খেলাঘর : কুন্তলের নির্দেশনায় ইবসেনের নাটক

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব নাট্যজগতে হেনরিক জোহান ইবসেন এক জনাদৃত নাম। তাঁর রচিত বিভিন্ন নাটক বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বজুড়ে মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে প্রায় দু’শো বছর ধরে। নরওয়ের এই নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর জীবদ্দশায় সারা বিশ্বের হয়ে উঠতে পেরেছিলেন মূলত তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের সর্বজনীনতার কারণে। বিশেষ করে কয়েকটি নাটক এনিমি অফ দ্য পিপল, ডটার এবং এ ডল’স হাউজ। “এ ডল’স হাউজ” নাটকটি বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই নাটক অবলম্বনে লেখা হয়েছে উপন্যাস। নির্মিত হয়েছে বেতার নাটক এবং চলচ্চিত্র। তবে মঞ্চনাটকই বেশি। মনে হয় নাটক চর্চাকারী এমন কোনো শহর নেই, যে শহরে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়নি কিংবা হচ্ছে না। ঠিক এই সময়ে চট্টগ্রাম শহরে দু’টি নাট্যদল দু’টি মঞ্চে নাটকটি দু’টি ভিন্ন নামে ও আঙ্গিকে মঞ্চায়ন করছেন। আমাদের আজকের আলাপ কুন্তল বড়ুয়া নির্দেশিত ‘খেলাঘর’ নিয়ে। যেটি মূলত মঞ্চস্থ হচ্ছে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি ও থিয়েটার ইন্সটিটিউট চট্টগ্রাম মঞ্চে।
হেনরিক ইবসেন “এ ডল’স হাউজ” নাটকটি লিখেছিলেন ১৮৭৯ সালে। নাটকটি তিনি নরওয়েজিয়ান এবং ডেনিশ দুই ভাষাতেই রচনা করেন। ১৮৭৯ সালেই নাটকটি মঞ্চস্থ হয় প্রথমে নরওয়েতে। দুর্দান্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করে ‘আ ডল’স হাউজ’। এরপর ডেনমার্কসহ অন্যান্য দেশে নাটকটি ক্রমশ মঞ্চস্থ হতে থাকে বিভিন্ন ভাষায়। ধীরেধীরে নাটকটি বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে। বিশ্বজনীন বিষয়বস্তু নাটকটিকে বিশ্বব্যাপী আদরনীয় করে তোলার মূল কারণ। একেক দেশে একেক নাট্য নির্দেশকের হাতে আঙ্গিকের বৈবিধ্যে ও বৈচিত্র্যে বিভিন্ন শৈলিতে নাটকটি মঞ্চায়িত হলেও মূল বিষয়বস্তু স্থান কাল পাত্র ভেদে অবিকল থাকে। কারণ, নারীর উপর পুরুষের অন্যায় আধিপত্য ও নারী স্বাধীনতা হরণ কিংবা নিয়ন্ত্রণের চিত্র বিশ্ব জুড়ে এক।
নতুন আঙ্গিকে এই নাটকটি চট্টগ্রামে মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে কুন্তল বড়ুয়ার নির্দেশনায় ‘খেলাঘর’ নামে। অনুবাদ শংকর বসুঠাকুরের। নির্দেশক কুন্তল অনুবাদটি সম্পাদনা করে নিয়েছেন এদেশের এবং বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে। ফলে নাটকটি আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। খেলাঘর প্রযোজনার দায়িত্বে রয়েছে নতুন নাট্যদল-কথাসুন্দর। দলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন কুন্তল বড়ুয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা এই দলে কাজ করছেন। মঞ্চে ও নেপথ্যের কলাকুশলী নাট্যকলা বিভাগের উত্তীর্ণ ও অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। ফলে একটা ল্যাবরেটরিধর্মিতা রয়েছে এই গ্রুপে। এই ধারাটি দল ও বিভাগ দু’য়ের জন্যেই প্রয়োজনীয় এবং আশা করি এটা অব্যাহত থাকবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কুন্তল বড়ুয়ারও একটা দায়বদ্ধতা অবশ্যই এর নেপথ্যের পরিকল্পনা হিসেবে কাজ করেছে। কুন্তল বড়ুয়া কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলায় সম্মান ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়ন করেছেন। পড়াশোনার শেষে ১৯৯৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। শিক্ষকতাকালীন সময়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘চাকমা সম্প্রদায়ের নাট্যচর্চা’- এই অভিসন্দর্ভ নিয়ে পিএইচডি করেন। কুন্তল বর্তমানে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর নাট্যচর্চা তরুণ বয়স থেকে। গণায়ন ও কালপুরুষ নাট্যদলের সঙ্গে তরুণ বয়সেই যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে কাজ করেছেন থিয়েটার ওয়ার্কশপ চট্টগ্রাম, অ্যাক্ট ওয়ান, সাউথ এশিয়ান ইবসেন সেন্টার চট্টগ্রামের সঙ্গে।
কুন্তলের নির্দেশিত নাটক ; খেলাঘর (্‌এ ডল’স হাউজ, ইবসেন, থিয়েটার ওয়ার্কশপ চট্টগ্রাম ২০০০), বৃত্তের বাইরে (সন্তোষ চক্রবর্তী, অ্যাক্ট ওয়ান, ২০০০), এই ঘর এই বসতি (ডেথ অফ এ সেলসম্যান, আর্থার মিলার, রূপান্তর ম. সাইফুল আলম চৌধুরী, গণায়ন ২০১১), মুক্তধারা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গণায়ন, ২০১৭), ইচ্ছামৃত্যু রোজমরিশোল্‌ম, ইবসেন, সাউথ এশিয়ান ইবসেন সেন্টার চট্টগ্রাম ২০১৭)। ২০০১ সালে নাট্য বিষয়ক এনজিও বিটা’র ড্রামা ওয়ার্কশপ প্রযোজনা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’ অবলম্বনে কুন্তল নির্মাণ ও নির্দেশনা দেন ‘ঘোড়া’ নাটকের। ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে নির্দেশনা দিয়েছেন মাত্র ছয়টি নাটকের।
কারণ হিসেবে কুন্তলের বক্তব্য, ‘বাচিক অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমাদের প্রচণ্ড দুর্বলতা রয়েছে। পরিশ্রমেও অনাগ্রহ রয়েছে আমাদের। ফোক নাটক করা যায় সহজে। আঞ্চলিক সংলাপ। অভিনয় কম। এ ধরনের নাটক সংগীত বহুলও। কিন্তু আমার আগ্রহ রিয়ালিস্টিক বা বাস্তববাদী আঙ্গিকের দিকে। আন্ডারটোনাল ফর্ম। মানবমনের অন্তর্দ্বন্দ্ব, মানসিক জটিলতা, সূক্ষ্ম অনুভূতির বিশ্লেষণ আর সংশ্লেষণ এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। যেখানে চিন্তার অবকাশ থাকে বেশি। এসব ক্ষেত্রে বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়ে। এ কারণেই আমার একেকটি নাটক তৈরি করতে অনেক সময় লেগে যায়।’
২০০১ সালে বিটার ওয়ার্কশপ প্রযোজনা ‘ঘোড়া’য় কুন্তল বিভিন্ন নাট্যদলের অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়ে কাজ করেন। এ প্রসংগে তিনি বলেন, ‘আমি গ্রুপ থিয়েটারের প্রচলিত প্রথা ভেঙে বিভিন্ন দল থেকে কলাকুশলী ও শিল্পীদের নিয়ে একসাথে কাজ করতে আগ্রহী। ‘বৃত্তের বাইরে’ নাটকে ১৮টি দলের শিল্পী কলাকুশলী কাজ করেছেন। পেশাদার থিয়েটার থেকেও শিল্পীদের নিয়েছি। ২০০০ সালে থিয়েটার ওয়ার্কশপ থেকে যখন ‘খেলাঘর’ করি তখন গ্রুপ থিয়েটার শিল্পী দীপ্তা রক্ষিত লাভলীর বিপরীতে আমি কাস্ট করি পেশাদার থিয়েটার শিল্পী অলক কুমার দত্তকে।
২০২০ সালে কুন্তল তাঁর নবগঠিত নাট্যদল ‘কথাসুন্দর’ থেকে প্রযোজনা করছেন নতুন আঙ্গিকে তাঁর পূর্ব নির্দেশিত নাটক ‘খেলাঘর’। ২০ বছর পর নতুন আঙ্গিকে মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটকটি। স্বভাবতই শিল্পী কলাকুশলীদের প্রায় সকলেই নতুন। ফলে একটা স্বতঃস্ফূর্ত আবহ বিদ্যমান। যদিও অভিনয় ও আলোক প্রক্ষেপণে আরো সাবলীলতা প্রয়োজন।
নারীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, চাপা কান্না, যা পুরুষতন্ত্রের নিষ্পেষণে সৃষ্ট, তার বিরুদ্ধে নারীরই প্রতিবাদ ও রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা ইবসেনের নাটকের প্রতিপাদ্য, যার বৈশ্বিকতা এখনো প্রাসঙ্গিক। খেলাঘরেও বিষয়টি যথাযথভাবে ধরার চেষ্টা করেছেন। নির্দেশক তাঁর নাটকে কিছু সিনেমাটিক প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন যা ভালোভাবেই উতরে গেছে। যেমন ডিটেলস ও মন্তাজের ব্যবহার।
নাচ, পুতুলের দম দেওয়া এবং লেটার বঙের মাধ্যমে নাটকে মন্তাজ তৈরির প্রচেষ্টা খুবই ফলপ্রসু হয়েছে।
তবে প্রপস এবং কস্টিউমের দিকে আরো একটু নজর দেওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে নোরা (এ নাটকে মিসেস চৌধুরী) চরিত্রের কস্টিউম। তেমনি নাটকের প্রপস এবং সেট নাটকের বিষয়বস্তুর মতো আরো একটু সুসংহতি দাবি করে। মেকআপ খুবই বাস্তবসম্মত। শব্দ প্রক্ষেপণ কিছু কিছু জায়গায় খুব ভালো। বিশেষ করে বৃষ্টির শব্দ, যা ধীরে ধীরে তুমুল শব্দে রূপ নেয় যখন বিকাশ শেষ দৃশ্যে ঘরে ঢোকে। তবে বৃষ্টি শুরুর সময় বজ্রপাতের শব্দ ও আলোর প্রয়োগ রাখলে ভালোই হতো যেটা আমরা থিয়েটার ওয়ার্কশপের প্রযোজনায় দেখেছিলাম। এই এফেক্টটা নাটকে চমৎকার একটা মন্তাজ তৈরি করেছিল। তবে শেষ দৃশ্যে বিসর্জনের বাজনা একটা চমৎকার দ্ব্যর্থকতা তৈরি করে। সংগীত মাননসই।
নির্দেশক লেটার বঙকে একটি চরিত্র করে তুলতে পেরেছেন এটি তাঁর মুন্সিয়ানা। লেটার বঙটি নাটকে সাসপেন্স এবং টুইস্ট তৈরির ক্ষেত্রে চমৎকার ভূমিকা রেখেছে। এক্ষেত্রে টাইমিং এর ব্যাপারটিও লক্ষ্যণীয়।
নাটকের যেটি প্রাণ অভিনয় সেটাতে একটু সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। মিসেস চৌধুরী ও কমল সরকারের চরিত্রে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করেছেন নোভা চক্রবর্তী ও হিমাদ্রি শেখর রায়। ডাক্তার সেনের চরিত্রে শাশ্বত দত্ত শুভও যথেষ্ট সাবলীল। কিন্তু এদের তুলনায় বাকি তিনজন সমান তালে অভিনয় করতে সমর্থ হননি। বিশেষ করে বিকাশ চৌধুরী চরিত্রে ইউনুস রানা সোহেলের অভিনয় আরো স্বাচ্ছন্দ্য দাবি করে। যেহেতু চরিত্রটি এই নাটকের একটি প্রধান চরিত্র, কাজেই সংলাপ প্রক্ষেপণ এবং শারীরিক স্বচ্ছন্দতা তৈরিতে অভিনেতাকে আড়ষ্ট মনে হয়েছে। নাটকের আলোক প্রক্ষেপণে ছিলেন সুদীপ সান্যাল, সংগীতে দেবাশীষ রায়, নৃত্য ও কস্টিউমে প্রমা অবন্তী, শব্দে সুমেধ বড়ুয়া।
সব মিলিয়ে কুন্তল বড়ুয়া নির্দেশিত কথাসুন্দর প্রযোজনা ‘খেলাঘর’ আধুনিক প্রয়োগ সমৃদ্ধ একটি নাটক। আশা করি সামনের ক্রমান্বয় মঞ্চায়ন নিশ্চয়ই নাটকটিকে আরো স্বতঃস্ফূর্ততা আর সাবলীলতা এনে দেবে। খেলাঘর, কথাসুন্দর এবং কুন্তল বড়ুয়ার ক্রমাগত সফলতা কামনা করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্লুমংক
পরবর্তী নিবন্ধসাদার্ন ইউনিভার্সিটিতে ২৮তম একাডেমিক কাউন্সিলের সভা