আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | রবিবার , ১৯ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে

ভিক্ষা না যেন যাচি’

বাংলাদেশে শিক্ষিত নারী যাঁরা জীবনে সফল হয়েছেন তাঁরা ‘নারী দিবস’ উপলক্ষে অনুষ্ঠান, আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ আনন্দ উৎসব, আলোচনা সভা প্রভৃতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনেক মূল্যবান কথা বলেন। কিন্তু যেসব নারীরা আজও সমাজের অন্ধকার জগতে বাস করছেন তারা আলোর সন্ধান পান না। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় সাধারণত ছোটবড় রেসেঁ্তারা, সংগঠনের নিজস্ব কক্ষে কখনো বা বিশাল সভায়। যেখানে সাধারণ নারীদের প্রবেশের তেমন সুযোগ হয় না। কাঁটা চামচ ছুরি দিয়ে চপ কাটলেট, চিকেন, চাইনীজ খেতে খেতে নারীদের সমস্যার আলোচনা শুনতে অনেকে হয়তো পছন্দ করেন। পৃথিবীর সব দেশের কথা বলতে চাই না, নিজের ছোট দেশটির কথাই বলছি আজও আমাদের দেশের গ্রামে গঞ্জে বেশির ভাগ নারী নির্যামিত, ব্যথিত ও সমাজের যাঁতা কলে পিষ্ট, তাহলে নারী দিবসের সার্থকতা উদযাপন করেও লাভ হচ্ছে না।

বাংলাদেশের স্বল্প শিক্ষিত বা উচ্চ শিক্ষিত নারী যাঁরা রয়েছেন বা যাঁরা উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন তাঁরা কেউ মসৃণ পথে হেঁটে জীবনে সফল হন নি। তাঁদের অনেক চড়াইউৎরাই পার হতে হয়েছে। এখনো একজন নারী উচ্চ শিক্ষিত হয়ে যদি নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন তখন তার মাবাবার রাতে ভালো ঘুম হয় না, কারণ মেয়েটির বয়স ত্রিশ পার হয়ে গিয়েছে অথচ সুপাত্রের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সুপাত্রের মায়েরা চান টুকটুকে ফর্সা সুন্দর কনে। খুব কমই শুনেছি কাউকে বলতে আমার ছেলের জন্য একজন উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে চাই। শ্যামলা চলন সই হলেই চলবে। সবাই ডানাকাটা পরীর মত পাত্রীতে আগ্রহী হন। মোটামুটি এসএসসি, এইচএসসি, বি এ পাস হলেই ভালো। কারণ কনের বয়স কম হলে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের কড়া কথা, অমানবিক নিয়মকানুন সহজে পালন করবে, চোখের জল ফেলবে কিন্তু মুখে কিছু বলবে না। এরকম কনে বেশির ভাগ স্বামীশাশুড়ির খুব পছন্দ। খুশি মনে বলেন ‘বৌমা খুব ভাল’ সকালের প্রাত:রাশ, দুপুরের খাবার, বিকেলের নাস্তা, রাতের খাবার সব বৌমা নিজ হাতে আয়োজন ও পরিবেশ করেন। পরিবারের সদস্যরা মহানন্দে খান আর নারী দিবসের সফলতা নিয়ে আলোচনা করেন সে সাথে ব্লাড প্রেশার অথবা ডায়বেটিসের কারণে অসুস্থ থাকেন। কারণ একটি পরিবারে সব সদস্য মিলে যে কোন ছোট বড় কাজে সহযোগিতা করা প্রয়োজন তা শিক্ষিত বা উচ্চবিত্ত পরিবার আজও যখন উপলব্ধি করতে পারেন না তখন সমাজের পরিবর্তন আসবে কি করে। এ কারণে অনেক মেধাবী ছাত্রী বিয়ে করে আর লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে পারেন না আবার অনেক চাকুরি রত নারী সংসার ও সন্তানের প্রয়োজনে চাকরিতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। আমাদের আশেপাশে এরকম দৃষ্টান্ত অহরহ দেখতে পাই। এসব সমস্যার সমাধান কি করে হবে জানি না। কারণ বাংলাদেশে নারী ও পুরুষদের বেশীরভাগ পোশাক পরিচ্ছদে আধুনিক কিন্তু মনের দিক থেকে তমসাচ্ছন্ন।

তবে আশার কথা সাধারণ নারীরা আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। ডানা কাটা পরী না হলেও অসুবিধা নেই। বরং লেখাপড়া করে শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত হয়ে স্বাবলম্বী হলে একজন নারীর সম্মান ও প্রতিপত্তি বাড়ে তা উপলব্ধি করতে পারছে। পোশাক শিল্পের কারখানা ও কৃষিকাজে কর্ম সংস্থানের সুযোগ পেয়ে সাধারণ নারীরা স্বাবলম্বী ও স্বাধীনভাবে জীপনযাপন করার সুযোগ পাচ্ছে। তবে যে কো কর্মসংস্থানে চাকরি করতে হলে স্বল্প শিক্ষিত অথবা উচ্চশিক্ষিত হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। জ্ঞান হলো আলোর মত। আলো না হলে চারদিক অন্ধকার, চারপাশের কিছু দেখা যায় না। ঠিক তেমনি লেখাপড়া না জানা থাকলে নারীরা সহজে দুষ্টু মানুষকে বিশ্বাস করে, বিপদে পড়ে, পিচ্ছিল পথে অজান্তে হাঁটতে থাকে, অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরোতে সাহস সঞ্চয় করতে পারে না।

নারীদিবসে অনেকে আলোচনা হয়। যারা স্বচ্ছল, কোটিপতি (সৎ বা অসৎ উপায়ে) তাঁরা সমাজের দুস্থ দরিত্র নারীদের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। সমাজ হচ্ছে নারী ও পুরুষের মিলিত ধারা। অনেকে সমাজের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেন। কিন্তু স্বল্প সংখ্যক মানুষের চেষ্টায় সমাজের পরিবর্তন হতে অনেক যুগ কেটে যাবে। আজকাল ধনীদের বিলাসিতার বহর অত্যধিক হয়ে গিয়েছে। পত্রিকায় দেখি কোটিপতিরা সবাই বিদেশে ঘরবাড়ি ও ব্যাংকে অর্থ রাখছেন। তাদের সন্তান ও নাতি নাতনি ভোগ করবে কিন্তু তিনি পরকালের জন্য পাথেয় কি রেখেছেন। করোনার দু:সময় কি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় না অতর্কিত বিপদ মুহূর্তের চিন্তা করার সময় দেয় না।

স্বল্পবিত্ত পরিবারের প্রধান সমস্যা সন্তানকে শিক্ষিত করার জন্য অর্থের অপ্রতুলতা। বর্তমান সরকার অনেক সহায়তা করছেন কিন্তু কোচিং, টিচার ও উচ্চশিক্ষাত ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে অনেকে বাধ্য হয়ে কন্যাকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। আমাদের আশেপাশে ও ঘরে বাইরে এরকম দুস্থ পরিবার রয়েছে। প্রতিটি সচ্ছল পরিবার যদি একটি দরিদ্র সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাহলে কিন্তু দেশের নিরক্ষতার সংখ্যাক্রমে হ্রাস পাবে।

নারীদিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই মনে মনে ভাবতে পারেন তিনি গত বছরে কতজন নারীকে সহায়তা করেছেন। বিভিন্নভাবে নারীকে সাহায্য করা যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে, চিকিৎসাক্ষেত্রে, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে নারীকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারেন।

বিন্দু বিন্দু জলেই সমুদ্র। তাই প্রতিটি মানুষের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা পারে যৌতুকপ্রথা, সন্ত্রাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। নারীদেরও সচেতন হতে হবে। এক সময়ে নারীদের স্বাস্থ্যের প্রতি বাঙালিরা উদাসীন ছিল। সচ্ছল পরিবারে মাছের মুড়ো, ডিম, দুধ, মিষ্টান্ন পিতা ও পুত্রকে দেয়া হতো। মা ও কন্যা মাছের লেজ কাঁটা, ডাঁটা চচ্চড়ি খেয়ে অপরিপুষ্ট শরীর নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতেন। আবার কটূক্তিও শুনতে হতো ‘কুড়িতেই বুড়ি’। তাই প্রতিটি পরিবারে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। পুত্র সন্তানের মত কন্যা সন্তানকে শিক্ষিত করতে হবে। নারীকে স্বাস্থ্য সন্ধন্ধে সচেতন হতে হবে। আধুনিক যুগের নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে হবে ও স্বাবলম্বী হতে হবে। তবেই নারী বলতে পারবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি/কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয়তুমি আছ, আমি আছি।’

টীকা: ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। দেশের সর্বত্র বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পাঠকের সংখ্যা কম। তাই বই কিনুন, বই পড়ুন ও বই উপহার দিন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধভারতে বিডিএফ গেরিলা প্রশিক্ষণের গতি-প্রকৃতি ও পরিচিতি
পরবর্তী নিবন্ধআবদুচ ছালাম : এক আলোর ফেরিওয়ালা