বেগম রোকেয়ার সমাজ-ভাবনা

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ

কোনো এককালে বঙ্গদেশে গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ ছিল বলে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। মসলা, মুক্তো আর মসলিনের লোভে কত পথ, নদী-সাগর-অরণ্য পাড়ি দিয়ে দূরদেশ থেকে বণিকেরা ছুটে আসত আমাদের এই সমৃদ্ধ জনপদে! আমাদের আদিপিতাদের কোনো অভাব-অনটন ছিল না। রূপকথার মতো সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। ঠিক যেন ‘সকলের মুখে হাসি গান আর গান’। কিন্তু ইতিহাসের ‘সোনার বাংলা’ কে ‘অলীক কল্পনা’ বলছেন একালের অর্থনীতিবিদগণ, বেগম রোকেয়া যে-কথা বলেছিলেন শত বছর আগেই। ‘চাষার দুক্ষু’ নিবন্ধে রোকেয়া সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার নিরন্ন কৃষকের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেছেন তথ্য-প্রমাণ সহকারে, একজন জাত গবেষকের মতো করে।
একালে যেমন করে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি আর জনদুর্ভোগের সকল দায়ভার কোভিড মহামারী আর ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেকালেও বঙ্গীয় কৃষকের দুর্দশার জন্য ইউরোপের মহাযুদ্ধের অজুহাত দেওয়া হত। চাষার দুঃখের কারণ হিসেবে প্রথম মহাযুদ্ধের প্রকোপকে শুরুতেই বাতিল করে দেন রোকেয়া। তিনি প্রশ্ন করেন- ‘ইউরোপীয় যুদ্ধ তো সাত বছর আগের ঘটনা। পঞ্চাশ বছর আগেও কি চাষার অবস্থা ভাল ছিল?… ‘যখন দুই গন্ডা পয়সায় এক সের তৈল পাওয়া যাইত, তখনও জমিরনের মাতা কন্যার জন্য এক পয়সার তেল জুটাইতে পারিত না… ৩০/৩৫ বৎসর পূর্বে বেহার অঞ্চলে দুই সের খেসারীর বিনিময়ে কৃষকপত্নী কন্যা বিক্রয় করিত… উড়িষ্যা অঞ্চলে কৃষকেরা পান্তা ভাতের সহিত লবণ ব্যতীত অন্য কোন উপকরণ সংগ্রহ করিতে পারিত না… রংপুর (একদা ধান পাটের জন্য প্রসিদ্ধ) জেলার কোনো কোনো গ্রামের কৃষক এত দরিদ্র যে টাকায় ২৫ সের চাল পাওয়া সত্ত্বেও ভাত না পাইয়া লাউ, কুমড়া, প্রভৃতি তরকারি ও পাটশাক, লাউশাক ইত্যাদি সিদ্ধ করিয়া খাইত।’ কৃষক পরিবারের সদস্যদের পরিধেয় সম্পর্কে রোকেয়ার বর্ণনা থেকে জানা যায়- স্ত্রী কন্যার জন্য অনেক কষ্টে ৮/৯ হাত কাপড়ের ব্যবস্থা করে পুরুষেরা ‘কৌপিন’ ধারণ করত। আর শীত নিবারণে তারা খড় বিচালি জ্বালিয়ে রাত্রি পার করত।
তাই ইউরোপের যুদ্ধের সঙ্গে চাষার দুঃখের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। রোকেয়ার ভাষায়-
এ কঠোর মহীতে
চাষা এসেছে শুধু সহিতে;
আর মরমের ব্যথা লুকায়ে মরমে
জঠর-অনলে দহিতে!
এ-কালের চাষার জীবনযাত্রা রোকেয়ার কালের চাষাদের তুলনায় কতটা এগিয়েছে, তা ভেবে দেখার বিষয়। নানান দৃশ্যমান উন্নয়নের সুবাদে উন্নত দেশের কাতারে সামিল হওয়া বাংলাদেশে ক্ষুধার জ্বালায় সন্তান বিক্রয়ের খবর ২০২২ সালেও এসেছে। সমতল ও পাহাড়ের মা নিজে পেট পুরে খাওয়ার জন্য নাড়ি ছেঁড়া ধনকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছেন তা কিন্তু নয়, বরং তাঁর আদরের সন্তানটি সেই অন্যের বাড়িতে খেয়েপরে বেঁচে থাকবে- এটুকুই আশা অভাগী মায়ের। সন্তানের স্বাস্থ্য আর শিক্ষার মতো জটিল বিষয় তাঁদের ভাবনাতেও নেই। তবে চাষিকন্যাকে পোশাক নিয়ে তেমন দুর্ভাবনায় পড়তে হয় না আজ। গ্রাম ছেড়ে ঝাঁক বেঁধে সব বস্ত্রবালিকার দলে নাম লেখায়। সাতসকাল হতে মধ্যরাত অবধি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে জাতীয় অর্থনীতির চাকা ঘোরানো এসব মেয়েরা এঁদো গলির ধারে, পুঁতিগন্ধময় নোংরা বস্তিতে বসত গড়লেও ভদ্রস্থ পোশাক যোগাতে বড় বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না ওদের, নিরাপত্তা ও সম্মানের যতই ঘাটতি থাকুক না কেন। তাইনা দেখে জনপ্রতিনিধিগণের উল্লোসিত অভিব্যক্তি- ‘সোনার দেশে এখন কেউ ছেঁড়া কাপড় পরে না’।
আজকের চাষারাও ‘গনিমিয়া’ দের মতো হতদরিদ্র, তাদের নিজস্ব জমিজমা নেই। অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, খড় বিচালি জ্বালিয়ে শীতের রাত্রি ভোর করে সোনার ফসল ফলায়। উৎপাদিত ফসলের সিংহভাগ দিয়ে জমির মালিকের গোলা ভরিয়ে দেয়। চাষা পায় যৎসামান্যই; নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়। আবার ঋণের দায়ে জেল খাটে, অপদস্থ হয়। মজার ব্যাপার, গোলা ভরা ধান যার, সেই জমির মালিকদের বেশীর ভাগ আবার দেশগাঁয়ে বসবাস করেন না। বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামেই আজকাল বিলাসবহুল প্রাসাদোপম অট্টালিকা দেখা যায়। বছরের অধিকাংশ সময় সেই ঝলমলে প্রাসাদগুলো তালাবদ্ধ থাকে। বেতনভোগী কর্মচারী নিয়োজিত থাকে প্রাসাদ ও প্রাসাদসংলগ্ন ধানিজমি, ফলের বাগান, মৎস্যভরা পুকুর, খামার ইত্যাদির দেখভালের জন্য। প্রাসাদ মালিকেরা বছরান্তে ধুমধাম করে পায়ের ধুলো দিয়ে যায় গ্রামদেশে। বনভোজন, নৌকা ভ্রমণ, জ্যোৎস্নাবিলাস করে, জমিজমা হতে অর্জিত আয়ের হিসেব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেয়। হাতে কিছু সময় উদ্বৃত্ত থাকলে একবেলা কাঙালি ভোজের আয়োজন করে ফিরে যায় দূরের শহর কিংবা প্রবাসে, নিরাপদ আস্তানায়।
ফিরে যাই রোকেয়ার কাছে। ইউরোপে শিল্পবপ্লব পরবর্তী উন্নয়নের ছোঁয়া পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশি লেগেছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের দেড়শ বছরের পরিক্রমায় ইংরেজ রাজত্বের অংশ হিসেবে সভ্যতা ও ঐশ্বর্যের দিক থেকে ভারতবর্ষের অনেক শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিলে, এটা মানতেই হয়। ‘অভ্রভেদী পাঁচতলা পাকাবাড়ি, রেলওয়ে, ট্রামওয়ে, স্টিমার, এরোপ্লেন, মোটর লরি, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, পোস্ট অফিস, চটকল, পাটকল… চিকিৎসা, ঔষধ, অপারেশন, ইনজেকশন… থিয়েটার, বায়স্কোপ, ঘোড়দৌড়, জনতার হুড়োহুড়ি, লেমলেন্ড, জিঞ্জারেন্ড, বরফের গাড়ি, ইলেকট্রিক লাইট, ফ্যান, অনারেবলের গড়াগড়ি (বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের বাড়াবাড়ি) এ-সব কি সভ্যতার নিদর্শন নহে? নিশ্চয়! যে বলে ‘নহে’, সে ডাহা নিমকহারাম- কিন্তু ইহার অপর পৃষ্ঠাও আছে- কেবল কলিকাতাটুকু আমাদের গোটা ভারতবর্ষ নহে, এবং মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যশালী ধনাঢ্য ব্যক্তি সমস্ত ভারতের অধিবাসী নহে।’
কে বলবে- এই অনুচ্ছেদটি আজ থেকে শতবছর আগে রচিত! আমাদের জনপ্রতিনিধিগণ প্রায়শই অতিকায় অট্টালিকা, সড়ক, মহাসড়ক, উড়াল সড়ক,… তথ্যপ্রযুক্তি… আর মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির গল্প শোনান। তাঁদের মনেই থাকে না রাজধানী বা বন্দর শহরের বিশেষ কিছু এলাকাই পুরো বাংলাদেশ নয়, আর স্বল্পতম সময়ে ধনবান তৈরির এই সুবর্ণভূমিতে সকল নাগরিক সেই সুযোগ ও সৌভাগ্যের অংশীদার নয়। শত কোটিপতির আয়ের সঙ্গে কৃষক শ্রমিকের আয়ের গড় হিসেব করে যখন মাথাপিছু আয় নির্ণীত হয়, তখন উল্লাসে ফেটে পড়েন দেশদরদী রাজনীতিবিদগণ। কেউ বলে না তাদের কথা যাদের শ্রম, ঘাম, রক্তের বিনিময়ে রচিত হয় উন্নয়নের স্মারক। নজরুলের কুলি-মজুর কবিতার কয়েকটি চরণ মনে পড়ছে-
‘তুমি জানো না কো, কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে’-
সভ্যতার সঙ্গে দারিদ্র বৃদ্ধির কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রোকেয়া। আলস্য আর অনুকরণপ্রিয়তাকে বাঙালির অধঃপতনের প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন তিনি। রোকেয়ার ভাষায়, “বিলাসিতা ওরফে সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে ‘অনুকরণপ্রিয়তা’ নামক আরেকটা ভূত তাহাদের স্কন্ধে চাপিয়া আছে। তাহাদের আর্থিক অবস্থা সামান্য একটু স্বচ্ছল হইলেই তাহারা প্রতিবেশী বড়লোকদের অনুকরণ করিয়া থাকে।” আগেকার দিনে মানুষ দু’দশ ক্রোশ পায়ে হেঁটেই পার হত; এখন গাড়ি নিদেনপক্ষে রিকশা, বা অটো না হলে চলে না। আমাদের মুলুকে সভ্যতা (!) প্রবেশের আগে কৃষক রমণী চরকায় সুতা কেটে বাড়ির সকলের জন্য কাপড় তৈরি করত। মোটা কাপড়ে এখন মন ভরে না তাদের। সুলভ মূল্যে রঙিন, মিহি, বিদেশি কাপড় পাওয়া যায়। কেন তবে অযথা খাটুনি খাঁটা! চরকা কাটাতো বন্ধ হয়েছে রোকেয়ার কালেই। আজকের কিষাণির লাউ, কুমড়ো, সিম, কি পুঁই ডাটা লাগানো কিংবা হাঁস-মুরগি পালনের সময়ও মেলে না। ডিজিটাল বাংলাদেশে কিষাণীর হাতে হাতে ‘টাচ মোবাইল’। নামমাত্র মূল্যে জিবি, এমবি ক্রয় করে ধনবান ঘরের গৃহিণীদের মতো তাদেরও মন চায় আরাম আয়েশ করতে। মুঠোফোনের কল্যাণে আধুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ঋণদান কর্মসূচি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন কেউ কেউ, তবে বেশিরভাগই জিবি এমবির সৎকার করেন বিনোদন খাতে। তবে কি কৃষকের অন্ন জোটে না- এসবই অপপ্রচার!
বেগম রোকেয়াকে ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ অভিধায় ভূষিত করে কেবল নারীজীবন বা নারী পাঠকের জন্যই বরাদ্দ করে রাখা হয় রোকেয়াচর্চা। কিন্তু তাঁর ভাবনা ছিল পুরো সমাজকে নিয়ে, সমগ্র জাতিকে নিয়ে। তাই তাঁর রচনা, তাঁর দর্শন সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের জন্যও পাথেয় হতে পারে। ‘চাষার দুক্ষু’ নামের অতি সংক্ষিপ্ত একটি নিবন্ধে বেগম রোকেয়া অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব অতি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন অবকাঠামোগত উন্নয়নই শেষ কথা নয়। দেশীয় শিল্প, আর ঐতিহ্য ধ্বংস করে কোনো উন্নয়নই স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। রোকেয়া কেবল সমস্যা চিহ্নিতই করেননি, চাষার দারিদ্র ঘুচাবার জন্য গ্রামে-গ্রামে পাঠশালা স্থাপন আর ঘরে ঘরে চরকা পুনঃস্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। লিখে বা বক্তৃতা দিয়ে দায়মুক্ত হতে চাননি তিনি; পথে নেমেছেন, ছুটে বেড়িয়েছেন আর প্রতিদানে নিন্দা কুড়িয়েছেন সভ্যতার বড়াই করা সুশীল সমাজের। আজও তাই রোকেয়া দিবস বা রোকেয়াকে নিয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় সফল নারীদের দেখা না মিললেও নারী দিবসের বর্ণিল আয়োজনে ঢল নামে তাদের।
লেখক : ড. সালমা বিনতে শফিক, সহযোগী অধ্যাপক
ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধসু-ভাবনার ইতিকথা
পরবর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় ৫ নারী পেলেন শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা