ভিন্ন উচ্চতায় চট্টগ্রাম বন্দরের ইমেজ

কুতুবদিয়ায় দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটি আনা হলো কর্ণফুলীর তীরে

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৭ মে, ২০২২ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

প্রায় আটশ কোটি টাকার পণ্য বোঝাই ১১শ টিইইউএস কন্টেনার বোঝাই ভিয়েতনামের পতাকাবাহী এমভি হাইয়ান সিটি জাহাজটি উদ্ধারের ঘটনা বিশ্বের শিপিং সেক্টরে চট্টগ্রাম বন্দরের ইমেজ ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কাৎ হয়ে যাওয়া ওই কন্টেনার বোঝাই জাহাজটিকে প্রায় ১৭ নটিক্যাল মাইল টেনে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে বন্দর চ্যানেলের একটি জেটিতে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি এখন সব ধরনের ঝুঁকিমুক্ত বলে মন্তব্য করে বন্দর সূত্র জানিয়েছে, শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে নয়, বিশ্বে এই ধরনের দুর্ঘটনা কবলিত জাহাজকে ঠিকঠাকভাবে উদ্ধার করার নজির খুব বেশি নেই।

বন্দর সূত্র জানিয়েছে, ভিয়েতনামের পতাকাবাহী কন্টেনার জাহাজ এমভি হাইয়ান সিটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেনার নিয়ে গত ১৪ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ১৭২ মিটার লম্বা জাহাজটিতে ৮শ’ কোটির টাকার রপ্তানিপণ্য বোঝাই এবং খালি মিলে সর্বমোট ১১০৫ টিইইউএস কন্টেনার ছিল। জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১৭ নটিক্যাল মাইল দূরে কুতুবদিয়ার কাছাকাছিতে গেলে বাংলাদেশী পতাকাবাহী এমটি ওরিয়ন এক্সপ্রেস নামের একটি তেলের ট্যাংকারের সাথে সংঘর্ষ লাগে। এতে কন্টেনার জাহাজটির একটি কন্টেনার ছিটকে সাগরে পড়ে যায়। সংঘর্ষে কন্টেনার জাহাজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পোর্টসাইডে কার্গো হোল্ডে ছিদ্র হয়ে সাগরের পানি ঢুকতে থাকায় জাহাজটি কাৎ হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে জাহাজটি ৭ ডিগ্রি কাৎ হয়ে যায়। একই সাথে কার্গো হোল্ডে পানি প্রবেশের কারণে জাহাজের ড্রাফটও বাড়তে থাকে এবং এটি ভারসাম্য হারাতে থাকে। সাড়ে নয় মিটার ড্রাফটের জাহাজটির ড্রাফট হয়ে যায় ১০.৭ মিটার; যা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কুতুবদিয়ায় বঙ্গোপসাগরে নোঙর করে রাখা জাহাজটি থেকে পণ্য বোঝাই কন্টেনার সরিয়ে নেয়ারও কোনো উপায় ছিল না।

বিষয়টি নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ একের পর এক বৈঠক করে। বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জাহাজের মালিক প্রতিনিধি, স্থানীয় এজেন্ট, সেলভেজ সংস্থা, পিএন্ডআই, নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান সমন্বয় সভা করেন। সভায় জাহাজটিকে বার্থিং দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ঈদের ছুটির মধ্যেই জাহাজটিকে টেনে নিয়ে আসতে দেশের শীর্ষস্থানীয় সেলভেজ কোম্পানি চট্টগ্রামের প্রান্তিক বেঙ্গল সার্ভিসের সাথে চুক্তি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

অবশেষে গত ৫ মে শুরু হওয়া অভিযানে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে কাৎ হয়ে যাওয়া জাহাজটিকে টেনে কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ের একটি ড্রাই ডক জেটিতে এনে বার্থিং করানো হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে ১০.৭ মিটার ড্রাফটের জাহাজ প্রবেশের কোনো রেকর্ড নেই। বন্দরের অনুমোদিত ড্রাফট হচ্ছে সর্বোচ্চ ৯.৫ মিটার। ১০.৭ মিটার ড্রাফটের এই জাহাজটিকে ঠিকঠাকভাবে ভিড়াতে এরই মধ্যে নদীতে প্রয়োজনীয় ড্রেজিংও করে ড্রাফট বাড়ানো হয়। পরে বন্দরের নৌ বিভাগের দক্ষ পাইলটিং, টাগ, স্থানীয় নৌ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেলভেজ কোম্পানি প্রান্তিক বেঙ্গল সার্ভিসের সহযোগিতায় কাৎ হওয়া জাহাজটিকে কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ের একটি ড্রাই ডক জেটিতে এনে বার্থিং করানো হয়। এই উদ্ধার কাজে চট্টগ্রাম বন্দরের টাগবোট, দুটি বিশেষায়িত পলিউশন কন্ট্রোল জাহাজ ছাড়াও প্রান্তিক বেঙ্গল সেলভেজ এন্ড ড্রাইভিং সার্ভিসের টাগবোট ব্যবহার করা হয়। শুধু ড্রাফটই বেশি নয়, ৭ ডিগ্রি কাৎ হয়ে থাকা এই ধরনের একটি জাহাজকে টেনে বন্দরের চ্যানেলে আনাটা অত্যন্ত ‘দুঃসাহসিক’ কাজ ছিল বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, বন্দরের ইতিহাসে এত বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানোর কোনো রেকর্ড নেই। এ ধরনের দুর্ঘটনা কবলিত জাহাজের উদ্ধার কাজ সুনিপুণভাবে সম্পাদন করার দৃষ্টান্ত বহির্বিশ্বেও বিরল। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সাহসী ও সময়োচিত সিদ্ধান্তের কারণে শুধু জাহাজের রপ্তানি পণ্যই নয়, বিশ্বের শিপিং সেক্টরে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতার চমৎকার একটি ম্যাসেজ গেছে বলেও মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, দুর্ঘটনা কবলিত এমন ঝুঁকিপূর্ণ একটি জাহাজকে সুনিপুনভাবে উদ্ধার করার মাধ্যমে বন্দরের স্বাভাবিক নৌ চলাচল রুটকেও রক্ষা করা হয়েছে। জাহাজটি ডুবে গেলে বন্দরের ইমেজ ক্ষুণ্নের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক নৌ চলাচলও ব্যাহত হতো। একই সাথে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি পণ্য রক্ষা পাওয়ায় দেশের গার্মেন্টস খাতও একটি বড় সংকট থেকে রক্ষা পেলো বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যডমিরাল এম শাহজাহানের নেতৃত্বে উদ্ধার অভিযানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমডোর মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান। এতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন নৌ বিভাগের উপসংরক্ষক ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদুল আলম, হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ও সহকারী হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ মোহাম্মদ কামরুল আলম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন
পরবর্তী নিবন্ধ১৮০ কন্টেনারে ঢুকেছে পানি