ব্লুমংক

(ঢাকার মিউজিকের গল্প)

কায়সার মোহাম্মদ ইসলাম | সোমবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ধানমন্ডি

আজ আমি খুব একা। একা একা হাঁটছি মানিক মিয়া ঘেষা সংসদ ভবনের সামনে বিশাল ফুটপাতে। পুরো পথ জুড়ে ব্রিথিং করছিলাম। এক, দুই, তিন …। একটু সামনেই উঁচু ফুটপাত। এখানে অনেক মানুষের সমাগম হয়েছে। একটা কাপল হাত ধরে হাঁটছে। আরও কয়েকজন এক সাথে ফুচ্‌কা খাচ্ছে। আর পার্কিং স্পেসে নিজেদের গাড়িতে হাবিবের গান ছেড়ে দিয়েছে কয়েকজন … ভালো বাসবো রে বাসবো …। একজন বাবা তার ছেলেকে নিয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। অন্যদিকে এক দেহ-প্রসারিনী দুই তরুণ খদ্দেরের সাথে আলাপ করছে। তরুণ ছেলেগুলোকে প্রচণ্ড অস্থির দেখাচ্ছে। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে মেয়েটির বুকে। দু’তিন জন আলাপ করছে বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম নিয়ে। একজন জোর গলায় বলছে – যাই বলিস্‌্‌ তোরা – ‘সাকীব ইস এ গিফ্‌ট ফর বাংলাদেশ’।
আমি থামলাম এক কিশোর বাদামওয়ালাকে দেখে। প্রশ্ন করলাম তোমার বাড়ি কি ভৈরব ? সে উত্তর দিল, জ্বি না স্যার আমি সারা এহানে হগ্‌গলের বাড়িই ভৈরব।
দশ টাকার বাদাম নিলাম, গুনে গুনে দেখলাম বিশ/একুশটার বেশি হবে না। দশ বছর আগের সাথে তুলনা করে অবাক হলাম – আহা টাকার মান আর কতো নিচে নামবে ?
এই ধরনের জায়গা ঢাকায় আর নেই বললেই বলে। পাশ্চাত্যে এগুলোকে বুলেভার্ড বলে। আমার ধারণা এখানে কনসার্ট আয়োজন করা সম্ভব। মানুষ কনসার্টে আসবে, মানুষে-মানুষে ইন্টারেক্‌শন হবে।
মোবাইল ফোন বেজে উঠল – টবি ভাইয়ের ফোন – টবি ভাই প্রাণঢালা হৃদয়ে বললেন পাভেল তুমি কই? আমি বললাম এইতো আপনার কাছেই, তাহলে চলে আসো। আমি বললাম বিশ/ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই আসবো।
আড়ং এর সামনে ওভারব্রিজটা পাড় হলেই ধানমন্ডি। এখানকার ফুটপাতগুলো চওড়া, রাস্তাগুলোও প্রশস্ত, গুলিস্থান যেতে যতটা বিরক্তি লাগে ধানমন্ডি যেতে ততটা আনন্দ লাগে। আমার হাঁটার গতিও বেড়ে গেল।
ধানমণ্ডির ক্রিকেট একাডেমির মাঠে পৌঁছে স্বস্তি পেলাম, মানে টবি ভাইয়ের বাসায় চলে আসলাম। টবি ভাইয়ের বাসায় ঢুকতে আমার বুক ধরফর করে কারণ তার পোশা কুকুরটা। তার নামে রিংগো। তাকে দেখলেই আমার ‘উই আর ইন দ্যা ইয়োলা সাবমেরিন’ গানটার কথা মনে পড়ত – গানটা রিংগো স্টারের (বিটেল্‌স) জনপ্রিয় গান। সেটা দশ বছর আগের কথা। এখন সে আমার চরম শত্রু। আমাকে দেখলেই পুডেল গোছের কুকুরটা হয়ে উঠে হায়েনার মতন। টবি ভাই রিংগোকে আটকিয়ে রেখেছেন বেড়রুমে। আমি বড় বড় পা দিয়ে ঢুকলাম স্টুডিওতে। লম্বা চুলের সরফরাজ আমাকে দেখে ভীষণ খুশি। সে বলে উঠলো আফটার লং লং টাইম। পেছনে শান্ত ড্রাম বাজাচ্ছে। তার অট্টহাসি পুরো ঘরকে ছাপিয়ে গেল। টবি ভাইদের আড্ডায় কিবোর্ড/পিয়ানো প্লেয়ার নেই বললেই চলে। This mascarade গানটি আমি Caren Carpenters এর ভার্সনটি শুনেছি কিন্তু Leon Russel-এর টা শুনিনি। টবি ভাই Music Sheet বের করে দিলেন। আমি কিছুটা মিউজিক শিট ফলো করে আর বাকীটা নিজের মতো করে একটা কিছু বাজিয়ে দিলাম। এটা এক ধরনের সিনথেসিসই বটে। টবি ভাই মহাখুশি, তিনি বলে উঠলেন দারুণ হলো পাভেল।
সরফরাজ খুব যত্ন সহকারে হ্যাশ গুড়ো করে একটা চরশ বানিয়েছে। এটাকে সে জয়েন্ট বলে সম্বোধন করে। টবি ভাই জয়েন্টা জ্বালানোর সাথে সাথেই রুমে রিতুর প্রবেশ। সে হেসে বললো তোমাদের বয়েজ ক্লাবে কি একজন নারী জয়েন্ট করতে পারে না? সবাই সাজোরে বললো অবশ্যই। রিতু, সরফরাজের বান্ধবী থাকে নিউ অরলিন্সে মানে যেটাকে জ্যাজ মিউজিকের স্বর্গ বলা যায়। সে গাইতে শুরু করলো ‘জর্জা’ … এটাকে একটা জ্যাজ সঙ্গীতের মৌলিক গান বলা যেতে পারে। ব্রাদার-রে গানটা কবে রেকর্ড করেছিলেন তা আমার ঠিক মনে নেই। এটার কর্ড ভেরিয়েশন অসাধারণ। রে-চার্লসকে বলা হয় সোল কিং। তাই এটাকে যতোটা জ্যাজ, ততটাই সোল গান বলা যায়।
উইলি ন্যালসনের ভার্শানটাও আমার বেশ ভালো লেগেছে। এই ধরনের ঝুলন্ত তালের গানে যখন সুন্দর সুন্দর কর্ড থাকে, আর যখন মিউজিশিয়ারা ব্যাপারটা ধারণ করে বাজাতে শুরু করে। তখন ইনস্ট্রুমেন্টাল পার্ট অসাধারণ হয়ে ওঠে। সেই পর্যায়ে “জর্জা” শুধু আর গান থাকে না। গান হয়ে উঠে একটা উপায় মাত্র, বাকীটা শুধু ইম্প্রোভাইজেশান।
রীতু এবার আরেকটি গান ধরলো I Found my thrill – লুইস আমস্ট্রং এর গানটি বাজাতে গিয়ে আমি আর সরফরাজ বারবার আটকে যাচ্ছিলাম। লাইনটি হচ্ছে I Love Sweet Melody এখানে C Major Chord এর পরে হঠাৎ করে B7, EM কর্ডগুলি পুরো সুরটাকে কোথায় যে নিয়ে যায়… টবি ভাই আমাদের ঠিক করে দিলেন। মিউজিক্যালি টবি ভাইয়ের আগ্রহ আর আমার আগ্রহের মাঝে অনেক দূরত্ব আছে। কারণ আমি মিউজিক শুরু করেছিলাম কান্ট্রি মিউজিক আর রবীন্দ্র সঙ্গীত দিয়ে।
‘ক্যানি রজার্সের’ গান এক সময় প্রচন্ড ভালো লাগতো। তারপর ‘বিটেল্‌স’ এর প্রেমে পড়লাম সে আশির দশকের প্রান্তে। তারপর ‘সাইমন এন্ড গারফাংকেল’ (Folk), তারপর ধীরে ধীরে বিবর্তনের ধারায় লুইস আমষ্ট্রং এর ভক্ত হয়ে গেলাম। অমিল যাই থাকুক, আমরা যখন এক সাথে মিউজিক করবো তখন আমাদের খুঁজে নিতে হবে আমাদের মিলগুলোকে। তখনই মিউজিক প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
টবি ভাই এবার আমাকে অনুরোধ করলো শচীন কর্তার গান করতে। বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে, গীতিতে, ধরার সাথে সাথেই পুরো ঘর সত্যি সত্যিই বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে, হারিয়ে গেল। তিনি এতোটা খুশি হলেন আর বললেন,“পাভেল একটা বিয়ার খাওতো। এই জীসান, পাভেলকে একটা চিল্ড বিয়ার দাওতো।” জীসান হচ্ছে আরেক আমেরিকা ফেরৎ ড্রাম বাদক। প্রাকৃতিকভাবে তার চুলগুলো এতো সুন্দরভাবে ধীরে ধীরে কালো থেকে সাদা পাকা চুলে রূপান্তরিত হচ্ছে যেটা আসলে দেখার মত বিষয়।
আমরা বেশিরভাগ মানুষ স্রষ্টার প্রাকৃতিক পরিবর্তনের জন্য আগ্রহী নই। যার জন্য বেশিরভাগ মানুষ হয়ে ওঠে কৃত্রিম।
জীসানের ড্রামের একটা আলাদা দোলা আছে। দূর থেকে শুনে বোঝা যায় এটা জীসানের টোকা। যাকে বলে মেনারিজিয়ম। তার বাজানোর স্টাইলের সাথে আমি ফ্রগ-জাম্পের সাথে মিল খুঁজে পাই। মনে হয় অনেকগুলো ব্যাঙ একসাথে লাফিয়ে লাফিয়ে লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।
শান্ত হচ্ছে একজন সোল সিঙ্গার। এক সময় শান্ত বলতে তরুণ প্রজন্ম পাগল ছিলো। কিন্তু সেই গানগুলোকে আমার খুব একটা ভালো কিছু মনে হতো না। ব্যাপারটা এমন যখনই সে পরিণত হয়ে নিজের মতন কিছু করার চেষ্টা করছে, তখনই তার জনপ্রিয়তাও কমে গেল হুট করে। এটা আসলেই একটা দুঃখজনক ব্যাপার।
জীসান কিউ দিল, এক দুই তিন… শান্ত, শুরু করলো ‘মন দিল না বধূ’্ত্ত শচীনের এই গানটা খুব ভালো করেই গাইতে জানে শান্ত। তাছাড়া সদ্য বিয়ারে ভেজানো কণ্ঠ, আমরা গান শুনতে শুনতে বিয়ারের নেশায় বুঁদ হয়ে সবাই সজোরে হাসতে লাগলাম।
এভাবে ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠলাম রাত ১২:৩০। টবি ভাইয়ের স্টুডিওতে কোনে জানালা নেই তাই কোনো প্রাকৃতিক আলোবাতাসও নেই। এখানে ঢুকলে কখন রাত অথবা দিন তা অনুধাবন করাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
আমি ঘুমিয়ে পড়লাম স্টুডিওর ডিভাইনেই- টবি ভাই এর গান শুনতে শুনতে Its Been a hard days… আমি হারিয়ে গেলাম স্বপ্নের ভিতর। আমার বাবা আমাকে ডাকছে- আমি বলছিলাম, বাবা আমি তোমার কাছে ফিরে আসবো।
ঘুম ভেঙেই দেখলাম আমার শত্রু গো দাঁত বের করে গড় গড় করছে। আর আমাকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমি আঁতকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। সৌমেন হেসে বললো, দুই বন্ধুর অনেক দিন পর দেখা হলো হা্ত-হা্ত্তহা।
আমি খুব বিরক্তবোধ করলাম সৌমেনের কথায়। একজনের দুঃসময়ে আরেকজনের হাসি, ব্যাপারটা আসলেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঘড়িতে তখন সকাল নয়টা। আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নেমেই রাস্তার মানুষগুলোকে দেখে নিজেকে খুব খাপছাড়া লাগছে। সবাই সারারাত ঘুমিয়ে গোসল করে শহরে বেরিয়েছে, আর আধঘুমো একটা মানুষ ফিরে যাচ্ছি বাসায়। যেখানে আজকে আমার স্ত্রী আর সন্তান বাসায় থাকবে না। বুয়া এসে হয়তো ফিরে যাবে। আর ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে, ভাজি করে পানি খেয়ে তারপর না হয় ঘুম। পুরো রাতের জমানো ঘুম।
বেশিক্ষণ ঘুম হলো না। রাত জাগার সমস্যা এইটা- যে কোন মতে একরাতের ঘুম আর একদিনে পূরণ করা যায় না।
বাবার কথা খুব মনে পড়ছে- গান বাজনা করলে মানুষ আল্লাহ্‌কে ভুলে যায়…
জুমার নামাযের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে গেলাম। এখন ১২:৩০, মানুষ মাত্র মসজিদে আসছে।
আমার চোখ পড়ছে মসজিদের সামনের সারির বামপ্রান্তে। যেখানে বাবা সবসময় নামাজ পড়তেন। সত্যি বলতে কি আজ থেকে দশ বছর আগে মিউজিকের জন্য যতটুকু পাগল ছিলাম। এখন ব্যাপারটা আর সেরকম নেই।
এটার একটা মূল কারণ হতে পারে জানার পরিধি বৃদ্ধি অথবা বয়সের উপলব্ধি। গত দশ বছরে মিউজিক্যালি এতোটাই বিবর্তিত হলাম বলা যতে পারে বানর থেকে মানুষ হওয়ার মতন। ঢাকায় যদি সিঙ্গাপুরের মতন গলির মোড়ে মোড়ে বার অথবা মিউজিক্যাল ক্যাফে থাকতো তাহলে হয়তো আগ্রহটা আরও অনেক গভীর হতো।
সত্যি এতোগুলো গান যে লিখলাম আর এতো এতো মিউজিক যে আয়ত্ত করলাম এগুলো কার জন্য?
বাবা বলতেন এতকিছু দোকান, বাড়ি যে করলাম এগুলো কার জন্য?

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবার তোরা মানুষ হ
পরবর্তী নিবন্ধকাউন্সিলর টিনুর মায়ের ইন্তেকাল