ভালোবাসা: বিবর্তনীয় মনের জৈববৈজ্ঞানিক ভাবনা

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

‘কবরের মতো গভীর ডিভানে লুটিয়ে
মৃদু বাসে ভরা র’বে আমাদের শয্যা
সুন্দরতর দূর আকাশেরে ফুটিয়ে
দেয়ালের তাকে অদ্ভুত ফুল সজ্জা।’

বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে শার্ল বোদলেয়ারের এই কবিতা আমাদের প্রত্যেকের মনে এক সান্ধ্য সৌরভের কথা মনে করিয়ে দেয়। উল্লেখ করা ছাড়াই প্রত্যেকে তাদের মনের ভালোবাসাময় মানুষটির ছবি অজান্তে আঁকছেন। আদিযুগ থেকে ভালোবাসা শব্দটি যেমন সহজ তেমন জটিলতায় ভরা। তবুও প্রেম সকলের জন্যে নতুন সূচনা। এই প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে হয়েছে অনেক উপাখ্যান-উপন্যাস। সাহিত্যের যে-কোনো শাখায় ভালোবাসার আদি নিদর্শন পাওয়া যায়। চণ্ডীপাঠ থেকে রবি গুরু প্রত্যেকে লিখেছেন ভালোবাসার কথা, সাথে যুগে যুগে প্রশ্ন রেখে গেছেন ‘ভালোবাসা কারে কয়?’।

ভালোবাসা কি এবং কেন এর সংজ্ঞা খুঁজতে বিজ্ঞানীরাও তৎপর। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভালোবাসা মূলত ‘বিবর্তনীয় মনের জৈববৈজ্ঞানিক ভাবনা’।

প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ও বংশগতিবিদ থিওডসিয়াস ডবঝানস্কির বলেন,
‘বিবর্তনের আলোকে না দেখলে জীববিজ্ঞানের কোন কিছুরই আর অর্থ থাকে না।’ থিওডিয়াসের এই মূল্যবান কথার ফল পাওয়া যায় চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বে। ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাথে যৌনতা নির্বাচন নিয়েও দিয়েছেন তত্ত্ব। হাতি, ইঁদুর, শিম্পাঞ্জির মত মানব সমাজেরও যৌনতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া রয়েছে; যার আদি নিদর্শনের নাম ভালোবাসা। ভালোবাসার শব্দটির সাথে হৃদয় শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘ভালোবাসার উৎস হৃদয় নয় বরং মস্তিষ্ক।’ বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দুটি শাখা; বৌদ্বিক মনোবিজ্ঞান, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানে চার্লস ডারউইন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’ সাথে ‘যৌনতা নির্বাচন’ নিয়ে বলেছেন মূলত জিনতত্ত্বের ভিত্তিতে। আমাদের জিন নির্বাচন করে দেয় আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, অভ্যাস, চাহিদা ইত্যাদি। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও জিন সাহায্য করে।

আমাদের শরীরের বিশেষ কিছু হরমোন এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। দুজন প্রেমিক- প্রেমিকাকে যদি মুখোমুখি রেখে তাদের ‘এম আর আই’ করানো হয়, দেখা যায় তাদের শরীদের ডোপামিন হরমোন তখন অত্যধিক কার্যকর থাকে এবং তা তাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের সংকেত দেয়, যা তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে সহায়তা করে। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এবং সঙ্গীকে আকর্ষণ করতে কিছু কার্যকরী মাধ্যম হয়ে উঠেছে প্রধান হাতিয়ার। ময়ূরের পেখম, হরিণের শিং এসব তাদের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হলেও বিবর্তনের সূত্রে এগুলো রয়ে গেছে কারণ এসব যৌনতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ময়ূর কিংবা হরিণকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। কবিতা, গান, গল্প, চিত্রকর্ম ইত্যাদি মানুষের সৃষ্টিশীল কাজ হিসেবে বিবেচিত হলেও এসব প্রাকৃতিক যুদ্ধে মানুষকে কোনো সুবিধা দেয় না কিন্তু তবুও আদিকাল থেকে এসব টিকে আছে কারণ এগুলো সঙ্গীকে আকর্ষণ করতে সহায়তা করে। শুধু তাই নয় এগুলো ভালোবাসা কিংবা প্রেমের উদ্রেককারী হিসেবেও মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়। আমাদের শরীরে এক প্রকার ‘এম এইচ সি’ বা ‘হিস্টোকম্পিট্যাবিলিটি কমপ্লেক্স জিন’ আছে যা আমাদের ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পেতে সাহায্য করে। অর্থাৎ আমরা প্রেমে পড়ি তা যেমন সত্য তার পিছনের এই বৈজ্ঞানিক সত্যও লুকিয়ে আছে।

এই ‘এম এইচ সি’ বিভিন্নভাবে শনাক্ত করা যায়; যেমন আমাদের শরীরের গন্ধের মাধ্যমে। যে কোনো নতুন ব্যক্তির সাথে দেখা হলে যদি আপনি প্রেমে পড়েন তাহলে বোঝা যায় তার ‘এম এইচ সি’র মাত্রা আপনার সাথে মিলেনি বা কম অথবা বেশি। যাদের সাথে আমাদের ‘এম এইচ সি’ র মাত্রা মিলে যায় তাদের প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা একদম কম। তাই বিশ্ব জুড়ে আপন ভাই-বোন, বাবা-মাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করার হার দেখা যায় না কারণ একই জিন বহনকারীদের ‘এম এইচ সি’র মাত্রা প্রায় সমান। আরেক প্রকার হরমোন আছে যা পছন্দের সঙ্গীকে কাছে পেলে বেশি মাত্রায় বিক্ষিপ্ত হয় এবং যৌন সঙ্গীকে বেছে নিতে সাহায্য করে। এই হরমোনের নাম ‘ফেরোমন’। ফেরোমন হরমোন সঙ্গীর গন্ধকে মস্তিষ্কে কোড করে রাখতে সাহায্য করে। ইঁদুরের ক্ষেত্রে দেখা যায় এক বিশেষ প্রজাতির ইঁদুর তাদের সন্তান প্রসবের পর, বাবা ইঁদুর মা ইঁদুরের প্রতি বেশি ভালোবাসা দেখায়। কিন্তু যদি মিথাইল গ্রুপের এক হরমোন তাদেরকে দেওয়া হয় কিছু সময় পর সে বাবা ইঁদুর তার সন্তানদেরকে আর ভালোবাসা কিংবা আদর দেখায় না এবং মা ইদুঁরকে ছেঁড়ে চলে যায়। ভালোবাসা কেবল সুখ বয়ে আনে এমন নয়।

ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের পর থাকে প্রত্যাখানের ভয়। তবুও ভালোবাসা বাধা মানে না। হাজার ঝুঁকি পেরিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা মিলনে হয়ে উঠে তৎপর। এগুলো শুনতে সিনেমার কল্পকাহিনী মনে হলেও এর আছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখা। মিলনের পর নারী মাকড়সা পুরুষ মাকড়সাকে খেয়ে ফেলে, রাণী মৌমাছির সাথে একবার মিলনের আশায় পুরুষ মৌমাছি এগিয়ে গেলেও মিলনের পর মৃত্যু থাকে নিশ্চিত, এক প্রজাতির ইদুঁরের মিলনের পর পুরুষ ইদুঁরটি মারা যায় । এতসব কিছুর পরেও তারা ছুটে যায় সঙ্গীর কাছে। এর কারণ ‘জিংক জিন’ বা ‘স্বার্থপর জিন’ কাজ করে তাদের কর্মকান্ডের পিছনে। তাই অনেক কবির সুরে ভালোবাসা নিয়ে রয়েছে দুঃখের কাহন।

ভালোবাসার এই সাতকাহনে যুক্ত হয় আমাদের পরিবেশ সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিক ভাবনা। আমাদের জিনের পরিক্রমা কিংবা গঠন এমন যে, তা আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু পছন্দ-অপছন্দ তৈরি করে দেয়। মস্তিষ্ক যেমন আমাদের আলাদা করে দেয়, আমাদের সংস্কৃতিও আমাদের আলাদা করে। এর অন্যতম কারণ জিনের পুনর্বিন্যাস যা প্রাকৃতিক নির্বাচনেই হয়। তাই বিশ্বের একেক প্রান্তের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ একেকরকম। বিজ্ঞানীরা বলেন, ভালোবাসা মূলত সেটি যা আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের দিয়ে প্রকাশ করায়। ভালোবাসা নিয়ে প্রত্যেক প্রজন্ম তাদের নিজেদের ভাবনার প্রকাশ যেমন ঘটায় তেমন রয়েছে বিতর্ক। তবুও বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান বলে ‘ভালোবাসা এবং মন নিয়ে আমাদের এসব গবেষণা যদি বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে মিথ্যা প্রমাণ হয় তবেই জীববিজ্ঞান সফল কেননা ভালোবাসা এবং ভাবনার বিবর্তনই সত্য।’

ভালোবাসার বৈজ্ঞানিক সত্য হরমোন, জিনের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও ভালোবাসা কি কিংবা কেন এরচেয়ে বেশি সকলের কাছে ভালোবাসাই মুখ্য কেননা ভালোবাসার সংজ্ঞা না খুঁজেই আমরা প্রেমে পড়ি এবং সুন্দর মেরুন সান্ধ্য সৌরভে ভেসে বেড়াই। তাই অনেকেই ভালোবাসার সংজ্ঞা খুঁজতে নারাজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅন্য এক বেগম রোকেয়া
পরবর্তী নিবন্ধনিয়তি রানি ভট্টাচার্য্য