ব্ল্যাকমেইল করে তরুণীদের ভিডিও সংগ্রহ ও বিক্রি

পমপম টেলিগ্রাম গ্রুপের প্রধানসহ গ্রেপ্তার ৯

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৩ মে, ২০২৩ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আপত্তিকর ভিডিও ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে তরুণীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগে নয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। পুলিশের বিশেষ বিভাগটি বলছে, এই চক্রটি কৌশলে টার্গেট করা তরুণীদের ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট হ্যাক করে সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারলে তাদেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয় ভিডিও কলে নগ্ন অবস্থায় আসার। সেই প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ভুক্তভোগী তরুণীদের নামপরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে। অনন্যোপায় যেসব তরুণী ভিডিও কলে নগ্ন হয়ে আসেন, তাদের নিয়েই শুরু হয় অন্য বাণিজ্য। আপত্তিকর সেইসব ভিডিও চড়া মূল্যে দেশেবিদেশে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই ধরনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেক তরুণী আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন।

অনলাইনে এভাবে ভয়াবহ অপরাধের জাল বিস্তার করেছিল ‘পমপম’ নামে একটি টেলিগ্রামভিত্তিক গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার তরুণী এভাবে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আসছিল। চক্রটি মূলত চট্টগ্রামভিত্তিক। যদিও গ্রুপের বেশকিছু ‘এডমিন’ ঢাকায় থাকেন। তবে গ্রুপটির মূল নেতৃত্বে রয়েছেন চট্টগ্রামের এক তরুণ। অনলাইনে ওই তরুণ ‘মার্কসাকারবার্গ’ নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম আবু সায়েম। চট্টগ্রাম নগরীর চট্টগ্রামের লালখানবাজার এলাকায় তার বাসা। ২০ বছর বয়সী সায়েম চট্টগ্রামের শ্যামলী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল বিভাগে ডিপ্লোমা করেছেন। তার আগেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ভয়াবহ এই অপরাধের সঙ্গে। আবু সায়েমের ব্যাংক একাউন্টে ইতিমধ্যে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

সমপ্রতি তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখানবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে আবু সায়েমকে গ্রেপ্তার করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পরে চট্টগ্রাম নগরীর একটি হাউজিং এলাকা থেকে অভ্র এবং উখিয়া থেকে শাকিল নামের আরও একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া সায়েমের প্রধান সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমানকে কর্ণফুলী উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। একইসঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী জসিমকেও। সবমিলিয়ে চক্রটির মূলহোতা সায়েমসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মিয়া মোহাম্মদ আলী বলেন, বছরজুড়ে সিআইডির টিম সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অনলাইনে নজরদারির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় অভিযানও পরিচালনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলেন মো. আবু সায়েম ওরফে মার্ক সাকারবার্গ (২০), মো. মশিউর রহমান শুভ (২৬), মো. সাহেদ খান (২২), কেতন চাকমা (২০), মো. নাজমুল হাসান সম্রাট (২২), মো. মারুফ হোসেন (৩৪), শাহরিয়ার আফসান অভ্র (২৪), জুনাইদ বোগদাদী শাকিল (২০) ও মো. জসীম উদ্দীন (৩৮)

অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী বলেন, ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছিলেন, তাদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে ‘পমপম’ নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ গোপন ছবি ও ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে ব্লাকমেইল করছে, অর্থ দাবি করছে। অর্থ দিতে না পারলে ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করছে আর কোনো প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ভুক্তভোগীদের নামপরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্য টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিচ্ছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডির সাইবার পুলিশের একটি দল দেখতে পায় গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আদায় করে তাই নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশেবিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা আয় করেছে। তিনি বলেন, মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যান্ডের মত দেশের অসংখ্য মানুষ গ্রুপটির সদস্য হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এডমিনদের কাজ ছিল সায়েমের হয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট যোগাড় করা। নতুন কন্টেন্ট পেতে তারা ফেক এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করত। নতুন কনটেন্ট পেতে চক্রটির এখন এত কষ্ট করতে হচ্ছে না। কারণ ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকেরাই নতুন নতুন কন্টেন্ট দিচ্ছে। অর্থাৎ সুসময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তারা ক্যামেরাবন্দী করেছে, সেগুলোই প্রতিশোধের নেশায় তুলে দেয় মার্কসাকারবার্গদের গ্রুপে। মার্ক তার এডমিনদের দিয়ে সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করে তার গ্রুপগুলোতে। প্রমো দেখে যারা ফুলভার্সন দেখতে চায়, তাদের এক থেকে ২ হাজার টাকার প্রিমিয়াম সার্ভিস কিনতে হয়।

মোহাম্মদ আলী বলেন, সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে মার্কসাকারবার্গের বিভিন্ন পেজের এডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তার (সায়েম) সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা একং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া। মশিউর চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করেন। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী জসীমকেও।

সিআইডি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় এই গ্রুপগুলোর এডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। ফলে তাদের বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেট টুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেপ্তার হয় গুরুত্বপূর্ণ এডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।

সায়েম এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোয় সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। আর সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও এবং প্রায় ৩০ হাজার কন্টেন্ট রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাঝপথে থেমে গেল শাটল ট্রেন, পেছানো হলো পরীক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধপেকুয়ায় সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে হামলার শিকার ৪ সাংবাদিক