মরণফাঁদ

জোনাকী দত্ত | বুধবার , ৩০ জুন, ২০২১ at ৭:২৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ২য় শ্রেণির ছাত্র অন্তু। হালকা পাতলা শরীর। দেখতে শ্যামবর্ণের। চেহারা মোটামুটি ভালো। চোখ দুটোতে সারাক্ষণ চঞ্চলতা।এক মিনিট ও সে বসে থাকবে না। ক্লাসে বসে ছেলেদের সাথে সারাক্ষণ খুনসুটিতে লেগে থাকে। ক্লাসের প্রত্যেকটা শিক্ষিকা ওকে বকা দেয়। পড়া ও শিখে আসে কম। প্রত্যেক দিন কারো না কারো নালিশ থাকবেই। ওর মা যখন স্কুলে ওকে নিতে আসে তখন কয়েকটা অভিভাবক অপেক্ষা করে ওর নালিশ দেওয়ার জন্য। কেউ বলল, জানেন দিদি, অন্তু আজকে আমার ছেলের গালে চিমটি দিল। এই দেখেন দাগ। আর কেউ বলল, আপনার ছেলে আমার ছেলের রাবার নিয়ে ফেলেছে। আবার কেউ বা বলল, আজকে টিফিন ছুটিতে খেলার সময় আমার ছেলেকে ধাক্কা দিয়েছে। শিক্ষিকা এসে বলল, আপনার ছেলেকে একটু ভালো করে দেখবেন, ক্লাসে পড়া কম পারে।এসব শুনে ওর মা কখনো বকাঝকা করে আবার কখনো দু’চার থাপ্পর দেয়।
এরপর কয়েকদিন ভালো থাকে। আবার কিছু দিন পরে দেখা যায় অন্তু একই কাজ করছে। আলকরনে ওদের বাসা। বাসায় গিয়ে ও শান্ত থাকে না সে। বিকেলে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে ও দে ছুট। বন্ধুদের সাথে খেলা করে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেও বাসায় ফেরার নাম থাকে না। ওর মা চিৎকার করে ডাকে অন্তু, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি আয়। মুখ হাত ধুয়ে পড়তে বসতে হবে। অন্ত মাকে বলে, মা আর একটু, আর একটু। এই চল আসছি। তারপর অনেকক্ষণ পর বাসায় আসে। ওর মা ওকে ভালো করে হাত পা ধুয়ে মুছে কিছু খাবার দিয়ে পড়তে বসায়। পড়তে বসলে ও কিছুক্ষণ পর পর ঝিমায়। মা বকা একটু দিলে আবার পড়ে। এভাবে ঘুম আর পড়া শেষ করে মা ওকে রাতের ভাত খাইয়ে দেয়। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।
সেদিন বৃহসপতিবার। স্কুলে অন্তু আসার সাথে সাথে ঘটে গেল একটা ঘটনা। একটা শিক্ষিকা স্কুলে ঢুকার পর দেখল অন্তু একটা বৃদ্ধ অভিভাবককে ছোট পাথর ছুঁড়ে মেরেছে। অভিভাবকটা শিক্ষিকাকে দেখে বলল, দেখেছেন ম্যাডাম, কেমন দুষ্টু ছেলে। স্কুলে আসছে পর্যন্ত শয়তানি করে যাচ্ছে। আমি বাধা দেওয়াতে দেখেন অবস্থা। শিক্ষিকা অন্তকে ধরে নিয়ে গেল টিচার্স রুমে। তখনো প্রধান শিক্ষিকা আসে নি। সবাই অবাক হয়ে বলল, ওকে এখানে ধরে এনেছেন কেন? শিক্ষিকা সব ঘটনা বলল। তারপর বলল, প্রতিদিন তোর নামে নালিশ শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। আজকে তোকে শাস্তি দেব। হেডটিচার না আসা পর্যন্ত তুই মাথায় ইট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি। অনু্ত ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হল ওর কোন অনুশোচনা নেই। তারপর প্রধান শিক্ষিকা আসার পর ওকে ছেড়ে দিল। ও দাঁত বের করে হেসে দৌড়ে চলে গেল।
সব শিক্ষিকারা পরিকল্পনা করল শনিবারে স্কুলে পিকনিক করবে। সবাই সকাল সকাল স্কুলে এসে গেল। বাজার, কাটাকুটি আর রান্না বান্না নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হঠাৎ একজন শিক্ষিকা এসে বলল, ঘটনা জানেন, আমাদের স্কুলের ২য় শ্রেণির ছাত্র অন্তু নাকি গতকাল মারা গেছে।সবাই খবরটা শুনে থ হয়ে গেল।
শিক্ষিকাটা বলতে লাগল, সে প্রতিদিনের মত গতকাল বিকেলে খেলতে বেরিয়েছে। খেলার এক পর্যায়ে হঠাৎ তাদের বল গিয়ে পড়ে পাশের দেয়ালের ওপাশে। সেখানে নতুন বিল্ডিং তৈরির কাজ চলছে। চারদিকে বালি, ইট, রড ছড়ানো ছিটানো আছে। কেউ সাহস পায়নি বলটা আনতে। কিন্তু অন্তু এক লাফে দেয়াল টপকে বল আনতে গিয়ে মা মা বলে চিৎকার করে উঠল। সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখল অন্তু বল হাতে নিয়ে তারের সাথে জড়িয়ে আছে। মা খবর পেয়ে দৌড়ে এসে পাড়ার লোকদের সাহায্যে অন্তুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল, অনু্ত আর নেই। সব শিক্ষিকা কাজ ফেলে অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল। পিকনিকের আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল। অন্তু দুষ্টু ছিল ঠিকই, কিন্ত সে এই স্কুলের ছাত্র। সবার চোখের সামনে সারাক্ষণ হৈ হৈ, ছোটাছুটি করত। এটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। কেমন অমানুষ জমিদার বালি, রডে কারেন্টের তার ফেলে রাখে। ঐদিকে বাচ্চারা সবাই খেলা করে। প্রধান শিক্ষিকা যখন আসল সবই ঠিক করল আগামীকাল অনু্তদের বাসায় যাবে। শিক্ষিকাদের ছেলে মেয়েরা ও আসছে পিকনিকে। ওরা মোটামুটি সবাই একসাথে খেলাধূলা, আনন্দ করে পিকনিক উপভোগ করেছে। কিন্ত শিক্ষিকাদের মনে শাস্তি ছিল না। তা ও আয়োজন যখন করে ফেলেছে পিকনিকটা শেষ করল। ঐ পিকনিকে জিএস ও এসেছিল। তিনি বললেন স্কুলে সামনের সপ্তাহে অনু্তর শোক সভা পালন করতে। কমিপউটার স্যারকে বলা হল অন্তুর ছবি দিয়ে একটা ব্যানার তৈরি করার জন্য।
পরদিন স্কুল ছুটির পর প্রধান শিক্ষিকা সহ স্কুলের সব শিক্ষিকারা অন্তুদের বাসায় গেল। অন্তুর মা শিক্ষিকাদের দেখে আহাজারি শুরু করে দিল। ওর জ্যাঠাত বোন মোবাইলে শিক্ষিকাদের অন্তুর মৃত্যুর পর কিছু ছবি দেখাল। ছবিগুলো দেখে সবার মন খারাপ হয়ে গেল। ওর মা কেঁদে কেঁদে বলল, আমার ছেলে আপনাদের আর জ্বালাতন করবে না। সবকিছু ছেড়ে ও চলে গেছে। আমাকে আর মা বলে ডাকবে না। খেলতে গেলে আর দেরি করে বাসায় ফিরবে না। কারো নালিশ আমাকে আর শুনতে হবে না। ওর মার কান্না শুনে শিক্ষিকাদের চোখে জল চলে এল। তারা উনাকে সান্তুনা দিল। একজন এসে শিক্ষিকাদের জন্য কোক নিয়ে আসল। কিন্তু কারো ইচ্ছা হলো না খেতে। ওর মা অনেক জোর করল। বলল, আপনারা কিছু না খেয়ে গেলে আমার ছেলে মনে কষ্ট পাবে। বলবে, মা, আমার টিচারদের কিছু খেতে দাও নি কেন। আপনারা একটু মুখে দেন।খালি মুখে যাবেন না। তাহলে আমার ছেলে কষ্ট পাবে। উনার কথা শুনে কয়েকজন একটু মুখে দিল।
পরে শিক্ষিকারা সেই জায়গাটা দেখতে গেল। ওদের বাসা থেকে কয়েক হাত দূরে একটা খালি জায়গায় অন্যরা খেলে। ওখানে পাশে বিল্ডিং তৈরির সরঞ্জাম। তারটা তখন ছিল না। এই কারেন্টের তারটা নাকি কিছু চুরি না হওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছিল।এরা গরিব মানুষ। তাই এদের কথা কেউ শুনবে না। আইনিভাবেও এসব মালিকদের বিচার হয় না। টাকা দিয়ে এরা সব কিনে ফেলে। কে জানত এখানে মরণফাঁদ রাখা আছে। দু’একদিন পরে স্কুলে অন্তুর শোক সভা করা হল। ওর বাবাও এসেছিল। সবাই অন্তুর ছবিতে ফুল দিল। অন্তুর সমপর্কে কিছু বলা হল।আর ছেলে মেয়েদের সাবধান করা হল। এমন কোন জায়গায় যাতে ওরা খেলাধুলা না করে যেখানে মরণফাঁদ থাকে। পরিস্কার খোলা মাঠে যেন সবাই খেলাধুলা করে। বল কোথাও চলে গেলে সেটা যেন বড় কাউকে ডেকে তারপর নেওয়া হয়। অন্তুর মত মরণফাঁদে পড়ে যাতে আর কারো জীবন শেষ না হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঘুম ভাঙেনি-ঘুম ভেঙেছে
পরবর্তী নিবন্ধমানুষের ভূতের ভয়