ব্লুমংক

(ঢাকার মিউজিকের গল্প)

কায়সার মোহাম্মদ ইসলাম | সোমবার , ২২ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

(শেষ পর্ব)

রাইন খোলা

রাইন খোলা নামটা শুনতে বড়ই অদ্ভুত শোনায়। আর ঢাকার মিরপুরের সাথে তুলনা করলে বড় বেমানানই মনে হয়।
হ্যাঁ এটা মিরপুর এক নাম্বারের শেষ মাথায়। সেতু ভাইয়ের বাসায় যেবার প্রথম গেলাম, তখন শাইনপুকুরের এ্যাপার্টমেন্টের পেছনের দিকটা পুরোপুরি জলমগ্ন ছিল, দেখতে দারুণ লাগছিলো। আমাদের শেষ বিকেল, সন্ধ্যা, রাত এভাবেই কাটলো। সেতু বলে যাচ্ছে, তার বড় ভাইয়ের গল্প। শরীফ ভাই এক সময় জার্মানী থাকতেন তার ছিলো এক জার্মান বান্ধবী… প্রচুর গান শুনতেন তিনি।
(আমি ভাবছি ‘রাইন নদী’ আর ‘রাইন খোলা’ নাম দুটির মাঝে কত অদ্ভুত মিল)
দেশে ফিরলেন ৮০ এর দশকের প্রথম দিকে। বাবার বড় ছেলে, সাথে ছয় বোন। সেতু ভাই তখনও মাত্র হাইস্কুলেরই ছাত্র। কিন্তু ব্যবসায় বসার মতন মন শরীফ ভাইয়ের থাকবে কই? চোখে মুখে যে ইউরোপের স্বপ্ন। … জয়নগর চাঁটগাঁর ঐতিহ্যবাহী পুরনো কলোনী। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেই জনশূন্য দুপুরে ভেসে আসছে ‘অ্যাবার’ গান। I have a dream অথবা, Dancing queen এর মতো অসাধারণ গান। একটু কাছেই একটি খ্রিষ্টান পরিবারের বাসা। খ্রিষ্টোফারের মা আইরিশ নারী। চাঁটগায় থিতু হয়েছে দুই পুরুষ ধরে। বুড়ো স্বামীর জন্য কফি বানাতে গিয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে কফির পেয়ালায়। রবার্ট সাহেব ব্যাপারটা দেখেছেন কিন্তু কিছু বললেন না। কারণ তিনি নিজের জীবন নিয়ে অসম্ভব সন্তুষ্ট। সামান্য জেলে পরিবারের সন্তান হয়ে তিনি স্রেফ ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে মেরির মতন সুন্দরী আধা আইরিশ আর আধা পর্তুগীজ মেয়েটিকে ঘরে আনতে পেরেছিলেন। সুতরাং মেরীর চোখের জল রবার্টের কাছে অমৃতের মতই।
মেরী নিজেকেই ড্যানসিং কুইনই ভাবে। আর এই সেভেন্টিনেই মেরী স্বপ্নের পুরুষ জর্জকে বিয়ে না করে অপরিচিত কৃষবর্নের ছোট খাটো রবার্ট দাসকেই বেছে নিয়েছিলেন জীবন সঙ্গী হিসেবে। আজ তারা ছয় সন্তানের পিতা-মাতা।
শরিফ ভাই যখন ‘অ্যাবার’ এলপিটা ছাড়ে তখন মেরী অপেক্ষা করতে থাকে ‘ড্যানসিং কুইন’ শোনার জন্য আর রবার্ট অপেক্ষা করে ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ গানটা শোনার জন্য।
এভাবে কেটেছে সেতু ভাইয়ের জীবন। একদিকে বিজিস, অ্যাবা, কারপেন্টার্স, এয়ার সাপ্লাই আবার অন্যদিকে চিন্ময়, সাগর সেন, হেমন্ত, লতার গানে।
মনে রাখতে হবে সেটা ছিলো ৮০’এর দশক। তখন বাজারে ভিসিআর এসেছে মাত্র। টিভি চ্যানেল বলতেই ছিলো শুধু বিটিভি। তাই রেকর্ড প্লেয়ারে গান শোনা আর ভিসিআরে সিনেমা দেখার মতো আনন্দ যেনো স্বর্গ সুখ।
সেতু ভাইয়ের বাবা নারায়ণগঞ্জের মানুষ পুরদস্তুর ব্যবসায়ী। কিন্তু ছেলে সন্তানদের সুখ তিনি ভালোই বুঝতেন। রঙিন টিভি, ভিসিআর, ডেকসেট, টয়োটা গাড়ি সবই তিনি কিনেছেন স্ত্রী সন্তানদের জন্যে। অন্যদিকে সেতু ভাইয়ের মা, পুরদস্তুর শিল্পী। লালন গীতি, নজরুল গীতি সবই তার নখদর্পনে। রেডিওতে নিয়মিত সংবাদ পাঠ করেন। ছেলেমেয়েরা সবাই তাকেই বেশি অনুসরণ করলেন।
এভাবে সময় চলে যায়। একদিন সেতু পাড়ি দেয় সিঙ্গাপুরে। তারপর আর মনে নেই, আমার শুধু মনে পড়তো সেই জয়নগরের সেতু এখন কোথায়? যার ছিলো অনেকগুলো কী-বোর্ড?
গত ২০১১ সনে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম পিয়ানো শিখানোর। একজন গোলগাল মানুষ আমার সাথে দেখা করতে আসলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আড্ডা বেশ জমে গেলো। পিয়ানো কোর্স নিয়ে আলাপ হলো। যাবার বেলায় তিনি আমাকে দেখে বললেন, আপনার চোখগুলো খুব চেনা চেনা লাগছে আর আপনার কণ্ঠস্বরও। তারপর আবিষ্কার করলাম ইনিই সে সেতু ভাই। বিশ বছর পরে আবার দেখা হলো ঢাকা শহরে বসে। আমাদের বন্ধুত্ব আবার জমে গেল। সেতু ভাইয়ের গান শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে উনি যখন কিবোর্ডের ডিফল্ট, ড্রাম্‌স, একম্পানিমেন্ট ছেড়ে `How deep is your love’ অথবা ABBA-এর ‘I have a dream’ গানটা পরিবেশন করেন। সেদিন কুরবানির ঈদের পরে আমার একসাথে অনেক গান করলাম। প্রিতু, সেতু ভাইয়ের মেয়ে ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে পুরো সময়টাই রেকর্ড করেছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে সেতু ভাইয়ের মাথায় যা বাজে তাই তিনি গাইতে অথবা বাজাতে পারেন। অনেকে বলে থাকেন- If you can’t hear it in your head, you can’t play it…. আর তার গান শোনার অভিজ্ঞতা এতো বিশাল ও বিচিত্র তা আসলেই
এই ইন্টারনেট যুগে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে তার মিউজিক্যাল প্যাশন হচ্ছে ৮০’ এর দশকের পপ মিউজিক। এই মিউজিকের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জীবনটাকে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন।
চাকুরী, স্ত্রী, কন্যা, বড় ভাইয়ের সন্তানদের নিয়ে সেতু ভাইয়ের জীবন আসলেই চমৎকার। ঢাকায় আমি অনেক মিউজিশিয়ানের সাথে মিশেছি কিন্তু মিউজিক্যাল মাইন্ড আমি খুবই কম পেয়েছি। তারা সবাই এতো বেশী আত্ম-অহাংকারী আর ইগো সচেতন যে প্রত্যেকটা মুহুর্তে নিজের অবস্থান রক্ষা করার জন্যে মাছির মতন সচেতন থাকে।
অথচ মিউজিক নিয়ে জীবনযাপন অনেক সুন্দর হতে পারে। শুধু নিজের রূপে মুগ্ধ না থেকে, অন্যের রূপে মুগ্ধ হওয়া অনেক সুন্দর একটা ব্যাপার। অথচ এই জায়গাটা বেশিরভাগ শিল্পীরাই এড়িয়ে চলে। সেতু ভাইয়ের সাথে গান এবং আড্ডা দুটোই আসলেই আনন্দের।

ব্লু মংক

‘ব্লু মংক’ হচ্ছে এমন একটি পিয়ানো পিস্‌ যেটি না শুনলে আমি আসলেই পৃথিবীর সঙ্গীতকে অনুভব করতে শিখতাম না।
যারা ‘ডেভ ব্রুবেক’ এর টেক ‘ফাইভ’ অথবা ‘ওয়ালার ফ্যাটস’-এর ‘Aint misbehavin’ অথবা ‘বিল ইভান্স’ আর ‘কিথ্‌ জ্যারেট’ এর Autumm Leaves শুনেছেন তারা হয়তো ‘থেলেনিওস মংক’-এর ‘ব্লু মংক’ শুনে অতোটা উল্লাসিত হবেন না। কিন্তু এটার যে সৌন্দর্যবোধ, শিল্পচেতনা এটার সাথে তুলনা করা সম্ভব শুধু পিকাসোর অসাধারণ চিত্রকর্মগুলোর সাথে।
প্রথম শুনলে যে কারো মনে হতে পারে এটাতো শিশুসুলভ অথবা খুবই আলাদা কিছু একটা।
এই আলাদা, একেবারে নিজের মতন কিছু একটা সৃষ্টি করতে পারাটা কতোটা ভয়ংকর রকমের কঠিন, সেটা শিল্প সাধনা না করলে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।
‘ব্লু মংক’ প্রথম প্রথম শুনে আমার ‘আলেক্সী ভন জুয়েলেন্সকির’ শিশুসুলভ পেইন্টিংগুলি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো।
কিন্তু তার কর্ড, হারমোনিতে যে বৈচিত্র্য সেটা এক কথায় অসাধারণ।
আর যত দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে এটা স্রেফ অন্য কিছু।
বলাবাহুল্য ‘বিল ইভান্স’, ‘কিথ্‌ জ্যারেট’ এরা অসাধারণ। কিন্তু ‘ব্লু মংক’ শুনে বুঝলাম এটা একটা শিল্পীর নিখুঁত ‘সেল্‌ফ পোর্ট্রেট’। প্রত্যেক শিল্পীর উচিত নিজের সেল্‌ফ পোর্ট্রেট আঁকাটাকে রপ্ত করতে শেখা, সেটা কলম দিয়ে হোক, কণ্ঠ দিয়ে হোক, অথবা পিয়ানো দিয়েই হোক।
এটা করতে হলে আয়নার সামনের মানুষটাকে বলেছি তোমাকে প্রথমে সন্ন্যাসিই হতে হবে।
হ্যাঁ সন্ন্যাসির সাধনা খুব জরুরী নিজেকে জানতে, চিনতে, আঁকতে।
আর শিল্পচর্চার অন্য নাম হতে পারতো দুঃখচর্চা। মানে আপনার মাঝে কষ্ট জিনিসটা থাকতেই হবে। না হলে কষ্টের দোকান থেকে কষ্ট কিনতে হবে যেটা অসম্ভব। অনেককেই দেখছি শিল্প সাধনা করতে গিয়ে এতাটাই কষ্টকে বরণ করে ফেলেছেন যে পরবর্তীতে আসলে তারা আর শিল্পকে কিছুই দিতে পারেননি; ক্লান্তিকে বরণ করা ছাড়া, উল্টো নিজেই শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছেন! তাই বুঝতে হবে কতোটুকু কষ্ট ধারণ করলে মানুষ শিল্পী হতে পারে, আর কতো বেশি বা কম কষ্ট নিয়ে থাকলে শিল্পচর্চা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটার মাত্রা আপনাকেই অনুবাধন করতে হবে।
অসম্ভব দুঃখময় জীবন কাটিয়ে যে মানুষ অসাধারণ শিল্প সৃষ্টি করতে পারে ‘ফ্রেডেরিক শোপাঁর যাপিত জীবনটা ব্যাখ্যা করলেই অনুধাবন করা যেতে পারে। সদাই কন্টকময় জগতে অবস্থান করেও যে মহৎ শিল্পের জন্ম দেয়া সম্ভব তার একটা জলন্ত উদাহারণ ‘ভিন্সেন্ট ভ্যান গগ’। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা যেভাবে ‘ভ্যান গগ’ অথবা শোপাঁর যাপিত জীবন নিয়ে দু:খবোধ করি, তারা নিজারাই কি তাদের অতোটা হতভাগা ভেবে ছিলো? মোটেও নয়, আসলে তাদের কাছে জীবনের আড়ম্বরের চাইতে শিল্প সৃষ্টিটাই ছিলো মুখ্য। তারা জগতকে উপলব্ধি করেছে শূন্যতা অথবা অর্থহীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে তাই শিল্পটা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো একমাত্র উপায় রুপে, যা তাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে।
নজরুল, রবীন্দ্রনাথ অথবা জীবনানন্দের সাথে নিজেকে তুলনা করে লাভ নেই কারণ তারা জীবনের কষ্টগুলোকে হজম করতে পেরেছিলেন।
আমি অনেক ইংরেজির অধ্যাপক আর প্রতিষ্ঠিত মানুষ দেখেছি যারা অনেক গল্প, উপন্যাস লিখেছেন কিন্তু তার স্ব স্ব ক্ষেত্রে যতোটা উজ্জ্বল, তাদের সাহিত্য ততোটা অনুজ্জ্বল। একজন ইংরেজী পিএইচডি ডিগ্রীধারী মানুষের সাহিত্যে আমি আসলেই কিছুই পাইনি। শুধু বইয়ের ফ্ল্যাপে তার ছবি সমেত জীবন বৃত্তান্তটা ছাড়া; কীভাবে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী পেলেন এই জায়গাটাই যতোটাই মুখরোচক আর কি!
তবে অবশ্যই ব্যতিক্রম যাই থাকুক না কেন কষ্টহীন জীবন নিয়ে নতুন শিল্প সৃষ্টি অসম্ভব। তাই ‘থেলেনিওস মংকের’ মতন একজন স্ব-শিক্ষিত মিউজিশিয়ানকে অনেক পথ ঘাট পেরিয়ে আসতে হয়েছে। স্বীকৃতিও জুটেছে অনেক কষ্টে।
তাই বলছি ‘ব্লু মংক’ মানে নীল সন্ন্যাসী হতে হবে। নীল মানে দুঃখ, অর্থাৎ মানে দাঁড়াচ্ছে দুঃখের সন্ন্যাসী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ রক্ষার পাশাপাশি উন্নয়নও চালিয়ে যেতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধনাগরিক দায়