নাগরিক দায়

উন্নয়ন-সুশাসন

মোস্তফা কামাল পাশা | সোমবার , ২২ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

উন্নয়নের সাথে সুশাসন এবং নাগরিক দায়কে অবশ্যই জোড়াশব্দ হিসাবে ধরে নিতে হয়। যেসব দেশ উন্নতির শীর্ষে, সেখানে এই জোড়াশব্দ জড়িয়ে আছে। উন্নয়ন অভিযাত্রার বহর এগিয়ে নিতে সুশাসন এবং নাগরিক দায়ের সমন্বয় জরুরি। এতে দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ, লুট, দখলবাজি, দলবাজির খানাখন্দে উন্নয়ন বহরের গাড়ি আটকে পড়ে না। দরকার হয় না কোন বাইপাশ বা ওভারপাশও। অতিকায় উন্নত দেশগুলোর কথা বাদ থাক। কাছের পূর্ব এশিয়ায় ভিয়েতনামকে আমরা মডেল ধরতে পারি। ভিয়েতনাম স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশের অনেক পরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুগের বেশি সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে বিপ্লবী নেতা হো চি মিনের নেতৃত্বে। দেশটির প্রতি ইঞ্চি মাটি, অরণ্য, শহর, নগর, সবুজ মাঠ, পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় মার্কিন মিলিয়ন মিলিয়ন বোমা, গোলা ও রাসায়নিক অস্ত্র হামলায়। এশিয়ার অন্যতম ধান উৎপাদনকারী দেশটির সবুজ শস্যখেতের মাটির কয়েক ফুট গভীর পর্যন্ত পুড়ে যায় নাপাম বোমাসহ ভারী বোমা ও শেল বর্ষণে। বিষাক্ত গ্যাস বোমায় ছারখার করে দেয়া হয় শস্যখেত ও গহীন অরণ্য। কারণ জঙ্গলই ছিল তিয়েতকঙ গেরিলা যোদ্ধাদের মূল আশ্রয়।
দেশজুড়ে পোড়া ক্ষতের ঘা নিয়ে স্বাধীনতার পর মানুষের মুখে এক মুঠো ভাত যোগানের সাধ্য ছিল না নতুন প্রশাসনের। কিন্তু টানা যুদ্ধে ভিয়েতনামীদের দেশপ্রেম পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে যায়। সুশাসন এবং নাগরিক দায় হয়ে উঠে দেশটির উঠে দাঁড়ানোর সোনার চাবি! অতি দ্রুত অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ায় দেশটি। যুদ্ধের ক্ষত মুছে গেছে সবুজ আর উন্নয়নের অবিশ্বাস্য জোয়ারে। সাড়ে চার দশকে ভিয়েতনাম এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশ। বৃহৎ শিল্প, পোশাকখাত, পর্যটন, ইলেক্ট্রনিক, সমুদ্র পরিবহন ও জাহাজ শিল্পের আকর্ষণীয় হাব হয়ে উঠছে দেশটি। পোশাক খাতে রপ্তানিতে বাংলাদেশের সাথে কঠিন প্রতিযোগিতা দিচ্ছে। স্যামসাং-এর মতো দক্ষিণ কোরিয়ার জায়ান্ট কর্পোরেট বাংলাদেশ থেকে কারখানা গুটিয়ে বেছে নিয়েছে ভিয়েতনামকে। কূটনীতি ও অর্থনীতির ঘেরাটোপে সমকালীন বিশ্বব্যাবস্থা আটকে আছে। ভিয়েতনাম মতাদর্শে কমিউনিস্ট হলেও চীনের মত মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে। মুক্তবাজার অর্থনীতির ঝড়ো হাওয়া থেকে দূরে থাকা উদীয়মান অর্থনীতির দেশটির পক্ষে সম্ভবও না। স্বাভাবিক কারণে এক সময়ের সবচে বড় শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের রসায়ন দারুণ জমে উঠেছে। অন্যদিকে কঠিন যুদ্ধকালীন পরম সহায় চীন সরে গেছে দূরে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি উঠে দাঁড়ানোর পর মিত্র চীনের অন্যায় প্রভাব ও চাপ দেশটি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। নাগরিক ও প্রশাসনের পোক্ত দেশপ্রেমের ভিত টলানোর সাধ্য চীনের নেই। ভিয়েতনাম লাগোয়া সমুদ্রের মালিকানা নিয়েও তাদর বিরোধ তীব্র। সুযোগটা লুফে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু দু’পক্ষের সম্পর্ক পুরোপুরি কূটনৈতিক ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট। ভিয়েতনামের সার্বভৌমত্ব অথবা আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে ওয়াশিংটনের নাক গালানোর ন্যূনতম সুযোগ নেই। এরমাঝে বিপুল মার্কিন বিনিয়োগ এসেছে ভিয়েতনামে। পাইপ লাইনে আরো প্রচুর। টানা যুদ্ধ ও যুদ্ধজয়ের পর বড় শক্তিকে নিয়ে কীভাবে খেলতে হয়, ভিয়েতনাম ভালই জানে। সবচেয়ে বড় কথা দেশটির মূল ভিত হচ্ছে, দেশপ্রেম তথা নাগরিক দায়িত্ব। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, উন্নয়নে ভারসাম্য ধরে রাখার মত নেতৃত্বের প্রজ্ঞা। আমরা জানি মুক্ত বাজার তথা কর্পোরেট অর্থনীতির তীব্র স্রোত থেকে ছিটকে পড়ছে বহু মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত সবচেয়ে বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিসহ বহু উন্নত দেশে উদ্বাস্তু ও ক্ষুধার্ত মানুষ বাড়ছে। কিন্তু ভিয়েতনাম এমনটি নয়। প্রতিজন নাগরিকের খাদ্য, বাসস্থান নিশ্চিত করেছে দেশটি। জনশক্তিই দেশটির সবচে বড় সম্পদ। আয় বৈষম্যের ভেদরেখাও বাড়তে দেয়া হয়নি।

ফেরা যাক, নিজের অন্দরে। ভিয়েতনামের মত বাংলাদেশও যুদ্ধজয়ী জাতি। কিন্তু আমাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ খুবই সংক্ষিপ্ত। মাত্র ৯ মাসের। বিপরীতে ভিয়েতনামকে প্রবল বৈরি শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে সোয়া যুগেরও বেশি। স্বাভাবিক কারণে তাদের দেশপ্রেম কঠিন যুদ্ধের আগুনে পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে গেছে। বিপরীতে স্বল্পমেয়াদী যুদ্ধে আমাদের দেশপ্রেম ও জাতীয় দায়বোধ অঙ্কুর গজাবার সুযোগও দেয়নি। ফলে লোভ ভোগের কর্পোরেট দানব আমাদের গিলে ফেলেছে। জাতীয় দায় বা দেশপ্রেম ভোগী, লোভী ও কর্পোরেট দানবের রঙিন চটকদার বুলির বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড হয়ে ঝুলে গেছে। শেখ হাসিনার সরকার টানা সাড়ে ১২ বছর ক্ষমতায় থাকায় উন্নয়ন অভিযাত্রার ধারাবাহিকতাও থমকে যায়নি। অসংখ্য মেগা প্রকল্প যেমন, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, প্রশস্ত জাতীয় মহাসড়ক, কর্ণফুলী তলদেশে টানেলওয়ে, অসংখ্য বহুতল স্থাপনাসহ পুরো দেশ বিদ্যুৎ ও কানেকটিভিটির আওতায় চলে আসছে। সমানে বিশ্বের সব দেশকে হঠিয়ে প্রতি বছর বাড়ছে নব্য কোটিপতির সংখ্যাও। বিপরীতে দারিদ্র্যের হারও বাড়ছে দ্রুত। শুধু করোনাকালে আরো প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। জিডিপি, মাথাপিছু গড় আয় বাড়লেও আয় বৈষম্যে আকাশচুম্বী। যা কোনভাবেই সুস্থ অর্থনীতির লক্ষণ নয়। ভূঁড়ির মেদ স্ফীতকায় আর পুরো শরীর কঙ্কালসার করে রাখার মত উন্নয়ন মানে ভয়ঙ্কর আপদ। দুর্বল ভিত্তির উপর যেমন বহুতল টিকেনা, তেমনি আয় বৈষম্যের বিশাল ফাঁক বাড়তে থাকলে সকল উন্নয়ন অবকাঠামো ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা থাকছেই। পাশাপাশি ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, লুট,দখলবাজির মত দৈত্য নির্মুল করা না হলে উন্নয়নের ফানুস বাতি নিভে যাবেই। আশা করি, জাতীয় নেতৃত্ব সচেতন হবেন। সুশাসন ও নাগরিক দায় চর্চা ছাড়া কোন দেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ধরে রাখতে পারেনি, পারেও না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্লুমংক
পরবর্তী নিবন্ধদুস্থদের মাঝে ভ্যান ও সেলাই মেশিন প্রদান