বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করা। আর সে কারণে এ মামলার আসামিরা কোনো ‘সহানুভূতি পেতে পারে না’ বলে পর্যবেক্ষণ এসেছে আদালতের রায়ে।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান গতকাল দপুরে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ছয় আসামির মধ্যে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৫ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড এবং উগ্রপন্থি এক ব্লগারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
৫০ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলা হয়, সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, অভিজিৎ রায় একজন বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার ছিলেন। বাংলা একাডেমির বইমেলায় বিজ্ঞান মনস্ক লেখকদের আড্ডায় অংশগ্রহণ করে ফেরার পথে আক্রমণের শিকার হন। নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা, অর্থাৎ এ মামলার অভিযুক্তরাসহ মূল হামলাকারীরা সাংগঠনিকভাবে অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশের জন্য অভিজিৎ রায়কে নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়।
বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য হলো জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ ও নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ না করতে পারে।
আসামিদের সাজার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, বাংলাদেশে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্য আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে মত প্রকাশ ও স্বাধীন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে অভিযুক্ত আসামিদের কারো ভূমিকা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। যেহেতু অভিযুক্ত পাঁচজন আসামি সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া, আকরাম হোসেন, মো. আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ও মো. আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম আনসার আল ইসলামের সদস্য হিসাবে সাংগঠনিকভাবে অভিজিত রায় হত্যায় গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন, সেজন্য ওই ৫ জন আসামির একই সাজা প্রদান করা হবে বাঞ্ছনীয়।
বিচারক বলেন, অভিজিৎ রায় হত্যায় অংশগ্রহণকারী অভিযুক্ত আসামিরা বেঁচে থাকলে আনসার আর ইসলামের বিচারের বাইরে থাকা সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহী হবে এবং বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তমনা লেখকেরা স্বাধীনভাবে লিখতে এবং মত প্রকাশ করতে সাহস পাবেন না। কাজেই উক্ত আসামিরা কোনো সহানুভূতি পেতে পারে না।
আদালত বলেছে, সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২) (অ) ধারায় এই পাঁচ আসামিকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেই নিহতের আত্মীয়রা ‘শান্তি’ পাবে এবং মুক্তমনা লেখকেরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ‘সাহস’ পাবে। অন্যদিকে জঙ্গিরা ভবিষ্যতে এমন জঘন্য অপরাধ করতে ‘ভয় পাবে এবং নিরুৎসাহিত হবে’।
অপর আসামি উগ্রপন্থি ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত না থাকলেও ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে অভিজিৎ রায়কে ‘হত্যার প্ররোচনা দিয়েছিলেন’ বলে তাকে এ মামলায় আসামি করা হয়। আদালত বলেছে, ফারাবীকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬ (২), ৮(আ) ধরায় সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়াই সমীচীন হবে।
২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি সত্তা বা বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোনো সত্তা বা কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা করে, তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে।
একই আইনের ৬(১)(ক)(আ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর জখম, আটক বা অপহরণ করার জন্য ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ৪ থেকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে।