ভরা গাড়িতে ‘ভাড়াও দ্বিগুণ’

২২ দিন পর গণপরিবহন চালু দুপুরে দুঃসহ যানজট, অনেকক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৭ মে, ২০২১ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

এ যেন স্বাভাবিক এক শহর। করোনা নামের মহামারীর ভয় নেই। যানবাহন চলছে স্বাভাবিক গতিতে। কোথাও যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কোনো গণপরিবহনে, কোনোটি আবার চলছে নিজের মর্জি মাফিক। লকডাউনের কারণে ২২ দিন বন্ধ থাকার পর গণপরিবহন চলাচল পুনরায় শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। বৃহস্পতিবার (৬ মে) সকাল থেকেই নগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচলরত গণপরিবহনে এ চিত্র দেখা গেছে।
চলমান লকডাউনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচলের নির্দেশনা দেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল চট্টগ্রাম নগরীসহ সারা দেশে গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়। তবে কোনো গণপরিবহন জেলার সীমানা অতিক্রম করতে পারবে না। সকাল থেকে নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাসের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন যাত্রীরা। বিশেষ করে অফিসগামীরা সকালে যারা রাস্তায় বের হয়েছেন তারাই বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। এছাড়া যাত্রীর চাপ কিছুটা কম। বাসগুলোতে পাশাপাশি দুই সিটের একটি খালি রেখে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। কিন্তু সময় গড়াতেই বাসগুলোতে ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সিটতো ফাঁকা নেই, অনেক বাস মিনিবাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহনের চিত্রও চোখে পড়েছে।
সকালের দিকে নিয়ম মেনেই চলাচল : পলিটেকনিক্যাল মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষারত কাজল মিয়া বলেন, বাসের জন্য অপেক্ষায় রয়েছি। তবে আজ প্রথম দিন হওয়ায় মনে হচ্ছে বাসের সংখ্যা কম। এরপরও বাস চালু হওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। এদিকে, ইরান পরিবহনের চালক মামুন জানান, লকডাউনের কারণে আমাদের পরিবার নিয়ে চলতে অনেক সমস্যা হচ্ছিলো। এখন আমরা বাস চালানোর সুযোগ পেয়েছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা যাত্রী পরিবহন করছি এবং করবো। একইভাবে আল জিলানি পরিবহন, আমির ভান্ডার পরিবহনেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায়। এসব পরিবহনে দেখা গেছে, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী দুই সিটে একজন করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। সকাল থেকে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকায় পরিবহনের চালক ও হেলপাররা অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। এদিকে, স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কিনা তা দেখভালের জন্য পরিবহন মালিক কিংবা শ্রমিক সংগঠনের কাউকে দেখা যায়নি।
দুপুর গড়াতেই দুঃসহ যানজট : গণপরিবহন চালু হওয়ায় দুপুর হতে না হতেই অন্যদিনের চেয়ে বাস, প্রাইভেট কার, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, রিকশা, টেম্পু ও সিএনজি টেক্সির সংখ্যা বেড়ে যায়। বেলা ১২ টার দিকে নগরীর জিইসি মোড়, দেওয়ানহাট, আন্দরকিল্লা, লালদীঘির পাড়, নিউমার্কেট মোড়ে যানজট সৃষ্টি হয়। বহদ্দারহাট থেকে আগ্রাবাদ যাওয়া একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি জানতাম আজকে গণপরিবহন নামবে। সেজন্য সকাল সকাল বেরিয়েছি বাসা থেকে। কিন্তু যে অবস্থা দেখলাম পথে পথে যানজট। আমার আগ্রাবাদ আসতেই পাক্কা এক ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় লেগেছে। নিউমার্কেট মোড়ে সিএনজি চালক শামসু মিয়া বলেন, গত কয়েকদিন যাবতই রাস্তায় গাড়ি বেশি। আজকে সিটি সার্ভিস নামায় আমরা খুব বেকাদায় পড়েছি।
সরেজমিনে দেখা যায়, যাত্রীরা ঠেলাঠেলি করে উঠছেন বাসে। কোনো সিট খালি রাখা হচ্ছে না। দাঁড়িয়েও যাচ্ছে লোকজন। কারও কারও মুখে নেই মাস্ক। বেশিরভাগ বাসে যাত্রী ওঠানোর সময় চোখে পড়েনি কোনো জীবাণুনাশক স্প্রের। তবে দুই একটি বাসে স্প্রে ছিটিয়ে যাত্রীদের বাসে ওঠানো হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি গাড়িতে সিট ভর্তি করে ওঠানো হয়েছে যাত্রী। এসব তদারকিরও যেন কেউ নেই। যাত্রীরা বলছেন, বাসে ওঠার পর দেখতে পেয়েছি কোনো সিট নেই। একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমরা পাশাপাশি সিটে যাচ্ছি। এই সুযোগটি নিচ্ছে বাসের হেলপারা।
চালক হেলপারের থুতনিতে মাস্ক, নেই স্যানিটাইজার : চতুর্থ দফার কঠোর নিষেধাজ্ঞায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালু হলেও বেশিরভাগ পরিবহন শ্রমিকদের থুতনির নিচে মাস্ক শোভা পাচ্ছিল গতকাল। হরেক রকম অজুহাতে বেশিরভাগ চালক ও হেলপার নিয়ম মেনে মাস্ক পরেননি। সরেজমিনে দেখা যায়, বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের কথা থাকলেও, বেশিরভাগ পরিবহনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। বাসে স্যানিটাইজার নেই কেন জানতে চাইলে নিউমার্কেট মোড়ে দাঁড়ানো বাসের হেলপার নয়ন আজাদীকে বলেন, সকালে বাস রাস্তায় নামার আগে পুরো বাসের সিটে জীবাণুনাশক স্প্রে করেছি। পাশাপাশি দুই সিটের একটিতে যাত্রী নিয়ে অন্যটি ফাঁকা রেখে বাস চালানো হচ্ছে। কেউ দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন না। যাত্রীদের মাস্ক না থাকলে বাসে যাতায়াত করতে দিচ্ছি না। কিন্তু নিজের মাস্ক থুতনিতে কেন জানতে চাইলে লাজুক হেসে তিনি উত্তর দেন, এতক্ষণ পরা ছিলাম। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বলে একটু নামিয়েছি।
যাত্রীর সচেতনতা : নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি টাকা আদায় ও বাড়তি যাত্রী নিয়ে শহরে আসছিল ‘সুগন্ধা’ নামে একটি বাস। গাড়িতে থাকা যাত্রী মো. কুতুব উদ্দিন জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ‘৯৯৯’-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা চান। খবর পেয়ে ট্রাফিক পুলিশ কুতুব উদ্দিনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ওই গাড়িকে মইজ্জারট্যাক থামায় এবং মামলা দেয়। কুতুব উদ্দিন আজাদীকে বলেন, বলা হয়েছিল গাড়ির আসন সংখ্যার অর্ধেকের (৫০%) বেশি যাত্রী বহন করা যাবে না; সেখানে গাড়িতে তোলা হচ্ছে সিটের চেয়েও বেশি যাত্রী। এতেই থেমে থাকেনি, নিচ্ছে ডবল ভাড়াও। গাড়িতে ওঠার সময় হেলপার ভাড়া বলে ৮০ টাকা; যেখানে নিয়মিত লোকাল ভাড়া ৫০ টাকা। যেহেতু দুই সিটে একজন করে যাত্রী নিবে সেহেতু নিয়মিত ভাড়ার সাথে ৬০% ভাড়া যোগ হয়ে ভাড়া ৮০ টাকা হয়। কিন্তু গাড়িতে ওঠার পর দেখি ভিন্ন চিত্র। যাত্রীও দ্বিগুণ, ভাড়াও দ্বিগুণ। আমি প্রতিবাদ করাতে গাড়ির হেলপার আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। পরে আমি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ‘৯৯৯’ এ কল করি।
উল্লেখ্য, সমপ্রতি দোকান-পাট, শপিংমল চালু করা হয়। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে গণপরিবহন চালুর দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ করেন সড়ক পরিবহন শ্রমিকরা। পরে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে মহানগর ও জেলায় গণপরিবহন চলাচলের অনুমোদন দিয়ে প্রজ্ঞাপন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআরটিএ। নির্দেশনায় বলা হয়, আন্তঃজেলা গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। কোনোভাবেই মোট আসনের অর্ধেকের বেশি যাত্রী নেওয়া যাবে না। সমন্বয় করে ৬০ শতাংশ বাড়ানো ভাড়ার বেশি আদায় করা যাবে না। যাত্রার শুরু ও শেষে জীবাণুনাশক দিয়ে গাড়ি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। চালক, অন্যান্য শ্রমিক, কর্মচারী ও যাত্রীদের মাস্ক পরা এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করার নির্দেশও দেওয়া হয় প্রজ্ঞাপনে। এর আগে, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে ২০২০ সালের ২১ মার্চ থেকে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয় সরকার। দুই মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর গেল বছরের ১ জুন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্ত সাপেক্ষে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। তখন ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়। দীর্ঘদিন চলার পর করোনা সংক্রমণ একটু কমে এলে গত সেপ্টেম্বর মাসে শতভাগ আসনে যাত্রী নিয়ে চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। তখন থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত শতভাগ আসনেই যাত্রী নিয়ে চলছিল গণপরিবহন। পরে গত ৩১ মার্চ থেকে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়ায় অর্ধেক যাত্রী নিয়ে শুরু হয় গণপরিবহন চলাচল। এরপর বিধি-নিষেধের কারণে গত ৫ ও ৬ এপ্রিল বন্ধ থাকে গণপরিবহন চলাচল। অফিস খোলা রেখে গণপরিবহন বন্ধ রাখায় তীব্র সমালোচনার মুখে ৭ এপ্রিল থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আবারও গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে জারি করা কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে ৫ মে পর্যন্ত বন্ধ ছিল গণপরিবহন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধচার হাজার কোটি টাকায় প্রশস্ত হবে নগরীর ৬ রাস্তা