বীর মুক্তিযোদ্ধার সামাজিক নিরাপত্তা ও উত্তরাধিকারীর কল্যাণ

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ | শুক্রবার , ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। গত বর্ষে সমগ্র জাতি স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতির আত্ন প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি। ১৯৭১ সালে সমগ্র বাঙালি জাতি পাকশাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সঙ্গবদ্ধ হয়। ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার প্রত্যয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অনেকে। দেশের তরে বিলিয়ে দিয়েছে বুকের তাজা রক্ত। উৎসর্গ করেছে আত্নজীবন। মুক্তির আকুতি নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছে, তাঁরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁরাই দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। সৃষ্টি হয় ভারতপাকিস্থান নামে পৃথক দু’টি রাষ্ট্র। স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বপ্ন দেখে স্বাধীনভাবে পথ চলার। কিন্তু পাক শাসকগোষ্ঠী দ্বারা এদেশের মানুষ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ প্রতিক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়। মানুষ মুক্তির পথ খোঁজে। শুরু হয় অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৮ সালের আয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা ও ৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান ও ৭০ এর নির্বাচনসহ ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা।

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন ও সরকার গঠনের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ১৯৭১ সংসদ অধিবেশন আহ্বান করেন। শুরু হয় ষঢ়যন্ত্র, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর প্রকৃতরূপ ফুটে উঠে। পিপলস্‌ পার্টি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এলিটদের চাপে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন অনিদ্রিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। শুরু হয় বিক্ষোভ, হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত লক্ষ জনতার মাঝে বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন স্বাধীনতার চুড়ান্ত ঘোষণা: ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করে।

মুক্তিযোদ্ধা জাতির অহংকার। তাঁরা দেশের সংকটে নিবেদিত প্রাণ। মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে অনেক বীর শহীদ হয়েছে, যুদ্ধাহত বা পঙ্গু হয়েছে এবং গাজীর বেশে ফিরেছেন অনেকে। স্বাধীনতা উত্তর যে সকল যুদ্ধা আমাদের মাঝে ফিরে আসেন, তাঁদের অনেকেই আজও বেঁচে আছেন। আবার অনেকেই বেঁচে নেই। যাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা সীমাহীন। কিন্তু অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা গৃহহীন, বিনা চিকিৎসা, কর্মহীন ও আর্থিক অস্বচ্ছল জীবন অতিবাহিত করেছেন। স্বাধীনতার পর পর তাদের জন্য উপযোগী কর্মসূচি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। ব্যহত হয় উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন। শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তায় বিভিন্ন কল্যাণমূলক উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে ‘মুক্তিযুদ্ধা ভাতা কর্মসূচি’ প্রবর্তন শেখ হাসিনা সরকারের একটি অন্যতম যুগান্তকারী উদ্যোগ। ২০০০ সালে মাসিক ৩ শত টাকা হারে প্রথম এ কর্মসূচি চালু করা হয়। সরকার ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত করে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর উত্তরাধিকারের মাঝে ভাতা প্রদান করছে যথা: . খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ২. শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ৩. সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা। সমগ্র দেশে মোট ২ লক্ষ ৫ হাজার ১১৭ জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উত্তারাধিকারগণ বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে সম্মানী ভাতা গ্রহণ করছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাটাগরীতে ১,৯১,৫৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে ভাতা বিতরণ করছে। যা চলতি বর্ষে ১২ হাজার টাকা হতে বর্ধিত করে ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ১১,৯৯৮ জন শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে সম্মানী ভাতা প্রদান করছে। শহীদ পরিবারকে মাসিক ৩০ হাজার টাকা হারে এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে মাসিক ২৫ হাজার টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। খেতাব প্রাপ্ত ৫৮৭ জন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বিভিন্ন হারে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। বীরশ্রেষ্ঠ মাসিক ৩৫ হাজার টাকা, বীরউত্তম মাসিক ২৫ হাজার টাকা, বীরবিক্রম মাসিক ২০ হাজার ও বীর প্রতীক মাসিক ১৫ হাজার টাকা হারে সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন। সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার আরো পাচ্ছেন উৎসব ভাতা, নববর্ষ ভাতা ও বিজয় দিবস ভাতা।

সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে চালু করেছে বহুমুখী কর্মসূচি। খেতাব প্রাপ্ত, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের জন্য চালু আছে রেশন ও চিকিৎসা সুবিধা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয় মৃত্যুকালে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে। তাছাড়া আবাসন সুবিধা, চাকরির কোটা সুবিধা, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি সুবিধা ও চাকরির অবসর গ্রহণের সময়সীমা বৃদ্ধি করাসহ বিবিধ সেবা। এ সুবিধাসমূহের প্রকৃত দাবীদার একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর বৈধ উত্তরাধিকারগণ। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয়: অনেক অমুক্তিযোদ্ধা বর্ণিত সুবিধা গ্রহণে তৎপর। অনেকেই অবৈধভাবে গ্রহণ করছে মুক্তিযোদ্ধা সনদ। ভুয়া সনদ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহণ, কোটায় সরকারি চাকরির সুযোগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিসহ বিবিধ সুযোগ গ্রহণ করছে। এ নিয়ে শুরু হয় স্থানীয়ভাবে বিতর্ক। চলে তুমুল বিরোধ, চলে হাইকোটে মামলা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বিরোধ। আবার মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকার নির্ণয়ে দেখা যায় বিপত্তি। যা সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের নিকট অত্যন্ত বিব্রতকর।

বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ জাতির অহংকার। প্রজন্মের আদর্শ ও প্রেরণার উৎস। তাঁরা দেশ প্রেমিকের উজ্জল দৃষ্টান্ত। সরকার অতি মহৎ উদ্দেশ্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও বৈধ উত্তরাধিকারের মাঝে সরকার কল্যাণমূলক সুবিধা প্রদান করছে। যা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও প্রতিদানের ক্ষুদ্র প্রয়াস। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণমূলক সেবাসমূহের একমাত্র দাবিদার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর বৈধ উত্তরাধিকারীগণ। মুক্তিযোদ্ধা’র বৈধ উত্তরাধীকারীর মাঝেই প্রদত্ত সেবাসমূহ বিতরণ হোক। এ ক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী সংস্থা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ যৌথভাবে এগিয়ে আসবে। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে প্রদত্ত সেবাসমূহের সফল বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত হোক। বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ জাতির প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।

লেখক: সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর,

বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাবলিক প্লেসে ধূমপান নয়, গড়ে তুলি প্রতিরোধ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা