মনীষী আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার

নিলুফারুল আলম | সোমবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ

১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের জন্ম হয়। পিতার নাম মোহাম্মদ বেলায়েত আলী চৌধুরী এবং মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা। তাঁর বড় এক বোন ও এক ভাই। বোনের নাম বেগম তামান্না খাতুন এবং ভাইয়ের নাম আবদুল গণি চৌধুরী। কথিত আছে আবদুল খালেক মোগল পদাতিক বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান শেখ বড় আদম লস্করের বংশধর ছিলেন।

তাঁরা দুই ভাই এক বোন পিতা মাতার স্নেহে বড় হচ্ছিলেন সবাই। কিন্তু অল্প বয়সে তাঁরা তিন ভাই বোন তাঁদের পরম আশ্রয় পিতাকে হারালেন। আবদুল খালেক বয়সে এত ছোট ছিলেন যে পিতার বিয়োগ ব্যথা তিনি তখন উপলব্ধি করতে পারেননি। বয়স বাড়ার পর তিনি পিতার অনুপস্থিতি বুঝতে পেরেছিলেন। সে সময় মা এবং বড় বোন তাঁকে আগলে রেখে বড় করতে লাগলেন। সংসারে দীনতা ছিল না বটে তবে সচ্ছলতা খুব বেশি ছিল না। রক্ষণশীল পরিবার বলে তাদের মা জমিজিরাত যা ছিল তা তদারকি করার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। পরিবারের কর্তাকে হারিয়ে তাদের আর্থিক সুবিধা হচ্ছিল। এ দুঃসময় তাঁদের চাচা আহমদ মিয়া তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। তিনি ভাইয়ের সংসারকে স্থিতিশীল করায় সচেষ্ট ছিলেন।

আবদুল খালেক যে পরিবারের বেষ্টনীতে শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছিলেন তা অত্যন্ত আদর্শ, মানবতাবোধ সম্পন্ন ধার্মিক ও পরোপকারী পরিবার ছিল। মাতাপিতা উভয়ে ন্যায় নীতিবান মানুষ ছিলেন। যদিও পিতাকে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ পাননি তবুও পিতার বিশুদ্ধ শাণিতধারা তাঁর দেহে বহমান ছিল। মাতা এমন পরোপকারি ছিলেন যে প্রতিবেশীর দুঃখে, দরদে, রোগশোকে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। এমন কি কোনও রোগাক্রান্তকে রাত জেগে সেবা করে ওষুধ পথ্য সাহায্য করতে পিছপা হতেন না। তাঁদের পরিবারটি ছিল সে রকম পরের প্রতি মমত্ববোধ সম্পন্ন। আবদুল খালেকের ওপর সে প্রভাব শতগুণে প্রবর্তিত ছিল। তিনি ছোট বেলা থেকে শান্ত, মিষ্টি হাসি ও চুপচাপ থাকার মানুষ ছিলেন। অন্যান্য ছেলের মতো দুষ্টুমি ও খেলাধূলা করা তাঁর অভ্যাস ছিল না। বড় বোন ও ভাই তাঁকে খেলবার জন্য ডাকাডাকি করলেও তিনি যোগ দিতেন না। গরিবের প্রতি অর্থাৎ ভিখারিদের যে তিনি নিজ হাতে ধান, চাল কোনও সময় পাতিল থেকে ভাত পর্যন্ত দিয়ে দিতেন। কারো কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারতেন না।

অত্যন্ত মেধাবী আবদুল খালেক লেখাপড়ার দিকে ইংরেজি, অংক, বাংলা, আরবি, হিন্দি, উর্দু কোনও বিষয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। ইংরেজি, বাংলা দক্ষ ছাত্র হলেও শৈশব থেকে তাঁর মন মানসিকতায় আধ্যাত্মিক চেতনাবোধের সমন্বয় ছিল। আরবি শিক্ষা গ্রহণে ব্রতী ছিলেন। তিনি ধার্মিক ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। পাড়ায় হিন্দু, বৌদ্ধদের সঙ্গে তাঁর সৎ ভাব ছিল। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। ছোটবেলায় মক্তব মাদ্রাসায় তিনি কখনও একা যেতেন না। যখন তিনি নামাজ শিখেননি তখনও তিনি কারো সঙ্গে মসজিদে যাবার অভ্যাস করতেন। বড় হয়ে মসজিদের খেদমত করতেন।

তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন পরিবার থেকে প্রাপ্ত। মায়ের কাছ থেকে বর্ণমালা ও আরবি শিক্ষা পান। এরপর বড় বোন ও বড় ভাই থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ গ্রহণ করেন। এছাড়া পরিচিত শিক্ষকের কাছেও তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। পাঁচ বৎসর বয়সে তিনি রাউজান স্টেশন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। পরে স্কুলটির নামকরণ করা হয় ভিক্টোরিয়া প্রাইমারি স্কুল নামে। প্রথম শ্রেণির ছাত্র হলেও তাঁর জ্ঞান আরও সমৃদ্ধ ছিল। উৎপত্তিস্থল থেকে তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। ব্রিটিশ আমলে শিক্ষা ব্যবস্থায় বঙ্গীয় বৃত্তির প্রথা ছিল ২য়, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে। মেধাবী আবদুল খালেক ২য় ও ৫ম শ্রেণির বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে কৃতিত্বের সাথে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। ভর্তি হন রাউজান রামগতি রামধন আবদুল বারি চৌধুরী ইনস্টিটিউশনে। হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে তাঁর মেধার স্ফূরণ প্রজ্বলিত হতে থাকে। গ্রামীণ পরিবেশে থেকে সীমিত সুযোগ পেয়েও তিনি কৃতিত্বের সাথে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে থাকেন। তখন মুসলমানরা ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষা গ্রহণ করাকে পাপ মনে করতেন কিছু পরিবার এসব এড়িয়ে তাঁদের ছেলেদের শিক্ষিত করার প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও হিন্দুরা অগ্রগামী ছিল। অন্যান্য গ্রামের তুলনায় সুন্দরপুর গ্রামটি প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ছিল। অসাধারণ মেধার কৃতিত্ব প্রদর্শন করে আবদুল খালেক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রথম হয়ে বঙ্গীয় বৃত্তি লাভ করেন। ইচ্ছে করলে যে কেউ বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারতো না। থানাভিত্তিক নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যেতে পারতো। তিনি বৃত্তি প্রাপ্ত হওয়ায় শুধু পরিবার খুশি হয়েছিল তা নয়। সারা সুন্দরপুর গ্রাম এত পুলকিত হয়েছিল যে এমন এক মুসলমান ছাত্রের বঙ্গীয় বৃত্তি প্রাপ্ত হবার আনন্দে। তাঁর আর এক জ্ঞাতি ভাই আবুল হাসেম (ডাঃ হাসেম) ও ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন বলে দু’ভাইয়ের জন্য ২ বার সংবর্ধনা দিয়েছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুলটি কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও প্রথমস্থান লাভ করা এরা দুই ভাই ছাড়া আর কেউ ছিল না।

১৯১২ খ্রিস্টাব্দে আবদুল খালেক রাউজান আরআরএসসি ইনস্টিটিউশন থেকে চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে চট্টগ্রাম জেলা বৃত্তি নিয়ে এন্ট্রান্স পাস করেন। তখনকার যুগে মুসলমান ছাত্রের এ কৃতিত্ব অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। অতপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে আইএসসি শ্রেণিতে ভর্তি হন। যেহেতু তিনি বৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্র তাই তাঁর বইকেনা ও টিউশন ফ্রি ছিল। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে আবারও তিনি জেলা বৃত্তি নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। যদিও তিনি স্কলার মাসিক ১৫ টাকা বৃত্তি পাবেন কিন্তু উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তাঁকে যেতে হবে অন্যদেশে সেখানে অতিরিক্ত কিছু খরচ আছে। আর্থিক চিন্তাভাবনা থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছেন না। তখন চাচা আহমদ মিয়া চৌধুরী ভাইপোকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পথটা বাতলিয়ে দেন। যেহেতু তাঁর জ্ঞাতি ভাই তিনিও স্কলার, তিনি যদি ডাক্তারি পড়া শুরু করেছেন তবে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পদে লেখাপড়া করবেন। তখন বাংলাদেশে কোনও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কলেজ বিদ্যালয় ছিল না। তখন ভারতের কোলকাতায় গিয়ে এসব উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করা হতো। আবুল হাসেম আগে থেকে কোলকাতায় ডাক্তারি পড়া আরম্ভ করেছিলেন। চাচা আহমদ মিয়া চৌধুরীর সাহস ও অনুপ্রেরণা ও সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে আবদুল খালেক কোলকাতা শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তি হন। এই ব্যাপারে ডা. আবুল হাসেম তাঁকে সাহায্য করেন। রাউজান থানার সুন্দরপুর গ্রামে দুই ভাই ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হয়ে শুধু রাউজান নয় চট্টগ্রাম তথা সারা বাংলাদেশে যে খ্যাতি রেখে গেছেন তা তাঁদের অমর করে রাখবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার উভয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এক ও অভিন্ন। মানুষের সেবা ও মানবতার সেবা, পরোপকার, দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসা ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য। সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হয়েও তাঁদের উভয়ের মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকারবোধ ছিল না।

আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব প্রথম তাঁর শিক্ষাজীবন যেখানে শেষ হয় সেখানে লোভনীয় বেতনের চাকরি পেয়েছিলেন। এছাড়া রেঙ্গুন থেকে তাঁর চাকরির প্রস্তাব আসে। তিনি সব প্রত্যাখ্যান করেন মাতা এবং মাতৃভূমির মমতার জন্য। অবশেষে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি কঠোর পরিশ্রম করে চাকরি করতেন। আয়ের মধ্যে হালাল রোজগারের চিন্তা ছিল। তিনি চট্টগ্রামের প্রথমদিকের তড়িৎ প্রকৌশলী ছিলেন। তাই বিদ্যুৎ কাজের উন্নতির প্রচেষ্টা ছিল তাঁর বেশি। কর্তৃপক্ষ তাঁর কাজের দক্ষতা ও নিষ্ঠা দেখে তাঁকে বড় পদে বহাল করলেও এক সময় তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পরহিতব্রতের মানসে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে চাকরি ইস্তফা দেন। তাঁর করিৎকর্মা দেখে তাঁকে অনেক বেশি টাকার ও উচ্চ পদে আসীন করা চাকরির প্রলোভন আসলেও তিনি সব প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর ভিতরে যে সাহিত্য প্রতিভা ছিল তা সমাজের দুর্দশা দূর করার জন্য তার লেখনি সোচ্চার ছিল।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মানুষকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্য তিনি প্রথমে প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর লাইব্রেরি। এ ব্যবসার উদ্দেশ্য লাভবান হবার জন্য নয়। মানুষ আসতেন বই পড়তেন। কেনাবেচা তেমন ছিল না। মানুষকে বইপড়ামুখী করার তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস স্থাপন করেন। এটা ছিল চট্টগ্রামের প্রথম বিদ্যুৎচালিত ছাপাখানা। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজে মেশিনম্যানদের প্রশিক্ষণ দেন বিদ্যুৎতাড়িত বিপদ এড়াবার পথও বাতলিয়ে দেন। তিনি তাদের সাথে মেশিন চালানোর কাজে সাহায্য করতেন। কোহিনূর লাইব্রেরি ও কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস স্থাপিত হলে মুসলমান সাহিত্যমোদী ও নতুন তরুণ যুবক যারা লিখতে আগ্রহী ছিল তাঁরা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কাজ থেকে সাহায্য ও প্রেরণা পান। সেখানে তাঁদের সাহিত্য আড্ডার সৃষ্টি হয়। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে অনেকের বই ও চট্টগ্রামের অনেক সংবাদপত্র ছাপা হতো। তা বিস্তারিত বর্ণনা করতে লেখার পরিসর বৃদ্ধি পাবে তাই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করলাম। ভাষা সৈনিক মাহবুব উল চৌধুরীর ভাষা সংগ্রামের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ তা এ প্রেস থেকে ছাপা হয়। মাতৃভাষার প্রতি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অকৃত্রিম ভালোবাসা এখানে পরিস্ফুট হয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক, কবি ও উচ্চতর ডিগ্রিধারী ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি পরহেজগার ও ন্যায়নীতিবান ছিলেন। তিনি অর্থলোভী ছিলেন না। বেকার, গরিবদের কিভাবে কর্মসংস্থান হবে সেদিকে তাঁর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল এবং তা সমাধানের উপায়ও তিনি করে দিতেন নির্দ্ধিধায়।

লাইব্রেরি ও প্রেস প্রতিষ্ঠার পর তাঁর ঝোঁক চাপলো একটা পত্রিকা বের করার এবং তিনি তা পূরণ করলেন সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা বের করে। তিনি চট্টগ্রামের প্রথম ইঞ্জিনিয়ার বললে অত্যুক্তি হবে না।

বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেও তাঁর ভিতরে সাহিত্যের বহি:প্রকাশ ঘটাবার প্রয়াসে পত্রিকা বের করলেন এবং তাতে সফলকাম হলেন। অনেক লেখক সৃষ্টি করলেন। নিজেও লেখকে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর লিখিত অনেক বই আছে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক কোহিনূর প্রকাশিত হয়। কোহিনূর প্রথম প্রকাশ পায় মহানবী (.) ওরছন্নবী উপলক্ষ্য নিয়ে। এবার তিনি প্রকাশকরূপে সুপরিচিত হলেন। কোহিনূর লাইব্রেরিতে তাঁর সাথে অনেকে আসতেন তিনি মিষ্টি হাসতেন। আপ্যায়ন করাতেন চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ বেলা বিস্কুট আর রঙ চা দিয়ে।

আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বছর ৬ মাস সাপ্তাহিক কোহিনূর প্রকাশ করার পর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা প্রকাশের পর তাঁর মনের বাসনা পূর্ণ হয়। দৈনিক আজাদী প্রকাশের জন্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পীর হযরত ছিরিকোটি সাহেবের সম্মতি ছিল। তাঁর পীর সাহেব দ্বীনের খেদমত করার জন্য একটি পত্রিকা প্রকাশের উৎসাহ দিতেন। এই পত্রিকা জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে দেশবাসীর সেবার জন্য। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে আজাদী ছাপা হতো। তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন তাঁর সম্পাদকীয় লেখা অনেক তথ্যবহুল। ন্যায্য অধিকার আদায়ের কলম সৈনিক ও প্রতিবাদী সাংবাদিক। তিনি বেঁচে থাকতেই দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মনোনীত করে যান তাঁর ভাগ্নে ও জামাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে এবং পরিচালনা সম্পাদক করেন তাঁর একমাত্র সুযোগ্য পুত্র এম এ মালেককে। অধ্যাপক খালেদের মৃত্যুর পর এম এ মালেকের দক্ষ সম্পাদনায় আজাদী এ অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিকের স্থান দখলে আছে।

ইঞ্জিনিয়ার ফজরের নামাজের পর থেকে রাত অবধি পত্রিকার কাজে নিয়োজিত থাকতেন। তখন হকারের সংখ্যা তেমন ছিল না। তিনি আন্দরকিল্লাহ জামে মসজিদে নামাজ পড়তেন। রাতে তাহাজ্জদ নামাজের পর ফজরের নামাজ শেষে যখন তিনি বের হতেন তখন একদল ফকির হাত তুলে বসে থাকত। তিনি তাদেরকে সাথে নিয়ে আসতেন এবং প্রত্যেকের হাতে ১০ কপি পত্রিকা দিতেন। ফকিররা খুশিতে পত্রিকাগুলো বিক্রি করে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে টাকা দিতে আসতেন। তিনি তাদেরকে বিক্রির দাম দিয়ে বলতেন যা ভিক্ষা করিস না। কাজ করে খা। এভাবে তিনি অনেক হকার সৃষ্টি করে নিলেন। আর একদিন দেখেন তিনি এক পঙ্গু ফকিরকে। তাঁর কাছ থেকে কিছু পয়সা চেয়েছিলো। তিনি ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে ফকিরটির পায়ের ক্ষতে পচন ধরেছে। তিনি ভিক্ষুকটিকে নিজ ঘরে এনে নিজ হাতে পরিবেশন করে খাওয়ালেন। তারপর তাকে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সেখানে তার চিকিৎসা চললো। তিনি তার জন্য ওষুধ পথ্য নিজে নিয়ে যেতেন। ভিক্ষুকটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে প্রেসে আসেন। এরপর ভিক্ষুকটি আজাদী পত্রিকা বিক্রি করে জীবন যাপন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান ছিল। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ৬ দফা ঘোষিত হলে সে ৬ দফার পক্ষে কাজ করে শ্রমিক নেতায় পরিণত হয়। মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে গেল শ্রমিক নেতা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অবদানে। বাড়িতে তিনি দীন দরিদ্রকে একসাথে নিয়ে একসঙ্গে আহার করতেন। রমজানের সময় জামে মসজিদের বারান্দায় ইফতারি নিয়ে গিয়ে গরিব ও মুসল্লীদের নিয়ে একসাথে ইফতার করতেন।

সংসার জীবনে তিনি সুখী ছিলেন। ভালো বংশের ভাল অর্ধাঙ্গিনী মালেকা বেগম তাঁর একই মানসিকতার নারী ছিলেন। এ যেনো মনিকাঞ্চন যোগ হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত ধনী না হলেও মোটামুটি সচ্ছল পরিবার গড়ে তুলেছিলেন। দীন, দরিদ্র, ভুখা, ফকির তাঁদের সংসার থেকে শূন্য হাতে ফিরে যাইনি। মালেকা বেগম স্বহস্তে সংসার চালিয়ে নিয়ে অবসর সময়ে জেনারেল হাসপাতালে রোগীদের সেবা দুঃখীদের দান খয়রাত করতেন। ইঞ্জিনিয়ার সারাদিন কাজের ব্যস্ততার মাঝেও সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন না। সুশৃঙ্খলভাবে পরিবার পরিচালনা করতেন। পরিবারে কার কি প্রয়োজন এবং কিছু সমস্যা থাকলে তিনি ধীরস্থিরভাবে সমাধান করতেন। ইঞ্জিনিয়ার দম্পতির পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র ছিল। বড় মেয়ে আছিয়া খাতুন, জমিলা খাতুন, ফাতেমা খাতুন, আমেনা খাতুন ও তাহমিনা খাতুন এবং একমাত্র পুত্র আবদুল মালেক। স্ত্রীর নাসের সঙ্গে মিলিয়ে পুত্রের নাম রাখা হয়। অবশ্যই পিতার নাম আবদুল ও পুত্রের নামের সঙ্গে সংযোগ হয়েছে।

ইঞ্জিনিয়ার দম্পতির ১ম কন্যা আছিয়া খাতুনের স্বামী ডাক্তার আবদুল আহাদ। তাঁদের ২য় কন্যা ফাতেমা খাতুনের স্বামীর নাম শামসুল হুদা কাদেরী। তাঁদের ৩য় কন্যা জমিলা খাতুন। তাঁর স্বামীর নাম ডা. আফতাবউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। তাঁদের চতুর্থ কন্যা আমেনা খাতুন। তাঁর স্বামীর নাম প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ। তাঁদের পঞ্চম কন্যা তাহমিনা খাতুন। তাঁর স্বামীর নাম মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। তিনি পাঁচ কন্যাকে সুপাত্রে পাত্রস্থ করে গিয়েছিলেন। একমাত্র পুত্র আবদুল মালেকের বিয়ে দেখে যেতে পারেননি। কারণ পিতা জীবিতকালে তিনি বিবাহযোগ্য হননি তাই। আবদুল মালেক বিবাহ করেন ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তাঁর স্ত্রীর নাম কামরুন মালেক।

ডাক্তার আবুল হাশেম তাঁর জ্ঞাতি ভাইয়ের অপারেশন হচ্ছে ঢাকায়। সে সময় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অসুস্থ ছিলেন। অতিরিক্ত পরিশ্রম করা সময়মতো খাওয়া দাওয়া না করায় তাঁর পেটে আলসার হয়। অপারেশনের কথা বললে ‘আচ্ছা করবো পত্রিকাটি আর একটু গুছিয়ে নিই’ অসুস্থ শরীর নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ঢাকায় পৌঁছে গেছেন ডা. হাশেমের অপারেশনের সময়। তখন ডা. আবুল হাশেমের ছেলে ডা. গোলাম আকবর তাঁকে বললেন আপনি কেন অসুস্থ শরীর নিয়ে ঢাকায় আসছেন। উত্তরে তিনি বললেন অপারেশনটা ডাক্তার সাহেবের হচ্ছে না আমার হচ্ছে।

তিনি পদে পদে ইসলাম ধর্মের নিয়ম মেনে চলতেন। কিন্তু তাই বলে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তাঁর প্রেসে অনেক হিন্দু চাকরি করতেন। লাইব্রেরি, প্রেস, পত্রিকা গড়ে শিক্ষার উন্মেষ ঘটানোও মানবজাতির সেবা করার কাজ সম্পন্ন করে তিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। পীরে কামেল হযরতুল আল্লামা মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ ছিরিকোটি (.) হাতে পূর্বে তিনি বায়েত হয়েছিলেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর আমন্ত্রণে পীর সাহেব চট্টগ্রামে আসেন। তাঁর বাসা কোহিনূর মঞ্জিলে তিনি অবস্থান করেন। পীরে কামেলের সংস্পর্শে তাঁর আধ্যাত্মিক জগৎ আরো উন্নত হয়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শহরের হাটখোলা গ্রামের উন্মুক্ত জমিতে যে মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন তা তাঁর পীরের নামানুসারে আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ও জামেয়া মাদ্রাসা। ছিরিকোটি সাহেব এ মাদ্রাসার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এ মাদ্রাসা যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের তা আমরা ঘুণাক্ষরে জানতাম না। তিনি তাঁর নাম কোনদিন প্রচার করেন নি। বেশভূষায় অতি সাধারণ তাঁকে ইঞ্জিনিয়ার বলে মনে হতো না। কাজকর্ম ও পোশাক আশাকে তিনি নিখাদ এক সুফী সাধক ছিলেন। এমন শুনেছি যে তিনি মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন কাঠের খড়ম পায়ে নিয়ে।

তিনি যে প্রতিষ্ঠানগুলি গড়েছিলেন তাতে সময় ক্ষেপণ করতে গিয়ে নিজের শরীরের যত্ন নিতে পারেন নি। কর্মক্ষেত্রে তিনি হঠাৎ অসুস্থবোধ করলে তাঁকে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তিকাল করেন।

কবির ভাষায়

কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক

কে বলে তা বহুদূর।

মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক

মানুষেতে সুরাসুর’।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জীবন বলে তা একশত ভাগ সত্যি। যাবার বেলায় তিনি এক গাটরি পূণ্য কামাই করে ইহলোকে ত্যাগ করেছেন। তিনি জান্নাতবাসী তা দুনিয়াবাসী চক্ষে উদীয়মান হয়ে আছে। আমি তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঐতিহ্য ধরে রাখতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধপরলোকে শিক্ষক মিহির কান্তি শীল