ভূতের রকমফের

রেজাউল করিম | বুধবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

লোকসাহিত্যের ভূত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুরাতন এবং নতুন উভয় বাংলা রূপকথায় প্রায়ই ভূতের ধারণা ব্যবহার করা হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও প্রায়ই ভূতের উদাহরণ পাওয়া যায়। বিশ্বাস করা হয়, ভূত হল সেই সব অশরীরি আত্মা যারা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে শান্তি খুঁজে পায়নি। কিংবা পৃথিবীতে অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। এছাড়াও বিশ্বাস করা হয়, অন্যান্য জীবজন্তু বা প্রাণীও তাদের মৃত্যুর পরে ভূতে পরিণত হতে পারে। বাংলায় ভূতকে মাঝে মাঝে প্রেতাত্মা হিসেবেও উল্লেখ করা হয।
‘ভূতের বাড়ি খুঁজছ কোথায়, জানো কোথায় থাকে/ গাছের ডালে ঝোপেঝাড়ে কিংবা পাতার ফাঁকে/ প্রাচীন কোনো দালানবাড়ি স্যাঁত সেঁতে ঘর অন্ধকারে/ গা-ছমছম চোখ বুঁজে কি ভয়ে ভয়ে খুঁজছ তারে/ আকাশ পাতাল মর্ত জুড়ে ইচ্ছেমতো ঘুরে ঘুরে/ ফিরবে যখন তুমি/ তখন না হয় হাতড়ে দেখো আপন মনোভূমি/ ভূতেরা সব অমনিধারা ভীষণ পাজি লক্ষ্মীছাড়া/ ঘাপটি মারে খুব/ সুযোগ পেলেই মনপুকুরে দিতেও পারে ডুব।’
পাশ্চাত্যে হ্যালোইন উৎসব বেশ ঘটা করে উদযাপিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর অক্টোবরের শেষ দিনটি মৃত আত্মাদের স্মরণে দিবসটি উদযাপন করা হয়ে থাকে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বসবাস করতো ক্যাল্টিক জাতি। নভেম্বরের প্রথম দিনটি তাদের নববর্ষ বা ‘সাহ-উইন’ হিসাবে পালন হতো। এই দিনটিকে তারা গ্রীষ্মের শেষ এবং অন্ধকারের বা শীতের শুরু মনে করতো। আর অক্টোবরের শেষ একটি দিনকে মনে করতো সবচেয়ে খারাপ রাত, যেই রাতে সকল প্রেতাত্মা ও অতৃপ্ত আত্মা তাদের মাঝে ফিরে আসে। এদের সঙ্গে যদি মানুষের দেখা হয় তবে সেই মানুষের ক্ষতি হতে পারে। সেজন্য এই রাতে বিভিন্ন রকম ভূতের মুখোশ ও কাপড় পরে কাটাতো। আর রাতের বেলা আগুনের পাশে মুখোশ পরে বৃত্তাকারে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্র বলা, নিজের পরিবার ছোট হলে অন্যের বাড়িতে থাকাসহ সামাজিকভাবে একত্র হত।
বাংলা সংস্কৃতিতে অনেক ধরনের ভূতের বিশ্বাস রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো, পেত্নী, শাকচুন্নি, চোরাচুন্নি, পেঁচাপেঁচি, মেছোভূত, দেও, নিশি, মামদো ভূত, গেছোভূত, ব্রহ্মদৈত্য, আলেয়া, বেঘোভূত, কানাভুলো, ডাইনি, ঝেঁয়ো পেত্নী, ডাকিনী প্রভৃতি।
পেত্নী : পেত্নী হলো নারী ভূত যারা বেঁচে থাকতে কিছু অতৃপ্ত আশা ছিল এবং অবিবাহিতভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। এসব ভূত সাধারণত যে কোন আকৃতি ধারণ করতে পারে, এমনকি পুরুষের আকারও ধারণ করতে পারে। এসব ভূত সাধারণত বেঁচে থাকতে কোন অপরাধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে এবং মৃত্যুর পর অভিশিপ্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করে। পেত্নীরা সাধারণত ভীষণ বদমেজাজী হয়ে থাকে এবং কাউকে আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত স্পষ্টতই মানুষের আকৃতিতে থাকে। পেত্নীদের আকৃতিতে একটিই সমস্যা রয়েছে, তা হলো তাদের পাগুলো পিছনের দিকে ঘোরানো।
শাকচুন্নি : শাকচুন্নি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ শঙ্খচূর্ণী থেকে এসেছে। এটা হলো বিবাহিত মহিলাদের ভূত যারা বিশেষভাবে তৈরি বাঙালি শুভ্র পোশাক পরিধান করে এবং হাতে শঙ্খ বা শাঁখা পরিধান করে। শাকচুন্নিরা সাধারণত ধনী বিবাহিত মহিলাদের ভেতর ভর করে বা আক্রমণ করে যাতে করে তারা নিজেরা সেই মহিলার মত জীবন যাপন করতে পারে ও বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে পারে। লোকগাঁথা অনুসারে তার আম গাছে বসবাস করে।
চোরাচুন্নি : চোরাচুন্নি খুব দুষ্ট প্রকৃরি। মানুষের অনিষ্ট করাই এদের কাজ। সাধারণত কোন চোর মৃত্যুবরণ করলে চোরাচুন্নিতে পরিণত হয়। পূর্ণিমা রাতে এরা বের হয় এবং মানুষের বাড়িতে ঢুকে পড়ে অনিষ্ট সাধন করে।
পেঁচাপেঁচি : এ ধরনের ভূত সচরাচর দেখা যায় না। পেঁচাপেঁচি ভূত ধারণাটি পেঁচা থেকে এসছে এর স্ত্রীবাচক হলো পেঁচি। এরা জোড়া ধরে শিকার করে থাকে। বাংলার বিভিন্ন জঙ্গলে এদের দেখা যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। এরা সাধারণত জঙ্গলে দুর্ভাগা ভ্রমণকারীদের পিছু নেয় এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় ভ্রমণকারীকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে ও এরা শিকারের মাংস ছিড়ে ছিড়ে খায়।
মেছোভূত : এ ধরনের ভূতেরা মাছ খেতে পছন্দ করে। মেছো ভূত সাধারণত গ্রামের কোন পুকুর পাড়ে বা লেকের ধারে যেখানে বেশি মাছ পাওয়া যায় সেখানে বসবাস করে। মাঝে মাঝে তারা রান্নাঘর বা জেলেদের নৌকা থেকেও মাছ চুরি করে খায়। বাজার থেকে কেউ মাছ কিনে গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে ফিরলে এটি তার পিছু নেয় এবং নির্জন বাঁশঝাঁড়ে বা বিলের ধারে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ করে মাছ ছিনিয়ে নেয়।
দেও : এধরনের ভূত নদীতে বা লেকে বসবাস করে। এরা লোকজনকে পানিতে ফেলে ডুবিয়ে মারে বলে বিশ্বাস করা হয়।
নিশি : ভূতদের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর হলো নিশি। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে, কিন্তু নিশি গভীর রাতে শিকারকে তার প্রিয় মানুষের কন্ঠে নাম ধরে ডাকে এবং বাইরে বের করে নিয়ে যায়। নিশির ডাকে সারা দিয়ে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, আর কখনো ফিরে আসে না। মনে করা হয় তারা নিজেরাও নিশিতে পরিণত হয়। কিছু কিছু তান্ত্রিক অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিশি পুষে থাকে। নিশিরা কোন মানুষকে দুবারের বেশি ডাকতে পারে না, তাই কারো উচিত কেউ তিনবার ডাকলে বের হওয়া তাতে নিশির আক্রমণের ভয় থাকে না।
গেছোভূত : গেছো ভূত গাছে বসবাস করে। গেছো শব্দটি গাছ (বৃক্ষ) শব্দ থেকে এসেছে।
ডাইনি : ডাইনি মূলত কোন আত্মা নয়, এরা জীবিত নারী। লোকসাহিত্যে সাধারণত বৃদ্ধ মহিলা যারা কালো জাদু বা ডাকিনীবিদ্যাতে পারদর্শী তাদেরকেই ডাইনি বলা হয়ে থাকে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, ডাইনিরা গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ধরে নিয়ে তাদের হত্যা করে এবং তাদের হাড়, মাংস ও রক্ত খেয়ে ১০০ বছর বেঁচে থাকে।
ব্রহ্মদৈত্য : এধরনের ভূত সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং এরা সাধারণত কারো ক্ষতি করে না। এ ধরনের ভূতরা হলো ব্রাহ্মণের ভূত। এদেরকে পবিত্র ভূত হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা দয়ালু ও মানুষকে অনেক উপকার করে থাকে। বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে এদের চরিত্র চিত্রায়িত হয়।
আলেয়া : রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে বা খোলা প্রান্তরে আলেয়া দেখা যায়। মাটি হতে একটু উঁচুতে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। লোককথায় একে ভৌতিক আখ্যা দেওয়া হলেও বিজ্ঞানীরা মনে করে গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের সৃষ্টি হয় তা থেকে আলেযার উৎপত্তি। এর ফলে জেলেরা ভুল বুঝে সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
বেঘোভূত : এরা হলো সেসব মানুষের আত্মা যারা বাঘের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। সাধারণত সুন্দরবন এলাকায় এধরনের ভূতের কথা বেশি প্রচলিত কারণ বাঘের অভয়াশ্রম হলো সুন্দরবন। এসব ভুতেরা জঙ্গলে মধু আহরণে আগত গ্রামবাসীদের ভয় দেখায় এবং বাঘের সন্নিকটে নিযে যেতে চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে এরা গ্রামবাসীদের ভয় দেখানোর জন্য বাঘের স্বরে ডেকে উঠে।
কানাভুলো : এ শ্রেণীর ভূতেরা পথিকের গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় এবং অচেনা স্থানে নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে মানুষ একই রাস্তায় বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে। ভূতরা কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছার পর তার শিকারকে মেরে ফেলে। এক্ষেত্রে শিকার তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এধরনের ভূতদের রাতে গ্রামের মাঠের ধারে পথের মধ্যে দেখা যায। শিকার সবসময একাকী থাকে বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হযে যায়।
ঝেঁয়ো পেত্নী : সাধারণত ঝাউগাছে এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে। ভরসন্ধ্যাবেলায় পথিক যদি একা একা সেই ঝাউবন বা জঙ্গল পেরুতে যায়, তখন তাকে ধরে ঝাউয়ের মগডালে চড়িয়ে দেয় এ জাতীয পেত্নীরা।
ডাকিনী : ডাইনি বুড়িদের অনুগত শ্রেণির ভূত। পাতিহাঁস খেতে খুব ভালোবাসে এরা। থাকে পুকুর বা দীঘির ধারে কোনো তাল বা নারিকেল গাছে। রাতদুপুরে মেয়ের বেশে ঘুরে বেড়ানো এদের অন্যতম অভ্যাস।
ভূত শুধু বাংলাসাহিত্যে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার সাহিত্যে রযেছে। ‘ভূতের আছড়’ লেগেছে- এমনটি গ্রামবাংলায় শোনা যায়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে ভূতের অস্তিত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহেমন্তের গান
পরবর্তী নিবন্ধহলদিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট পরিদর্শনে বাবুল