ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২০ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

করোনা ভ্যাকসিন ও বিশ্ব পরিসি’তি
করোনার সাথে চিকিৎসা যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে যতদিন করোনা থাকবে, কিন’ করোনা প্রতিহত করার যুদ্ধ ভয়াবহ, কঠিন এবং বিভিন্ন মাত্রায় সফল। লকডাউন ব্যবস্থা বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে বাস্তবায়িত করেছে কেউ সফল, কেউ ব্যর্থ। কিন্তু এক বছর পর বোঝা যাচ্ছে যে, স্বল্প আয় বা উচ্চ আয় কোন দেশের জন্যই লকডাউন কার্যকর পন্থা নয়। করোনার প্রথমদিকে বিলাতে লকডাউন ব্যবস্থা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করেছিল। ওখানকার সরকার জীবিকা চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। পৃথিবীর অনেক দেশে মানুষ লকডাউন এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে আমাদের দেশে ২য় লকডাউন অনিবার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকান ব্যবসা করতে উদগ্রীব। তাহলে করোনা প্রতিহত করার আর বাকি থাকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা, সামাজিক দূরত্ব আর ভ্যাকসিন।
ব্যক্তিগত সুরক্ষা মানা না মানা জাতীয় সচেতনতা, চরিত্র, কালচার এর উপর নির্ভরশীল যেমন গত গ্রীষ্মে পুরো দক্ষিণ আমেরিকায়, স্পেনে ও খোদ আমেরিকান সমুদ্র সৈকতে পড়েছিল। মাস্ক বিহীন জনতা, এটা তাদের কালচার। জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনামে, চীনে জাতিগতভাবে সচেতনভাবে ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে, এসব দেশে করোনা প্রতিরোধে সন্তোষজনক অবস্থায় ছিল। আমাদের মত জনবহুল ও ঘনবসতির দেশে ব্যক্তিগত সুরক্ষা কঠিন ব্যাপার, কেউ কাউকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। বাইরে থেকে এসে অন্তত গরম পানির ‘ভাপ’ নিলে এ দ্বিতীয় ধাক্কায় পরিসি’তি এরকম হত না।
তাহলে বাকি থাকে ভ্যাকসিন সংগ্রাম, করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার ডাক্তারি ইতিহাসে এক অনন্য সাফল্য। অতীতে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে ২০ থেকে ২৫ বছরও লেগে গেছে। কোনো কোনো সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ভ্যাকসিন আবিষ্কার করোনার বিশ্বব্যাপী সংগ্রামে এক অনন্য সাফল্য স্বীকার করতেই হবে।
কিন্তু ফ্যাসাদ লেগেছে করোনা ভ্যাকসিনের সর্বজন প্রাপ্যতা ও মূল্যমান নিয়ে ৬টি অনুমোদিত ভ্যাকসিন ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে ১৮৪টি ভ্যাকসিন। ফেজ ওয়ান (সেফটি) ট্রায়াল আছে ৩০টি ভ্যাকসিন। ফেজ টুতে (বর্ডার পপুলেশন) আছে ২৮টি ভ্যাকসিন ২১ টি ভ্যাকসিন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লাইসেন্স অপেক্ষায় আরো ১৩টি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার আবেদন জানানো সত্ত্বেও গরিব দেশগুলোর ভ্যাকসিন পাবার সম্ভাবনা কম। একেতো মূল্য, তার উপর উৎপাদন সক্ষমতা ভ্যাকসিন ব্যবহারের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। ভ্যাকসিন প্রাপ্যতার সংগঠন GAVI এর চীফ এক্সিকিউটিভ শেট বার্কলির মতো ধনী দেশগুলোর বিশাল অঙ্কের অনুদান ছাড়া গরিব দেশগুলোর পক্ষে ভ্যাকসিন ব্যবহার অনিশ্চিত। বর্তমান মাত্র ১০০ টি দেশ ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে এটা হচ্ছে ভ্যাকসিন শুরুর ৪২ দিন পরের তথ্য। প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ডেলিভারি অফ ভ্যাকসিন পায় আফ্রিকার দেশ ঘানা, ২০২১ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি।
এখন দেখা যাক ভ্যাকসিন গুলোর দাম
১.এস্ট্রোজেনেকা—–২-৫ ডলার।
২. ফাইজার——১৯.৫ ডলার।
৩. মডার্ণা—-৩৭ ডলার।
৪. গামেলিয়া—১০ ডলার।
৫. সাইনোভাক—৩০ ডলার।
৬. সাইনো ফার্ম—৭২.৫ ডলার
ভ্যাকসিন গুলো বিভিন্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ ও বহনের উপরও দাম নির্ধারিত । সেই হিসাবে আমাদের দেশে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ব্যবহার যুক্তিযুক্ত।
ভ্যাকসিন এর সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী দেশ ভারতে ৮ এপ্রিল থেকে কয়েকদিন পুনাই ১০৯ টি কেন্দ্রে, উড়িষ্যায় ৭০০ কেন্দ্রে ভ্যাকসিন স্বল্পতায় মানুষ টিকা দিতে পারেননি। সর্বোচ্চ সংক্রমণের রাজ্য মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর রাজেশ টোপ সপ্তায় ৪৯ লাখ ভ্যাকসিন চাহিদা দিলেও পেয়েছেন ১৬ লাখ এটাই আসলে অধিকাংশ দেশের বাস্তব চিত্র।
এপ্রিল ৮ পর্যন্ত পৃথিবীর কয়েকটি দেশের ভ্যাকসিন ব্যবহার ছক দেওয়া হল:
ইজরাইল জনগণের ৬০%, ইউকে ৪৬%, চিলি ৩৬%, বাহারাইন ৩১% ইউএস ৩০% হাঙ্গেরি ২৩%, সার্বিয়া ২১%, উরুগুয়ে ২০%, জার্মানি ১২%, তুরস্ক ১১% ব্রাজিল ৭.৫% রাশিয়া ৪.৯৭% ভারত ৪.৫%।
ভারতে এই পর্যন্ত ছয় কোটি মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে। সমস্ত জনগণকে টিকার আওতায় আনা এক ভয়াবহ কাজ। এখানে আফ্রিকান দেশ নাইজেরিয়া তাদের ইবোলা ভ্যাকসিন ও হাম ভ্যাকসিন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কোন অঞ্চলে টিকা দেওয়া হবে এবং কত টিকা দেওয়া হবে তার একটা টেকনোলজি ব্যবহার করেছে, অর্থাৎ যেখানে ও যাদের মধ্যে প্রাদুর্ভাব বেশি প্রথমে তাদেরকে টিকা দিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা হচ্ছে। এর নাম GST বা geo-spatial technology আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে GST ব্যবহার হতে পারে জরুরি পদক্ষেপ হিসাবে।
কাজেই করোনা প্রতিরোধে লকডাউনসহ অনন্য পদক্ষেপগুলো ক্ষেত্র অনুযায়ী চালু রাখতে হবে। তবে প্রতিকারের মোক্ষম উপায় ভ্যাকসিন ব্যবহার ও প্রাপ্যতা জরুরি। এ ব্যাপারে দামও একটা বিষয়। তাই আমাদের দেশে কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি যারা ইতিমধ্যে কিছু ভ্যাকসিন তৈরির অভিজ্ঞতা আছে তাদেরকে সার্বিক সহায়তা করে দেশেই করোনা ভ্যাকসিন প্রস’তের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এটা এই মুহূর্তে করোনা প্রতিরোধের সহজ উপায়। তাহলে অধিক জনগণ ভ্যাকসিনও পাবে আর বিশ্বে রপ্তানি বিরাট সুযোগও আছে ইতিমধ্যে ভারতে ভ্যাকসিন তৈরির কাঁচামাল আমদানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা কিছু স্মৃতি, কিছু কথা
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে পানীয় জলের তীব্র সংকট