ভালোবাসায় ভাষা হোক সজীব

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

শহীদ মিনার-আজ সবার পথ এসে মিলে যাবে এই গন্তব্যে। হাতে হাতে বসন্তে ফোটা ফুলের স্তবক, কণ্ঠে চির অম্লান সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি…’ ধীর পায়ে এগিয়ে যাবে আবালবৃদ্ধবনিতা। ভাষা শহীদদের প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধার ফুলে ঢেকে যাবে শহীদ মিনারের বেদি। প্রতিটি বাঙালির প্রত্যাশা থাকবে, ‘আমাদের ভালোবাসায় ভাষা হোক প্রাণবন্ত সজীব’। আজ রোববার একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
প্রিয় বাংলা ভাষা কারোর দানে পাওয়া নয়। রক্তের দামে অর্জিত আমাদের এই ভাষা। বাঙালির বসন্ত মানেই একুশ আর আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো মায়ের ভাষার প্রতি ভালোবাসা। ফাল্গুন তথা ফেব্রুয়ারি ভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের মাস। মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার স্বীকৃতি আদায়ের মাস। মাতৃভাষা রক্ষার মাস। মায়ের মুখের ভাষার অম্লানতা রক্ষার লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার মাস।
নিজের ভাষাকে মানুষ ভালোবাসে। আর এ ভালোবাসা প্রতি মুহূর্তের। একটি নির্দিষ্ট দিনের জন্য তা সীমাবদ্ধ নয়। জন্মের পর থেকে যে ভাষায় মানুষ কথা বলে সেই ভাষার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই অন্যরকম ভালোবাসা তৈরি হয়। অজস্র ফুল, লাখো মানুষের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্য দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি সেই ভালোবাসার নিবিড় প্রকাশ দেখা যাবে। ‘একুশ’ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে মায়ের ভাষার জন্য মাথা উঁচু করে কামানের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। একুশ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে বুকের রক্ত দিয়ে মা ও মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে হয়। একুশ শিখিয়েছে মাতৃভাষার আন্দোলনের অন্তরালে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। একুশ শিখিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনা অস্থিমজ্জায় ধারণ করে কীভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হয়। তাই তো একুশের সিঁড়ি বেয়ে বাঙালি ৫৪-র নির্বাচনে, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রাণিত হয়েছে। তাই ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ কেবল আর দশটি স্লোগানের মতো গড়পড়তা রাজনৈতিক বুলি নয়। এটি বাঙালি চেতনার স্মারক, জাতীয়তাবাদের প্রেরণা এবং আমাদের জাতি চরিত্রের দৃঢ়তার প্রতীক।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জন্য শুধু একটি ঐতিহাসিক দিন নয়, আত্মপ্রকাশের মহাবিস্ফোরণ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাঙালির যেকোনো ইতিবাচক আন্দোলন-সংগ্রামের ভিত্তিভূমি হলো ২১ ফেব্রুয়ারি। আমরা সবাই জানি, মহান একুশের চেতনার অগ্নিপথে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আসামের বাঙালিরা ১৯৬৬ সালে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে। পুলিশের গুলিতে সেই আন্দোলনে ১১ জন বাঙালি শহীদ হন।
২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯০টি রাষ্ট্রে মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার দামাল ছেলেদের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে রফিক, বরকত, জব্বার, সালাম, শফিউর, ওয়ালিউল্লাহসহ নাম না জানা আরো অনেকের আত্মদানের কথা। শহীদ মিনার এখন শুধু এদেশের নয়, হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের সংগ্রামের, আত্মদানের স্মারক, বিজয়ের প্রতীক ও অনুপ্রেরণার উৎস।
শহীদ মিনার আজ কম্পিত হবে দেশ-বিদেশের লাখো মানুষের পদচারণায়। আজও যারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিজের ভাষাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে সংগ্রামরত, তারা বারবার স্মরণ করবে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতার সংগ্রামী চেতনাকে। উদ্বুদ্ধ হবে রক্তদানের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। তাই রফিক, সালাম, বরকতেরা আজ শুধু বাংলার সন্তান নন, তারা আজ বিশ্ববাসীর মনের কোঠায় অবস্থানকারী শ্রেষ্ঠ সন্তান।
দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের সব ভাষাভাষীর প্রেরণার উৎস। পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ভেদাভেদ ভুলে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আজ সরকারি ছুটির দিন। চট্টগ্রামসহ সারা দেশে প্রভাত ফেরি করে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। এদিন সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
সিএমপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। পুষ্পস্তবক অর্পণে প্রতিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৫ জন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। ব্যক্তি পর্যায়ে একসাথে সর্বোচ্চ ২ জন উপস্থিত থাকবেন। শহীদ মিনারে প্রবেশের ক্ষেত্রে সকলের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। প্রয়োজনে দায়িত্বরত স্কাউট/গার্লস গাইড/রোভার/স্বেচ্ছাসেবক থেকে শহীদ মিনারে আগত ব্যক্তিরা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক সংগ্রহ করবেন। যেকোনো ধরনের ব্যাগ বা সন্দেহজনক বস্তু নিয়ে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা যাবে না।
শহীদ দিবস উপলক্ষে নগরীতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
চসিক : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিটে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর পুষ্পমাল্য অর্পণ, সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান ভবন, আঞ্চলিক কার্যালয়, ওয়ার্ড অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত সকল প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা ও কর্পোরেশনের পতাকা অর্ধনমিতকরণ, সকাল সাড়ে ৯টায় লালদীঘি পাড় পাবলিক লাইব্রেরি হলে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এতে সিটি কর্পোরেশন ও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীগণ অংশগ্রহণ করতে পারবে। ‘ক’ বিভাগে নার্সারি থেকে ৩য় শ্রেণি, ‘খ’ বিভাগে ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি এবং ‘গ’ বিভাগে ৭ম থেকে ১০ম শ্রণি। ১১টায় আলোচনা সভা। একইদিন বাদ জোহর ও আছর ভাষা শহীদের রুহের মাগফেরাত কামনায় কর্পোরেশনভুক্ত মসজিদসমূহে দোয়া ও বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ আবৃত্তিশিল্পী সংসদ : বাংলাদেশ আবৃত্তিশিল্পী সংসদ সকালে জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ভাষা শহীদদের স্মরণে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এছাড়া ‘একুশের প্রথম প্রহর’ শীর্ষক অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এটা আবৃত্তিশিল্পী সংসদের প্রথম আয়োজন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সাংবাদিক, কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরী।
লেখক শিবির চট্টগ্রাম জেলা : বাংলাদেশ লেখক শিবির চট্টগ্রাম জেলা শাখা আজ সকাল ৮টা থেকে প্রতিরোধের গান, স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, আলোচনা ও মূকাভিনয়ের আয়োজন করেছে।
পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুল ছাত্র সমিতি : পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুল ছাত্র সমিতি সকাল ৯টায় প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দীন ও ডা. মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে পাহাড়তলী শাহজাহান মাঠ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাত পেতে নয় আত্মমর্যাদা নিয়ে চলব : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধশ্যালিকার বিয়ে শেষে বাড়ি ফেরা হলো না মুন্নার