ভাষা সংগ্রামের একটি কবিতা ও ইতিহাসের প্রেস

আ.ফ.ম.মোদাচ্ছের আলী | রবিবার , ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশের ভাষা ছিল না। পশ্চিমাঞ্চলের সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পূর্ববঙ্গ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। পূর্ববঙ্গের অধিবাসি ছিল পুরো পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ। এই অঞ্চলের ভাষা ও সাহিত্য ছিল হাজার বছরের পুরনো। এই সংখ্যাধিক্যের উন্নত ভাষাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠি যখন একটি বিজাতীয় ভাষা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলো তখন ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন।

১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের শুরু। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং মাহবুবুল আলম চৌধুরীকে আহবায়ক করে চট্টগ্রামে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন শেখ মোজাফফর আহমদ, জহুর আহমদ চৌধুরী, এ টি এম শামসুদ্দিন, অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম, রুহুল আমিন নিজামী, ফজলুল হক বিএসসি, লাল আজিজ নামে খ্যাত আজিজুর রহমান, ছাত্রনেতা এমদাদুল ইসলাম, আবু জাফর যুবনেতা কৃষ্ণ গোপাল সেন, ডা সাঈদুর রহমান প্রমুখ। আওয়ামী মুসলিমলীগ নেতা এম এ আজিজ ও শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনুর রশীদ এই কমিটির যুগ্ন আহবায়ক ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দিন যখন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনরায় ব্যাক্ত করেন তখন সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্ররা সভা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং চলমান সংসদে স্মারকলিপি প্রদান করার ঘোষণা দেয়। এদিকে সরকার ওইদিন মিছিল সভার উপর ১৪৪ ধারা জারি করে যা ছাত্ররা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। এই আন্দোলনের উত্তাপ ঢাকার বাইরের শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার অনতিদূর নারায়ণগঞ্জ শহরে হরতাল পালিত হয়। সেদিন বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জীবনযাত্রা ছিল অচল। দিনভর হরতাল পালিত হয়। লালদিঘি ময়দান বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। শ্রমিকদের সেই জন্য নির্ধারিত সেই সভা পরিণত হিয় বিক্ষুব্ধ ও উত্তাল। ঢাকায় গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস তখন চট্টগ্রামে।একুশ তারিখ সমগ্র চট্টগ্রাম শহরের স্কুল কলেজে হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় বিকেল তিনটায় মিছিলে গুলি করা হয়। খোন্দকার ইলিয়াসের মাধ্যমে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আন্দরকিল্লা অফিসে খবর পৌঁছে যায়। মিছিলে ফুসে উঠে চট্টগ্রাম। এমনকি সেইসময় খাস্তগীর গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা মেয়েদের নিয়ে মিছিল বের করে। অগ্রভাগে ছিলেন জওশন আরা রহমান, হালিমা খাতুন প্রমুখ।

একুশের সেইক্ষণের স্মৃতিচারণ করে ভাষা সংগ্রামী মাহবুবুল আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য আমি, চৌধুরী হারুনুর রশীদ, আজিজুর রহমান সহ অনেকে বিভিন্ন এলাকায় সভা সমাবেশ করি। ২০ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন এলাকায় সভা সমাবেশ করে যখন অফিসে আসলাম আমার ১০৪ ডিগ্রী জ্বর, গায়ে জল বসন্ত। সারাদিনই আমি গায়ে জ্বর ও জল বসন্ত নিয়ে কাজ করেছি। কাজের উত্তেজনায় আমি এসব কিছুই অনুভব করতে পারিনি। অসুস্থতার কারণে আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় যখন ঢাকার গুলির খবর পেলাম অখন ‘ কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি শ্রুতি লিখনের মাধ্যমে লিখে ফেললাম। সন্ধ্যায় খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াছ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং আমার এই দীর্ঘ কবিতাটি পড়েন। তিনি বলেন, এটি অসাধারণ কবিতা। এটি ছাপিয়ে ২৩ তারিখের জনসভায় বিলি করতে হবে এবং আবৃত্তি করে শোনাতে হবে।’ এখানে উল্লেখ্য ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে লালদিঘির জনসভায়তেই ঘোষণা করা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পালিত হবে সাধারণ ধর্মঘট এবং বিকেল ৩টায় সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা।

খোন্দকার ইলিয়াছ কবিতাটি পুস্তিকাকারে ছাপার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তিনি স্বয়ং এবং উদয়ন পত্রিকার সম্পাদক রুহুল আমিন নিজামী ছাপানোর দায়িত্ব নেন। তারা আন্দরকিল্লা কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেসে কবিতাটি ছাপাবার ব্যবস্থা করেন। ঢাকা যখন শহীদের রক্তে রঞ্জিত ঠিক সেই সময়ে চট্টগ্রামে রচিত হয় রক্তের অক্ষরে লেখা একুশের প্রথম কবিতা। মাহবুবুল আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘রাতের শেষ প্রহরে কবিতার কম্পোজ ও প্রুফের কাজ প্রায় শেষ। গেলি বাঁধা হয়ে গেছে। মেশিন পরিষ্কারের কাজ চলছে। ফাল্‌গুনের ঝিরঝির বাতাসে ছিল শীতের আমেজ, তাই দরজা, জানালা টাইট করে বন্ধ করে সবাই চা খাচ্ছে। এমন সময় দরজায় টোকা মারার শব্দ, সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ দরজা খুলুন। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলেন পুলিশ প্রেসটিকে ঘিরে ফেলেছে। করিৎকর্মা প্রেসের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের উপর রাখা কবিতার প্রুফ কপি এবং মেটারসহ খোন্দকার ইলিয়াছকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখলেন। পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন এস পি আলমগীর কবির, প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন কবিরের ভাই। সদলবলে তিনি তন্ন তন্ন করে প্রেস ঘুরে ঘুরে দেখলেন। ব্যাপক হানা তল্লাশির পর পুলিশ যখন খালি হাতে ফিরে যায়, শ্রমিক কর্মচারীরা শুরু করেন তাদের অসমাপ্ত কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে। দুপুরের পর মুদ্রিত ও বাঁধাই হয়ে প্রকাশিত হয় পুস্তিকাটির প্রায় দশ হাজার কপি বিক্রয় ও বিতরণের জন্য। মাহবুবুল আলম চৌধুরীর কলমে সৃষ্টি একুশের প্রথম অমর কবিতার মুদ্রিত প্রকাশ ঘটায় ‘কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেস’। বীর চট্টগ্রাম আবারো বীরত্ব দেখায়। এই পুস্তিকাটির মুদ্রাকরের নাম ছিল দবির আহমদ চৌধুরী, প্রকাশক পাথরঘাটা অঞ্চলের পৌর নির্বাচনের কমিশনার প্রার্থী কামাল উদ্দিন আহমদ খান। মূল্য ছিল দু আনা।

২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩ টার লালদিঘির জনসভার এক পর্যায়ে চৌধুরী হারুনুর রশীদ দৃপ্ত কণ্ঠে কবিতাটি পাঠ করেন। স্লোগান ও করতালিতে প্রকম্পিত হয় লালদিঘির মাঠ। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে বিপ্লবী চট্টগ্রাম। সেদিনই সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কবিতা পড়ার অপরাধে চৌধুরী হারুন পরদিন গ্রেফতার হন। মাহবুবুল আলম চৌধুরীর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পুলিশ কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। কিন্ত চট্টগ্রাম, মাহবুবুল আলম চৌধুরী ও কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেসের নাম ইতিহাসের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায় যা বাঙালির অনাদিকালের গৌরবময় স্মৃতি হয়ে বার বার উচ্চারিত হবে।

লেখক: ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধঅর্থনীতিরও উদ্দীপক প্রয়োজন