ভারতে বিডিএফ গেরিলা প্রশিক্ষণের গতি-প্রকৃতি ও পরিচিতি

করিম আবদুল্লাহ | রবিবার , ১৯ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

মুজিবনগর সরকার পাকিস্থানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ভারত সরকারের সহায়তায় এক লক্ষ সদস্যের একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এদের মধ্যে ৭০,০০০ হাজারকে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে এবং ৩০,০০০ হাজারকে নিয়মিত বাহিনী, স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। তবে বাহাত্তর সালে শোনা গিয়েছিল ভারত থেকে প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনীর মোট সংখ্যা ৯৫,০০০ হাজার। ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে ও পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে এরা সবাই মুক্তিফৌজ নামেই পরিচিত ছিল।

১৯৭১ সালে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ লে জেনারেল যে এফ আর জেকব বলেছেন– ‘অস্থায়ী সরকার ১০০,০০০ যোদ্ধা নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠনের চিন্তা করেছিল এবং গেরিলাদের জন্যে তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণই যথেষ্ট বলে মনে করেছিল। পক্ষান্তরে সুপ্রশিক্ষিত গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলতে চাইলে ছয়সাত মাস সময়ের মধ্যে ১০০,০০০ যোদ্ধা গড়ে তোলা তাদের জন্যে কঠিন হবে বলে আমাদের মনে হয়েছিল। আমরা ৮০০০ গেরিলার প্রশিক্ষণই অধিকতর বাস্তবসম্মত হবে বলে মনে করেছিলাম। এছাড়াও ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়ন ও আর্টিলারি ব্যাটারির জন্যে বেশ কয়েক হাজার রিক্রুটের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন ছিল’। অবশ্য এ বিষয়ে ভারত সরকার মুজিব নগর সরকারের প্রস্তাব অনুসারে বাস্তবসংখ্যক গেরিলা বাহিনী গঠন এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অনুসরণ করে।

বিডিএফ প্রশিক্ষণ: ভারতে যাওয়া সাধারণ ছাত্রযুবক যারা আওয়ামী লীগছাত্র লীগের নিচের কাতারের কর্মী বা সমর্থক পর্যায়ের ছিলেন, অথবা ছাত্র ইউনিয়ন, এন এস এফ (দোলন গ্রুপ)-এর নেতাকর্মী ছিলেন এদের অধিকাংশকে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ট্রাঞ্জিট ক্যাম্পসমূহের সাথে যুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। বিডিএফএ ভর্তি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন কার্যক্রম পরিচালিত হতো সেক্টর হেডকোয়ার্টার সমূহের মাধ্যমে। তবে এর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ছিল কলকাতার থিয়েটার রোডস্থ কর্নেল ওসমানীর সদর দপ্তর। চট্টগ্রাম জেলা থেকে বা ১ নং সেক্টর থেকে আওয়ামী লীগছাত্রলীগের কর্মীসমর্থকসহ স্বাধীনতার স্বপক্ষের অন্যান্য সংগঠনের যারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে গিয়েছে এদের অধিকাংশই হরিণা ট্রাঞ্জিট ক্যাম্প সংলগ্ন ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এ ট্রেনিং সেন্টারের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালিত হতো বিদ্রোহ করে ভারতে যাওয়া বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরএর নন কমিশন্ড অফিসারদের দ্বারা। ১ নং সেক্টরহেড কোয়ার্টারের পাশেই ছিল এ ১নং সেক্টর এলাকা থেকে আসা ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল এক সপ্তাহ। তবে সীমান্তে বাংলাদেশ বাহিনীর সাথে নিয়মিত যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্যে সীমান্ত এলাকা থেকে আসা কিশোরযুবকদেরকেও এখানে পৃথক ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এদের বেশিরভাগই ছিলো অছাত্র, কৃষিজীবীকর্মজীবী শ্রেণির। এদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিলো দ’সপ্তাহ।

এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ শেষে আওয়ামী লীগছাত্র লীগের কর্মীসমর্থকদের, একটা সাধারণ মেডিকেল পরীক্ষা পাস করতে পারলে; অনেককে ত্রিপুরার ওমপি নগর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে পাঠানো হতো। এখানে প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিলো এক মাস। এ প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হতো ভারতীয় সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে ও তত্বাবধানে। এখানে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষকদের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার সেনাবাহিনী থেকে তিনজন প্রশিক্ষকও ছিলেন। ভারতীয় প্রশিক্ষদের দ্বারা হাল্কা অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের বোমা তৈরি ও বিস্ফোরণ ঘটানোর বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হতো এখানে। এগুলো ছিল মূলত বোমা বিষয়ে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ। এ ছাড়া রেইড, এটাক, বেয়নেট ফাইট, এমবুশ, জাঙ্গাল প্যারেড ইত্যাদির প্রশিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত ছিল। গেরিলাযুদ্ধের এসব কলাকৌশল ও বোমা তৈরি ও বিস্ফোরণ ঘটানোর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ছিল মূলত নোটনির্ভর। এ কারণে খাতা কলমহীন প্রশিক্ষণার্থীরা দেশে ফিরে খুব কম সংখ্যকই প্রশিক্ষণ নেয়া বিষয় যথাযথভাবে স্মরণে রাখতে এবং অপারেশনে প্রয়োগ করতে পেরেছিল। স্বাধীন বাংলার সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রথম দিন অরিয়েন্টেশন বক্তৃতা দান, ত্রি নট ত্রি রাইফেল ও এইচ ই৩৬হ্যান্ড গ্রেনেড প্রশিক্ষণ দানের দায়িত্বে ছিলেন। ওম্পিনগর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি চালু হয়েছিল মে মাস থেকে।

বিডিএফ প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী গেরিলা যোদ্ধারা পূর্বপাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে অনেকে গেরিলা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল আবার অনেকে স্বাধীন বাংলার সেনাবাহিনীর সাথে সীমান্তে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়মিত যুদ্ধে নভেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া মিত্র বাহিনীর প্রচলিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।

চট্টগ্রাম শহরে প্রথম প্রবেশ করা আবদুর রহমান গ্রুপ ছিল হরিণা কেম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিডিএফ গেরিলা দল। গ্রুপ হিসেবে চট্টগ্রাম শহরে সব চাইতে বেশি অপারেশন সার্থকভাবে সম্পন্নকারীজিন্নাহ গ্রুপও ছিলো বিডিএফ গ্রুপ। এই গ্রুপের সব সদস্যই হরিণা ক্যাম্প থেকে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল।

প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে এসে সবাইকে রিপোর্ট করতে হতো অর্থাৎ সেক্টর হেড কোয়ার্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার তাঁবুর নিচের টেবিলের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের আগমন ও উপস্থিতি স্বাক্ষর করে জানাতে হতো। হরিণায় ভারত সরকারের দেয়া চারপাঁচটি তাঁবুর নিচে ১ নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার গড়ে উঠেছিল। রিপোর্ট করার সাথে সাথে শুরু হয়ে যেত গ্রুপ গঠনের কাজ। ১ নং সেক্টর সামরিক হেডকোয়ার্টারের সাথে যুক্ত নেতৃস্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাদের তত্বাবধানে গ্রুপ গঠনের কাজ সম্পন্ন হতো। প্রতিটি বিডিএফ গ্রুপ গঠিত হতো সাধারণত এগার জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে। আর বিএলএফ গ্রুপ গঠিত হতো সাধারণত বারোজন গেরিলা নিয়ে। তবে বিশেষ পরিস্থিতে বিডিএফ ও বিএলএফ গ্রুপের সদস্য সংখ্যার তারতম্য ঘটতেও দেখা গেছে। ২০/৩০/৪০ বা ততোধিক সংখ্যক সদস্য নিয়েও গ্রুপ গঠিত হতে দেখা যেত। গ্রুপ গঠনের সাথে সাথে অই দিনই গ্রুপের চাহিদা অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র বুঝিয়ে দিয়ে দেশের ভেতরে যুদ্ধ করার জন্যে পাঠিয়ে দেয়া হতো। হরিণায় ছাত্রলীগের পক্ষে গ্রুপ গঠনের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা জালাল আহাম্মদ। আর আওয়ামী লীগের পক্ষে হরিণা ট্রাঞ্জিট ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ শিবিরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম,পি এএম এ হান্নান।

বিডিএফ গ্রুপের নামকরণ করা হতো: ব্যান্ড নং, ব্যান্ড নং২ এভাবে। বিএলএফ বা বিডিএফ গ্রুপে একজন গ্রুপ কমান্ডার হতেন এবং একজনকে ডেপুটি কমান্ডার করা হতো। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাই নিজেদের গ্রুপ গঠনের সুযোগ পেতেন। বিডিএফ গ্রুপগুলোতে গ্রুপ পরিচালনার ক্ষেত্রে, অপারেশন পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং অপারেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রুপভিত্তিক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে; যা বিএলএফ গ্রুপগুলোতে ছিল না।

উপরোক্ত ধারার প্রশিক্ষণের বাইরেও কিছু বিশেষায়িত প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছিল। যেমন নৌকম্যান্ডো প্রশিক্ষণ।

তথ্যসূত্র: . পাকিস্থানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে এক লক্ষ যোদ্ধা বাহিনী গঠনের তথ্যসূত্রSurrender at Dhaka: Birth of a Nation by Lt. Gen. J F R Jackob, page:` 42/91. ,The University Press Limited, Red Crescent Hose, Level 6, 61 Motijheel C/A.

. বিডিএফ প্রশিক্ষণ: লেখকের হরিণা ও অম্পিনগরে অবস্থানকালীন এবং প্রশিক্ষণকালীন নিজস্ব অভিজ্ঞতা।

লেখক: পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম অধ্যয়ন কেন্দ্র।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকত প্রাণ হলো বলিদান লেখা আছে অশ্রু জলে
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর