পৃথিবী কি পারবে নবজাতকের বাসযোগ্য হতে!

অনুপ দাশগুপ্ত | মঙ্গলবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

কবি সুকান্তের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার লাইন ধার করে বলা য়ায়,
‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিশ্বে এখন চলছে আলোচনার তুমুল ঝড়। তাতে অংশ নিচ্ছে পরিবেশবাদী থেকে আরম্ভ করে পৃথিবীর তাবৎ বড় বড় নেতারা। ১৯৯৯ সালের দিকে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট পানির নীচে দুদিন বসবাস করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় টেকানো যাচ্ছে না বলে তার জন্য অভিনব প্রতিবাদ করে বিশ্ববাসীর নজর কেড়ে ছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মালদ্বীপের মত দেশ পানির নীচে তলিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে বেশ হইচইও পড়ে যায় সে সময়টিতে। কিন্তু এতটি বছর পার হয়ে যাবার পরও এই বিশ্বের উন্নত দেশ গুলোর কী কোন বোধদয় হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের মহাবিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষার ?
এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া যাবে না। কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন হেতু বর্তমানের বাস্তব চিত্র তা-ই বলে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের সামপ্রতিক মন্তব্য প্রণিধান যোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আমরা নাকি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। সমস্ত দেশ তাদের প্রতিশ্রুতি মতো পদক্ষেপ করলেও আজকের হারে এই শতকের শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বাস্তবে পরিবেশ নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমরা পিছিয়ে আছি বহু আলোক বর্ষ’।
মানতেই হবে মহাসচিব আন্তেনিয়ো গুতারেসের এই মন্তব্যটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বর্তমান বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপের ফারাকের বাস্তব চিত্র। গ্লাসগোর জলবায়ু শীর্ষ সম্মলেনের (কনফারেন্স অব দ্য পার্টি সংক্ষেপে সিওপি বা কপ) খসড়া ঘোষণায় আগামী বছরের মধ্যে আরও বড় আকারে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ, ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যে লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছিল, তা পূরণের ক্ষেত্রে বড় ফারাক রয়ে গেছে। এটা পূরণ করা জরুরি। গত ২১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া কপ-২৬ সম্মলেনের শুরুতে শতাধিক দেশের উচ্চপর্যায়ের নেতারা এই দশকে মিথেন নি:সরণ অন্তত ৩০ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ পর্যন্ত কয়েকটি দেশ গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর অঙ্গীকারে সই করেছে। তবে বিশেজ্ঞরা বলছেন,এর মধ্যে দিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা দীর্ঘ মেয়াদে কমানো সম্ভব হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে যে, সবগুলো জি-২০ দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব গুলোর সরাসরি ধাক্কার মুখোমুখি হবে, যা তিন দশকের মধ্যে তাদের অর্থনীতিকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলবে। নতুন জি-২০ ক্লাইমেট ইমপেক্টস অ্যাটলাস-এ এরকম চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। সামপ্রতিকতম বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে করা একটি সমীক্ষা এটি। তাপপ্রবাহ, খরা, দাবানল ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা এবং তা ঘটার হার বৃদ্ধি পাবে। জি-২০’র আজকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মডেলগুলোর জন্য ঝুঁকি এবং অস্থিতিশীলতা তৈরী করবে। ২ নভেম্বর ২০২১ কপ-২৬ ওয়ার্ল্ড লিডার্স সামিটে বিল গেটস এক বক্তব্যে বলেছেন ‘ভাল কিছুর জন্য জলবায়ু সংক্রান্ত আলোচনায় নাটকীয় পরির্বতন হয়েছে, যেমন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি(ক্লিন-এনার্জি) উদ্ভাবনের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে বেশী। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বকে শূন্য কার্বন নি:সরণে যেতে হবে, পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি দ্রুত উদ্ভাবন করে তা বিকাশের জন্য ’নেট জিরো ওয়ার্ল্ড ইনিশিয়েটিভ’ চালুর মাধ্যমে দূষণ সৃষ্টিকারী দেশগুলোকে সাহায্য করা হচ্ছে শূন্য কার্বনে পৌঁছাতে”( ১০ নভেম্বর’ ২১প্র: আলো)।
জলবায়ু অভিযোজনের জন্য অধিকতর দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে সবগুলো দেশেকে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে খারাপ ট্র্যাজেডি হলো, এটি তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে, যারা তা সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে কম দায়ী। উষ্ণতা বৃদ্ধি সত্ত্বেও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের জন্য যদি সাহায্য অব্যাহত না রাখা হয় তাহলে বিশ্ব চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই-এ হরে যাবে।
২০০৯ সালে বৃটিশ তথ্যচিত্র ‘দ্য এজ অব স্টুপিড’ ছবিটি বড় ধরনের হইচই ফেলে দিয়েছিল। ছবিটি যেন এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের আলেখ্য-২০৫৫ সালে জলবায়ুর পরিবর্তন বিপর্যয় এনেছে বিশ্ব জুড়ে; বন্যায় ভেসে গিয়েছে লন্ডন, সিডনি জ্বলছে, মরুভূমি গ্রাস করে নিয়েছে লাস ভেগাস-কে; বর্ষণ-স্নাত আমাজনের নিবিড় অরণ্য পুড়ে খাক, আল্পাস পর্বত থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে তুষারের স্নিগ্ধ স্পর্শ; পরমাণু যুদ্ধ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ভারতকে।এই পরিপ্রেক্ষিতে এক সংরক্ষণবিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মানুষের বহু যুগ ধরে সঞ্চিত জ্ঞান এবং শিল্পের রক্ষণাবেক্ষণের। প্রায় বরফ-শূন্য সুমেরু ভূখণ্ডের উপান্তে বিশাল সংরক্ষণাগারে একক মানুষটি দেখে আধ শতক আগেকার দুনিয়ার ছবি-২০০৮-এর আর্কাইভাল ফুটেজ। বিস্মিত হয় সে। প্রশ্ন করে, সুযোগ থাকতে কেন মানবজাতি জলবায়ুর পরিবর্তন আটকায়নি? তথ্যচিত্রটি যেন ভবিষ্যতের কল্পিত পটভূমিতে দাঁড়িয়ে অতীতের, অর্থাৎ আজকের নীতি এবং কাজকর্মের পর্যালোচনা। ‘দ্য টাইমস’ ছবিটিকে বলেছে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আত্নতুষ্টির উপর সব চাইতে বড় নাটকীয় আক্রমণ। ছবিটির শক্তির জায়গা হল তা সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে দিনের অন্তিমকালের, সেই সঙ্গে অন্বেষণ করেছে বিকল্প পথের, তুলে ধরেছে অপরাধীদের নামও। এই তথ্যচিত্রটির সমকাল সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সদাই ২০০৭-এর শান্তির নোবেল দেওয়া হয়েছে আইপিসিসি এবং আল গোরকে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবদানের জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই জলবায়ু নিয়ে বিশ্বমানবের চেতনায় একটা বহু প্রয়োজনীয় হাল্কা ধাক্কা লেগেছে। যদিও ১৯৯৫-তে বার্লিন থেকে শুরু করে প্রতি বছর কোথাও না কোথাও নিয়ম করে বসেছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ‘কন্‌ফারেন্স অব দ্য পার্টিজ’(সওপি বা কপ)।
১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটো-তে তৈরী হয় ঐতিহাসিক কিয়োটো প্রটোকল। এই সম্মলেন গুলিতে প্রচুর গালভরা আলোচনা হলেও অবশ্য জলবায়ুর প্রায়-বিপর্যয় আটকানো যায় নি। এর মধ্যে ২০১৫-র প্যারিসের সিওপি২১ সম্মেলনটা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিস্তর আলাপ আলোচনায় তৈরি হয় ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি, সাক্ষর করে ১৯২ টি পার্টি। এই শতকের মাঝামাঝি নাগাদই অর্জন করতে হবে ‘নেট জিরোর’ লক্ষ্যমাত্রা। অর্থাৎ, প্রতিনিয়ত তৈরি হয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই -অঙাইডের পুরোটাই দূর করতে হবে যে কোনোভাবে। প্যারিস চুক্তির সার্থকতার লক্ষ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের নি:সরণ কমাতে বিভিন্ন দেশ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তার রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছিল ২০২০-এর মধ্যে। কিন্তু কোভিড অতিমারির জন্য ২০২০-তে সিওপি বা কপ না হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এবারের ২০২১-এর এই গ্লাসগো সম্মেলন। প্যারিস থেকে গ্লাসগোর দূরত্ব খুব বেশি নয়। তবু এই পথটুকু অতিক্রম করার ফাঁকে ছ’বছরের ব্যবধানে পরিবেশ নিয়ে মানুষের সচেতনতার একটা চোখে পড়ার মতো বদল ঘটেছে। বদল ঘটেছে মিডিয়ার মাতামাতিতেও। এর পিছনে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবদানও কম নয়। ওয়াইট হাউসের বাসিন্দা হওয়ার মাস চারেক পরেই ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে আমেরিকা, কারণ তা আমেরিকার অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকর। দুনিয়া জুড়ে মস্ত শোরগোল। পরিবেশ নিয়ে বিশ্বজনতার সচেতনতা যে খানিকটা হলেও বেডেছে।
এই সচেতনতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ অবশ্যই সুইডিশ অষ্টাদশী গ্রেটা-থুনবার্গ যিনি ভয় পেয়েছেন মর্তলোকের মহাকালের নতুন খাতার পাতা জুড়ে একটা শূন্য নামার। এই ভয় চিত্রিত হয়েছে ‘দি এজ অব স্টুপিড’ তথ্য চিত্রেও। গ্রেটা তাঁর ভয়টাকে সঞ্চারিত করেছেন পৃথিবী জুড়ে। নাড়া দিতে চেয়েছেন আজকের ‘স্টুপিড’দের। প্রতি সপ্তাহে এক দিন পরিবেশের জন্য স্কুল স্ট্রাইক করে গ্রেটা বসে পড়েছিলেন সুইডেনের পার্লামেন্টের সামনে। তাঁর একক আন্দোলন ক্রমে লক্ষ লক্ষ সঙ্গী পেয়েছে ও গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রত্যাসন্ন প্রলয়-সন্ধ্যায় দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনেতাদের গ্রেটা নির্দ্ধিধায় দোষ দিতে পারেন পরিবেশ রক্ষায় তাঁদের যুগ-লালিত নিস্ক্রিয়তার জন্য। বস্তুত, পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন, মাত্রাতিরিক্ত বায়ু ও পানি দূষণের মতো বিষয় গুলিকে স্কুলপাঠ্য রচনা আর টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের বাইরে সাধারণ মানুষের আলোচনায় নিয়ে আসার পুরো কৃতিত্ব এই সুইডিশ তরুণীর। ১২ নভেম্বর কপ-২৬ জলবায়ু সম্মলেন শেষ হয়ে গেছে, গ্লাসগো ঘোষণায় ধনী দেশগুলোর ওপর কার্বন কর বসানোসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে চূড়ান্ত মতৈক্যে আসতে হবে, বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ দূর করার সংকল্প দেখাতে হবে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিশ্রুতি কপ-২৬ এর বড় অর্জন। জনসনের উল্লেখিত এই অর্জন কতটুকু ফলপ্রসূ তা একমাত্র সময়েই বলে দেবে। দিনের শেষে পরিবেশের প্রাপ্তির ঝুলিতে কী থাকবে? কতটা বাস্তবায়িত হবে” নেট জিরো’র” লক্ষ্যমাত্রা ? পৃথিবী কি পারবে নবজাতকের বাসযোগ্য হতে? ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুরতেই থাকে, হতে থাকে সম্মেলনের পর সম্মেলন। দুনিয়ার কার্বন নি:সরণ বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। বাড়তে থাকে তাপমাত্রাও। ২০৫৫ হোক বা ২০৬৫, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ ভবিষ্যতের ঈশান কোণে পুঞ্জীভূত হতেই থাকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবি বিপিন বিহারী নন্দী
পরবর্তী নিবন্ধমহাপ্রাণ মহীয়সী নেলী সেনগুপ্তা-২