ব্লুমংক

(ঢাকার মিউজিকের গল্প)

কায়সার মোহাম্মদ ইসলাম | সোমবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অমনি মিউজিক
অমনি মিউজিকের মুস্তাফিজ আমার অনেক পুরানো বন্ধু। সে আমাকে ফোন দিল, ‘পাভেল ভাই আগামীকাল সকাল ১০টায় আমাদের শো-রুমে চলে আসবেন; আমেরিকান জ্যাজ ব্যান্ড .. একটা ওয়ার্কশপ করবে, আপনি আমন্ত্রিত।’
সকাল ১০টায় ক্যাপসুল লিফ্‌টে ৩ তলায় উঠে দেখলাম এখনও কেউ আসেননি। শুধু দুইজন বিদেশী পিয়ানোর পাশে বসে আলাপ করছেন। নিও-মেন্ডিজ সাহেবের স্বাগত বক্তব্যের পরে, ব্যান্ডদলের চারজন সদস্য তাদের পরিচয়পর্ব শেষ করলেন। ট্রাম্পেট প্লেয়ার ক্রিস বায়ার্ন আর নাসেরের সাথে এরইমধ্যে পরিচয় ঘটে গেল চায়ের আড্ডায়।
অনেকে আসলেন, ঢাকার ষাট, সত্তর দশকের মিউজিশিয়ান থেকে শুরু করে এই যুগের কিছু মেটাল ব্যান্ডের ছেলে-মেয়েরাও যোগদিল ওয়ার্কশপে।
অনেক আলাপচারিতার পরে তারা বেসিক কিছু জ্যাজ-স্ট্যাডার্ড পরিবেশন করলেন। ঢাকার ছেলে সাদও তাদের সাথে পিয়ানো বাজালো। তার বাদন শৈলীকে তারা বেশ অভিনন্দন জানালো। এবার তারা শচীন কর্তার ‘রঙ্গীলা রঙ্গীলা’ গানটার ইন্সট্রুমেন্টাল ভার্সন বাজানো শুরু করলো।
সম্ভবত আমেরিকার কোন এক মিউজিশিয়ান ‘রঙ্গীলার’ Sheet Music টি অ্যারেঞ্জ করেছেন এবং তারা বার বার একইভাবে পরিবেশন করতে লাগলো।
মনে হচ্ছিল তারা আটকে গেলেন Staff Notation-এর ভেতর। আমি আর বাবু ভাই গানটাকে কতোভাবে পরিবেশন করা যায় সেটা দেখলাম। তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন এবং বায়ার্ন বলে ফেললেন, মিউজিক হচ্ছে ধারণ করার ব্যাপার। আমরা পাশ্চাত্যের যে-কোন জ্যাজ ষ্টান্ডার্ড গানকে অনেক ভাবে পরিবেশন করতে পারি। কিন্তু প্রাচ্যের সঙ্গীতের আত্মার সাথে আমাদের সম্পর্ক অনেক কম। তাই আমরা চাইলেও তেমন কোনো ইম্প্রোভাইজেশনে যেতে পারছি না।
আসলে সঙ্গীত হচ্ছে ধারণ করার মতন। একজন মানুষ হয়তো ভালো গিটার বা পিয়ানো বাজাতে পারে না কিন্তু তার সঙ্গীত বোঝার ক্ষমতা অনেক বেশি হতে পারে। এজন্য অ্যারেঞ্জারের একটা বড় ভূমিকা থেকে যায়। আহ্‌মেট নামে একজন তুর্কি আমেরিকান ছিলেন ‘রে-চালর্সের’ অ্যারেঞ্জার। ‘রে’ যখন কোন জায়গায় আটকে যেতেন তখন আহ্‌মেট তাকে গন্ডি থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করতেন।
আমাদের মিউজিশিয়ানদের জন্য অ্যারেঞ্জারের এখন বড়ই প্রয়োজন। ঢাকায় অনেককে দেখলাম, নিজেই গীতিকার, নিজেই সুরকার, নিজেই কম্পোজার আবার নিজেই বেইজ বাজাচ্ছেন কীবোর্ড দিয়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না এই ধরনের মিউজিকগুলো শুনতে যতোটা গতানুগতিক মনে হয় তার চেয়ে আরও বেশি বিরক্তিকরও বটে। এজন্য এখানকার মিউজিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের দিক থেকে দুর্বল। কারণ প্রতিষ্ঠিত কাউকে তো আঙ্গুল তুলে কেউ দেখিয়ে দিচ্ছেনা তাকে কি করতে হবে? এভাবে অ্যালবাম বের হচ্ছে, হবে… যেন সবাই সবার রূপগুণমুগ্ধ, নার্সিসাস!
শিল্পকলা
সন্ধ্যা ছয়টায় শিল্পকলায় আমি, মা, আপা হাজির হলাম। শুরুতেই নাচ, একটি নাচের গোষ্ঠীর সাথে সঙ্গীত পরিবেশন করতে উঠলেন আমেরিকান জ্যাজ ব্যান্ড…
এবার ক্রিস বায়ার্ন বললেন- এমন একটা গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে চাই, যেটাকে বলা যেতে পারে জ্যাজ মিউজিকের সবচেয়ে মৌলিক গান।

Summertime
George Gershwin

Summertime,
And livin’ is easy
Fish are jumpin’
And the cotton is high
Oh, Your daddy’s rich
And your mamma’s good lookin’
So hush little baby
Don’t you cry
One of these mornings
You’re going to rise up singing
Then you’ll spread your wings
And you’ll take to the sky
But until that morning
There’s a’nothing can harm you
With your daddy and mammy standing by
Summertime,
And the livin’ is easy
Fish are jumplin’
And the cotton is high
Your daddy’s rich
And your mamma’s good lookin’
So hush little baby
Don’t you cry

তিনি সবাইকে নিয়ে গানটি গাইলেন, তারপর গানটির Harmony, chord নিয়ে বিশদ কিছু সহজভাবে বুঝিয়ে বললেন।
ধীরে ধীরে তারা লুইস আমস্ট্রং, ডিউক অ্যালিংটন এর কিছু জনপ্রিয় গান (এখানে গান মানে শুধু কণ্ঠ সঙ্গীতকে বোঝানো হচ্ছেনা, ই্‌সট্রুমেন্টাল মিউজিকও) ও পরিবেশন করলেন। অনুষ্ঠানটি সবার মনে নতুন কিছুর স্বাদ দিল। এই ধরনের মিউজিক পাশ্চাত্যে হরহামেশাই পরিবেশিত হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে জ্যাজ মিউজিকের কোন স্পেস নেই বললেই চলে।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রচুর জ্যাজ ব্যান্ড আছে। জ্যাজ ফেস্টিবেলও আয়োজিত হয় সেখানে। আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এখন জ্যাজ এবং ব্লুজ এর মতন মিউজিকের চর্চা বড়ই প্রয়োজন। কারণ জ্যাজ হচ্ছে সঙ্গীতের চূড়া, আস্তে আস্তে পৃথিবীর সমস্ত মিউজিক জ্যাজ নামের গ্যালাক্সিতে একদিন মিশে যেতে বাধ্য হবে। এটা হচ্ছে মিউজিকের অ্যাসথেটিক সেন্সের চূড়া।
আমাদের গানে সুরের যে বৈচিত্র্য আর তালের যে সহজাত দোলা, তার সাথে জ্যাজ মিউজিক-এর কর্ড আর অ্যাসিমিট্রিক রিদমের সিন্‌থেসিস অবশ্যম্ভাবী।
এই ধরনের মিউজিকের উৎসাহ যত বৃদ্ধি পাবে ততই দেশের সঙ্গীতের মূলধারা বিবর্তনমুখী হবে। আমার মা বললেন, বহুদিন পর নতুন কিছু শুনলাম। আজ শিল্পকলার সিঁড়িতে শত শত তরুণ-তরুণীর ভিড়, সবাই অপেক্ষা করছে ব্রেখ্‌টল ব্রেখটের একটি নাটকের জন্যে।
আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশের নাট্যকলা, চিত্রকলা, কবিতা, সাহিত্য যতটা এগিয়ে গেছে গত দু’দশকে, পাশাপাশি সঙ্গীত চলছে ঠিক তার উল্টো দিকে।
নাটকের জন্য এতোজনের সমাবেশ আসলেই অসাধারণ। এই ক্রাউডটাকে কাজে লাগাতে পারলেই অনেক কিছু সম্ভব। কিন্তু জনগণকে তো কিছু দিতে হবে, তাহলে তারা উৎসাহটা ধরে রাখবে। নতুন নতুন মিউজিক না হলে কেনইবা সিডি কিনবে?
২০০০ থেকে ২০০৭/৮ পর্যন্ত এতো বেশি সিডি বের হয়েছে যার কোন ইয়ত্তা নেই। তখন যার যখন ইচ্ছে হয়েছে সেই অ্যালবাম বের করেছে। অর্থাৎ টাকা খরচ করে স্টার হতে চেয়েছে। তারপর মানুষ যখন বুঝতে শিখলো, এখানে আসলে কিছু নেই তখন মানুষ ঢাকার সিডিগুলোকে রিজেক্ট করেছে। এখন হাজারে যে দশটি ভালো কাজ হচ্ছে না তা নয় কিন্তু মানুষ এখন পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সিডি থেকে।
আরেকটি কথা না বললেই নয়, সব ধরনের সঙ্গীতের প্রচার-প্রসারের সুযোগ থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ: বাংলাদেশের সাউন্ডটেক, সঙ্গীতা, লেজার ভিশন প্রভৃতি কোম্পানিগুলো শুধু লুপ বেইজড ‘হাব্বি’ ঘরনার অ্যালবামগুলোকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
গত কয়েকবছরের ঈদে দেখা গেলো, হাব্বি, আরেফিন রুমির অ্যালবামের পাশাপাশি যতসব সিডি বেরিয়েছে সবগুলিই ঐ একই ঘরনার। আমার বন্ধু এরশাদুল হক টিংকু তো বলেই ফেললেন, ‘এই ঈদে প্রায় একশটিরও বেশি অ্যালবাম বেরিয়েছে অথচ শুনতে সবগুলিই এক।’ অর্থাৎ একই সফট্‌ওয়্যার, ‘রিজন’ না হয় অন্য কমন কিছু লুপ, ফিল-হারমোনিকা দিয়ে স্ট্রিং, কোয়াট্‌ট্রাট বাজানো হয়েছে। অথবা কমন কিছু বেইজ-প্যাটার্ন, এই আরকি। মানে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, শুধু কণ্ঠ ছাড়া বাকি সব কিছুই প্রায় এক।
আমার কথা হচ্ছে একটি ঈদে ১০টি রক্‌ অ্যালবাম বের হলে, ৫টি হবে কান্ট্রি, ৫টি হবে ফিউশান, ২টি র‌্যাগে, ২টি জ্যাজ, ২টি রবীন্দ্র সঙ্গীত, ১০টি পল্লীগীতির অ্যালবাম। না হলে বৈচিত্র্যময় সঙ্গীতের জগৎ কিভাবে বাঁচবে? সবাই যদি শুধু রক আর হিপ্‌হপ্‌কেই পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে বাকীগুলোর কি হবে?
(চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধখেলাঘর : কুন্তলের নির্দেশনায় ইবসেনের নাটক