সু-ভাবনার ইতিকথা

ইরফান জুয়েল | শনিবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ

আমার নানু, আমার গুরু। জীবনকে ইতিবাচক রহস্যে বিশ্লেষণ করতে শিখেছেন যিনি। তাঁর কাছে জগতের সবকিছুই ধরা দিতো কল্যাণকর হিসেবে। অনেক বছর (প্রায় একশ-র কাছাকাছি) বেঁচে ছিলেন। কখনো লাঠি ধরতেন না, বলতেন- আমার এতগুলো নাতি! ওরাই আমার লাঠি। অনেকবারই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এই বুঝি তিনি চলে যাবেন চিরতরে। কিন্তু বারবারই বোঝাপড়া করেছেন তাঁর প্রিয় স্রষ্টার সাথে। আরও কিছু সময় মানে আরও কিছু বন্দেগি। তাঁর কাছে জীবনের মানে হলো ইবাদত। বলতেন, নাতি কিছু খেতে মন চায় না, কিন্তু খেতে হবে না হয় তাহাজ্জুতের নামাজ পড়তে উঠবো কি করে!
নানুকে জিজ্ঞেস করতাম ‘নানু, নামাজ ভাত খেয়ে পড়লে ভালো নাকি না খেয়ে পড়লে ভালো?’ তিনি বলতেন দুটোই ভালো। আমরা ফিক করে হেসে দিতাম। নানু বলতো- ‘যদি না খেয়ে পড়িস তাহলে আল্লাহ তার ফেরেস্তাদের বলবেন দেখ! আমার বান্দা পেটে ক্ষুধা নিয়ে আমাকে ডাকছে। আর যদি খেয়ে পড়িস তাহলে তো পেটের ভাতগুলোসহ আল্লাহকে ডাকবে, ভাতের সওয়াবগুলোও তোর সওয়াবের খাতায় উঠবে।’
শেষের দিকে নানু কাউকে চিনতে পারতেন না। আমাদের বলতে হতো নানু আমি ওমুক, তোমার নাতি। এমনকী নিজের প্রথম কন্যা আমার মাকেও চিনতেন না। যে অবস্থায় উনার শুধু কিছু চরিত্র মনে আছে সে অবস্থায়ও তিনি তার শরীরের সক্ষমতা পরীক্ষা করতেন। রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে দুই হাত দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে দূর্বাঘাস ছিঁড়ে পরিক্ষা করে বললেন, এই হাতের তুলনায় এই হাতে জোর একটু কম পাই।
স্মৃতিতে ঘুরে বেড়ানো সেই দিনগুলোয় নানু সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে ওয়াজ করতেন। ওনার কন্ঠে তখন অদ্ভুত জোর চলে আসতো। সেই ওয়াজ আমাদের সবার জানা, তবুও শুনতাম। শেষবার আমি নানুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আল্লাহ শয়তানকে কেন সৃষ্টি করলেন? না করলেও তো পারতেন।’ নানু বললেন ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আল্লাহ পারতেন, কিন্তু করলেন। এটা আল্লাহর খেলা।’ আমি বললাম, ‘তাহলে এ- সবকিছু শুধুই একটা খেলা?! ’ নানু বললেন- ‘দুনিয়া আল্লাহর একটা খেলা মাত্র। তোমাকে শুধু ভালো খেলতে হবে। যেন তিনি পছন্দ করেন।’
ছোটবেলায় আমি বা পরিবারের কেউ স্বপ্ন দেখলে তার ব্যখ্যা খুঁজতাম নানুর কাছে। তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্নকেও বিশ্লেষণ করতেন জীবনের অনাগত ভালো দিক অথবা ভালো কিছুই হয়েছে এই সিদ্ধান্তে। স্বপ্নে দেখলাম সাপ, তাতেও ভালো। স্বপ্নে দেখলাম মিষ্টি খাচ্ছি, তাতেও ভালো। এমনই একদিন স্বপ্নে জ্বিন দেখলাম তাতেও নাকি ভালো। নানুকে একদিন বললাম, ‘তুমিতো সবকিছুকেই ভালো বলো।’ নানু বললো, ‘যতক্ষণ পৃথিবীতে কেউ কোনোকিছুকে খারাপ না বললো ততক্ষণ সেটা ভালোই থাকে, ভালোই হয়।’
নানু একবার সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। রিকশার চারদিকে তখন শাড়ি পেঁচিয়ে পর্দা করে তখনকার মহিলারাও সিনেমা হলে যেতেন। তখনও সিনেমা হল ‘খারাপ জায়গা’ সেই তকমা লাগেনি সিনেমা হলের গায়ে। সদ্য তৈরি হওয়া নতুন শিল্প মাধ্যমটি তখনও সকলের কাছে বিস্ময়!
নানু সিনেমা হলে সিনেমা দেখার সময় অঝোরে কাঁদছিলেন। কেন কাঁদলেন সেই গল্পও তিনি করেছেন। আমি প্রায় আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের নানুর এই কান্না করার প্রসঙ্গটি বলে জিজ্ঞেস করতাম- ‘বলতো নানু কেন কান্না করেছিলেন? ’
সবাই প্রায় একই উত্তর দিতেন বা এখনো দেন। তাদের উত্তরের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা থেকে আমার নানুর উপলব্ধির দার্শনিকতা ছিলো ভিন্ন। তারা সকলেই আমার ধার্মিক পরহেজগার নানুর কান্না করাকে দেখেছেন কেবল পাপবোধের দৃষ্টিতে। কারণ সময়ের পালা বদলে আমরা সিনেমা হলের গায়ে সেঁটে দিয়েছি ‘খারাপ জায়গা’র তকমা, অধর্মের তকমা।’ তাদের প্রায় সবাই মনে করেছে নানু সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন, এই পাপবোধ উপলব্ধি করে কান্না করেছেন।
গল্পটা নানুর মুখে শুনার পর আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম নানু, ‘কেন কান্না করেছেন?’
নানু বললেন- ‘অ নাতি! বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানীর সময় তাঁকে গাছের পাতায় পাতায় দেখাতে পারতো, এটা ছিলো উনার কেরামত! জ্ঞানের দরজা খুলে খুলতে এই সময়ের মানুষই এই কাজ করতে পারে। একটা সাদা পর্দায় জীবন্ত মানুষের হাঁটাচলা দেখাইতে পারে। মানুষ যদি এই কাজ করতে পারে, তাহলে আল্লাহ কি না করতে পারে! এই চিন্তা করে আমার কান্না এসেছিলো।’
তিনি সিনেমা হলে গিয়েও স্রষ্টার বিশালতা উপলব্ধি করেছেন। তিনি কান্না করেছেন পূণ্যবোধ থেকে, পাপ নয়। তার দেখার চশমা দিয়েই আজও আমি জগৎ দেখি। নানু আজ আমাদের সাথে নেই। তিনি মারা যাওয়ার পর তার জানাজার নামাজের জন্য মসজিদের মাইকে এলান করা হয়নি, যেমনটা হয় কোনও পুরুষ মানুষ মারা গেলে। এসব ফতোয়া কোনো হুজুর নয়, এলাকার লোকজন এবং আমার কিছু আত্মীয়-স্বজনদের। মহিলা মানুষের নাম মাইকে উচ্চারণ করা যাবে না, বেশি মানুষ জানাজায় না হওয়া ভালো, পরপুরুষ যাতে না দেখে। এসব শুনে রীতিমতো থ হয়ে গিয়েছিলাম। পরে জানাজা পড়াতে এসেছিলেন আমার মেজো বোনের জামাই তিনি সুপ্রসিদ্ধ একজন আলেম। তিনি এসে যখন শুনলেন লোকজনের এইসব ফতোয়াবাজি! তিনি কঠিন কন্ঠে বললেন এসবের পক্ষে আপনারা যদি একটা দলিল দিতে পারেন আমি আজই হুজুরগিরি ছেড়ে দেবো। আল্লাহর এত ইবাদত করলেন যে মহিলা, একশ বছরের কাছাকাছি এসেও আপনারা তার জন্য রয়ে গেলেন পরপুরুষ, তিনি রয়ে গেলেন মহিলা! মানুষ হতে পারেননি! পরে তিনি এলাকার অন্য সিনিয়র হুজুরদের ডাকলেন এবং মাইকে জানাজার এলান করা হলো এবং জানাজার শুরুতে ঘোষণা করলেন যেন, কোনো মহিলা মারা গেলে অবশ্যই জানাজার নামাজের জন্য এলান করা হয়, যেমনটা হয় পুরুষের জন্য। এ-প্রসঙ্গে একটা গল্পও বললেন। একবার এক চোর কাফনের কাপড় চুরি করতে গেলো রাতের বেলা। নতুন কবর, মাত্র এক-দুইদিন আগে কবর দেয়া হয়েছে, একজন পরহেজগার মহিলাকে। চোর কবরের সুড়ঙ্গে হাত ঢুকিয়ে কাফনের কাপড়টা টানছিলো, এমন সময় কবর থেকেই একটা আওয়াজ আসলো – এক বেহেস্তি কেন অপর বেহেস্তির কাপড় টানছে? চোর তো স্তব্ধ! কী করে সে বেহেস্তি হয়! চোর জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি পরহেজগার সে-কথা এলাকার সকলেরই জানা, নিশ্চয়ই আপনি বেহেস্তি হতে পারেন। কিন্তু আমি কি করে বেহেস্তি হবো!’ চুরি চামারি বাদে কোনো ভালো কাজের হিসাব তো দিতে পারবো না। তখন কবর থেকে উত্তর আসলো- ‘মারা যাওয়ার আগে আল্লাহ আমাকে বলেছিলেন কিছু চাইতে। আমি চেয়েছিলাম যারা আমার জানাজা পড়বে তারা যেন সকলেই বেহেস্ত পায়। আল্লাহ আমার চাওয়া কবুল করেছেন, এবং আপনি আমার জানাজা পড়েছেন।’
নানু আমাদের অনেক গল্প বলতেন। একবার এক পাগল গেলো এক পীরের কাছে। গিয়ে বললো, হুজুর আপনি আমারে বায়াত করান, আমি আপনার মুরিদ হবো, আপনার সবক মেনে চলবো।
পীর খাদেমরে বলে, ওরে একটা ছাগল দে! শোন পাগলা এই ছাগলরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক হাতে কানে ধরে অন্য হাতে কাঁঠাল পাতা খাওয়াবি। আর কানে কানে বলতে থাকবি- ও! ছলী! পাতা খা, আঁর হুজুরে দিইয়ি পড়া। খাওয়া শেষে কান ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করবি বুঝছে কিনা। যে এই ছাগল উত্তর দিতে পারবে ওইদিন তুই মোক্ষ লাভ করবি।
পাগল-ছাগল নিয়ে বাড়িতে গেলো এবং পীরের কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করতে লাগলো। কিন্তু ছাগল কিছুতে কিছু বুঝে না। অর্থাৎ কান ছাড়ার পর ছাগল কানের অস্বস্তি কাটানোর জন্য কান ঝাড়া দেয়, আর এতে পাগল মনে করে ছাগল কিছু বুঝে নাই। এভাবেই তার দিন যাচ্ছিলো। একদিন সন্ধ্যায় পীর সাহেব যাচ্ছিলেন পাগলের ঘরের সামনে দিয়ে। পীরের সাহেব ভাবলেন দেখি পাগলা কি করে, তিনি চুপিচুপি পাগলাকে দেখলেন পাগলা ছাগলকে পাতা খাওয়ানো শেষে জিজ্ঞেস করছে- বুঝছিস?
আর ছাগল মাথাও দুলাইলো না কিন্তু তার দুইটা ডানা গজাইলো এবং উড়ে চলে যাচ্ছে আর পাগল ছাগলরে ওই ছলী তুই আঁর উত্তর ন দি হডে যর বলে ঠা্যং ধরে ফেললো এবং পাগলও উপরে দিকে উঠে যাচ্ছে, পীর সাহেব তাড়াতাড়ি আড়াল থেকে বের হয়ে- ‘অ পলা তুই হডে যর আঁরে লই যা’ বলে পাগলের ঠা্যং ধরে ঝুলে গেলো। এবং তারা তিনজনই উড়ে চলে গেলো।
নানু আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার দেখার চশমাটা রেখে গেছেন। নানু চলে যাওয়ার পর তাঁর কথা বলতে গেলে চোখ ছলছল করে ঠিক কিন্তু ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসিও লেগে থাকে। লেখক : চারুশিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবান্ডেল সেবক কলোনি বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে মেয়র
পরবর্তী নিবন্ধবেগম রোকেয়ার সমাজ-ভাবনা