে অনুমোদিত হয়। এখবর সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্বের মত চট্টগ্রামই স্বরাজ্য আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে। এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা ছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। পূর্বেই উল্লেখ করেছি শ্রমিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন পুরোধা। যার জন্য তাঁকে কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল।
যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের এই শ্রমিক আন্দোলনে পতিব্রতা সহধর্মিনী নেলীর অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। শ্রমিকদেরকে সহযোগিতা দিতে গিয়ে আর্থিকভাবে এক সময় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। এহেন কঠোর পরিস্থিতিতে নেলী স্বামীর পেছনে সর্বশক্তি স্বরূপিনী হয়ে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের জয়যাত্রার সহায়িকা হয়েছেন। অর্থ সংগ্রহে দু’জনেই কোলকাতা এসেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে অর্থ সংগ্রহে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
সার্বিক পরিস্থিতি পর্বক্ষেণের জন্য মহাত্মাগান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯২১ এর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম আসেন। তখনই গান্ধীজির সঙ্গে নেলী সেনগুপ্তার পরিচয় হয়। নিজগৃহে গান্ধীজিকে অতিথিরূপে পেয়েছিলেন এবং সেই সময় থেকে গান্ধীর আদর্শে প্রভূতভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েন।
যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের গ্রেফতার নেলীকে আরো মনোবল বৃদ্ধি হতে দেখা যায় এবং সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের যুব সম্প্রদায়ের তিনি নেতৃত্ব দেন এবং বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় যুব সমাজ এগিয়ে আসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিষেধাজ্ঞা জারী করেন, কিন্তু নেলী সেনগুপ্তা বিধি নিষেধ মানতে রাজী হলেন না। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যে ঐতিহাসিক চিঠি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখেছিলেন তার অংশ বিশেষ এখানে উদ্বৃত করলাম:
‘Is it a sin to request people openly to patronize their home industry? Is it a crime to ask the shopkeepers to exhibit country made production to attract the notice of the purchasers? Is it the law of India so distructive of the industry? Are we here to prohibit rather than encourage what we hold up zealously at home? or, are we here under British Rule? Am I to understand the Brithish officers cease to be gentlemanly and honourable, when they come to India? I reserve the right to disobey this order, when Mahatma Gandhi, The leader of the national movement in India and Indian National Congress, orders me to disobey it’.
বিদেশী বস্ত্র বর্জণ করে স্বদেশী খাদি বস্ত্র পরিধান করতেন এবং বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে স্বদেশী বস্ত্র পরিধানের জন্য ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতেন। A great reflection, of Mahatma Gandhi’s ideals. চট্টগ্রামকে মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক “Chittagong to the fore” এর অভিধার কথা আগেই বলেছি।
১৯২১ সালে শ্রমিক আন্দোলনকে সর্বপ্রকারের সহযোগিতার মধ্য দিয়ে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে শুরু করে এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেসে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায় এবং ঐ বছরেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত হন। একই সালে চট্টগ্রামে বেঙ্গল প্রদেশ কংগ্রেসের সম্মেলনে যতীন্দ্র মোহন অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। স্বরাজ পার্টিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সভাপতি এবং যতীন্দ্র মোহন সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। যতীন্দ্র মোহনের জনপ্রিয়তা এতই বাড়তে থাকে যে, বিপুল ভোটে তিনি ১৯২৩ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। কর্মদক্ষতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার বলে ১৯২৫ সালে যতীন্দ্র মোহন ‘ত্রিমুকুট’। (Three crown) পরিহিত নেতৃত্বের আসনে সমাহিত হন। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি বেঙ্গল প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি, স্বরাজ পার্টির প্রধান এবং কোলকাতা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়ে ত্রিমুকুটধারী হন। এই সবক’টার পেছনেই মহাত্মা গান্ধীর আশীর্বাদ ছিল। এই একমাত্র নেতা যিনি পর পর পাঁচবার কোলকাতা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এটি একটা বিরল দৃষ্টান্ত। ১৯৩০ সালে চিকিৎসার জন্য সিংগাপুর গমন, রেঙ্গুনে বৃটিশ বিরোধী বক্তৃতা ও সর্ব ভারতীয় আইন অমান্য আন্দোলনে প্রজাবিদ্রোহীমূলক বই প্রকাশ, সর্বভারতীয় কংগ্রেসে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে জালিয়ানওয়ালা বাগ বক্তব্য ইত্যাদির কারণে যতীন্দ্র মোহনের জেল হয়ে যায় এবং দিল্লীতেই তাঁকে বন্দী করা হয়। লন্ডনে হিজলী ও চট্টগ্রামের ঘটনা নিয়ে তীব্র ভাষায় সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া ইত্যাদির ফলে বোম্বেতে বন্দী হওয়া এবং জেল থেকে জেলে স্থানান্তরের ফলে স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতিতে শেষ পর্যন্ত ১৯৩৩ সালের ২২ শে জুলাই যতীন্দ্র মোহন মৃত্যুবরণ করে একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটান।
১৯২১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ স্বামী যতীন্দ্র মোহনের মৃত্যু পর্যন্ত বিদেশিনী নেলী সেনগুপ্তা প্রতিনিয়ত আন্দোলন সংগ্রামে পাশে থেকেছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন, প্রতিবাদমুখর হয়েছেন। ইতোমধ্যে নেলী সেনগুপ্তা কংগ্রেসের বড় বড় নেতৃবৃন্দের কাছাকাছি এসেছেন। তন্মধ্যে মহাত্মাগান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত, বাসন্তী দেবী, মতিলাল নেহরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সহ আরো অনেকের সঙ্গে। প্রদেশ কংগ্রেস সম্মেলন, সর্বভারতীয় কংগ্রেস সম্মেলন সময়ে যতীন্দ্র মোহন যেখানে অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন সেই সময় নেলী সেনগুপ্ত পরিবার সামাল সহ সেবামূলক কাজে নিবেদিত প্রাণ হয়ে এগিয়ে আসতেন। যেহেতু তিনি বৃটিশ নারী ছিলেন সেইহেতু আরো বেশী সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জালিনওয়ালাবাগ বক্তব্যের পর যতীন্দ্র মোহনকে বন্দী করলে ১৯৩১ সালের ৫ই নভেম্বর যতীন্দ্র মোহনের কারারুদ্ধের বিরুদ্ধে নেলী সেনগুপ্তা তীব্র ভাষায় বিদ্রোহাত্মক বক্তব্য দেয়াতে তাঁকেও জেলে বন্দী করে রাখা হয়। ভারতের জনগণের সংগ্রামের প্রতি বিদেশিনীর এই ভালোবাসা অসাধারণ, অতুলনীয়। তিনি চার মাস জেলে ছিলেন। জেল থেকে বের হয়ে দু’জনে লন্ডনে গিয়ে নেলীর বৃদ্ধমাতা মিসেস গ্রে এর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে ভারতে ফিরে আসলে দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহনকে পুনরায় বন্দী করা হয় ১৯৩২ সালের ২২ শে জানুয়ারি।
সর্বভারতীয় প্রায় সকল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে কারা অন্তরাল ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসে পুলিশের প্রচন্ড বাধার মধ্য দিয়ে নেলী সেনগুপ্তা কোলকাতা কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অসম সাহস নিয়ে এই দায়িত্ব পালন তাঁর জীবনের একটি ঐতিহাসিক মুকুটময় অধ্যায়। যেই অবস্থায় তিনি কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেছিলেন সেটি ছিল কংগ্রেসের একটি সংকটময় সময়।
১৯৩৩ ও ১৯৩৬ সালে যথাক্রমে দু’বার নেলী সেনগুপ্তাকে কোলকাতা সিটি কর্পোরেশনের অলডারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৪০ সালে চট্টগ্রামে মহিম চন্দ্র দাশের শূন্য আসনে বঙ্গীয় আইন পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় প্রতিনিধি (Member of Bengal Legislative council) নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতার মাধ্যমে কল্পনা যোশীকে (চট্টগ্রাম বিদ্রোহে কল্পনা দত্ত নামে পরিচিত) হারিয়ে নেলী সেনগুপ্তা পুনরায় বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সেই সময় ভারতবর্ষের নেলী সেনগুপ্তাই প্রথম মহিলা যিনি সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ভারতবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। একজন বিদেশিনী হয়েও তাঁর এই জয় সমগ্র ভারতবাসীকে অবাক করেছে। এক কথায় ভারতীয় নারীদের জন্য এই বিদেশিনী ছিল পথপ্রদর্শক। যার জন্য ভারত বিভাগের পর তিনি ভারতে না থেকে চট্টগ্রামকেই নিজের অবশিষ্ট জীবন কাটাবার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিলেন শুধুমাত্র একটি কারণে যেটি হলো সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর দৃঢ়সংকল্প। স্বামীর জন্মমাটির প্রতি একজন বিদেশিনীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ অসাধারণ আদর্শের পরিচায়ক। তিনি লন্ডনে চলে যেতে পারতেন কিন্তু যাননি।, চট্টগ্রামকে ভালোবেসে চট্টগ্রামের মাটিতে কাজ করার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন। শ্রীভূপেন্দ্রকুমার দত্ত চট্টগ্রাম পরিষদ স্মরণিকায় লিখেছেন, “আবার দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে ঔপনিবেশিক শাসনের ভিতর সর্ব জাতির সর্ব ধর্মের মানুষকে নির্মম অত্যাচারের ভিতর পক্ষীমাতার মতো ডানার আশ্রয়ে বাঁচাতে চেষ্টা করেছেন”। (চলবে)

লেখক: একুশে পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, চ.বি. পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপৃথিবী কি পারবে নবজাতকের বাসযোগ্য হতে!
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষ বিদেশিদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে সৌদি সরকার