জুম্‌’আর খুতবা

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) নারী জাতির উত্তম আদর্শ

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.)’র পরিচিতি:

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন আল্লাহর প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রিয়তম সহধর্মিনী। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবী হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আদরের কন্যা। তাঁর নাম আয়েশা (রা.), উপাধি সিদ্দিকা, হুমায়রা নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন, হুমায়রা অর্থ আদরের সুন্দরী, তাঁর মাতার নাম জয়নাব, উপনাম উম্মে রোমান, হযরত আয়েশা (রা.) এর কোন সন্তান সন্তুতি ছিলনা।

বংশধারা: হযরত আয়েশা (রা.) ষষ্ঠ পুরুষ মুররা ইবনে কাবের সূত্রে রাসূলুল্লাহর বংশধারার সাথে তাঁর বংশধারা মিলে যায়। তাঁর বংশ ধারা নিম্নরূপ আয়েশা বিনতে আবু বকর ইবনে উসমান ইবনে আস ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তামিম ইবনে মুররা ইবনে কাব। (সূত্র: আয়িশা ড: ইয়াসির ক্বাদি)

বিবাহ: তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্ত্রী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তের দশম বর্ষে হিজরতের তিন বছর আগে তাঁর সাথে নবীজির শাদী হয়েছিল তখন তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর। নয় বছর বয়সে তাঁর দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। রাসূলুল্লাহর ওফাতের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র আঠার বছর, নবীজির ইন্তিকালের পর তিনি আরো ৪৮ বছর জীবিত ছিলেন।

হাদীসের আলোকে হযরত আয়েশা (রা.)’র মর্যাদা:

হযরত আয়েশা (রা.)’র জ্ঞান প্রজ্ঞা তাঁর পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় পবিত্র কুরআনের আয়াত ও অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজির পত্নিগণের উপর ১০টি কারণে আমি ফযীলত প্রাপ্ত। সেগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, .আমি একমাত্র কুমারী নারী যাকে নবীজি বিবাহ করেছেন। ২. আমি ব্যতীত নবীজির অন্য কোনো স্ত্রী পিতা মাতা উভয়কে মুহাজির হিসেবে পায়নি। ৩. আল্লাহ তা’আলা আমার নিস্কলুষতা সম্পর্কে আয়াত নাযিল করেছেন। ৪. আমার বিয়ের আগে জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আমার আকৃতি নবীজিকে দেখান এবং বলেন তিনি হচ্ছেন আপনার সহধর্মিনী। মহান আল্লাহর ইচ্ছা আপনি যেন তাঁকে বিয়ে করেন। ৫. আমি ও নবীজি এক পাত্র থেকে গোসল করতাম। ৬. তিনি আমার কক্ষে নামায পড়তেন আর আমি তাঁর সামনে শায়িত থাকতাম। ৭. নবীজি আমার সাথে থাকা অবস্থায় জিব্রাইল ওহী নিয়ে আসতেন অন্য কোনো স্ত্রীর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ থাকাবস্থায় জিব্রাইল (.) এভাবে ওহী নিয়ে আসেন নি। ৮. নবীজির অন্য স্ত্রী হযরত সাওদা (রা.) তাঁর এক রাত আমাকে দান করে ছিলেন। ৯. নবীজির ইন্তিকালের সময় তাঁর মাথা মুবারক আমার কোলের উপর ছিল। ১০. ইন্তিকালের পর আমার গৃহেই তাঁকে দাফন করা হয়েছিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খন্ড: , পৃ: ৬৫৫)

হযরত আয়েশা (রা.)’র বিয়ে শাওয়াল মাসে হয়েছে আরববাসীগণ শাওয়াল মাসে স্বামীর ঘরে কনের গমনকে অমঙ্গল মনে করতো, এটা ছিল তাদের ভ্রান্তধারণা। তাঁরা ধারণা করতো শাওয়াল মাসে বিবাহ হলে স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন সফল হয়না। কিছু সংখ্যক শিয়া, রাফেজিও দু ঈদের মধ্যবর্তী সময়ে এবং মহররম মাসে বিবাহ হওয়াকে অশুভ ও অকল্যাণ ধারণা করে। ইসলামে এ সব ধারণা বাতিল। (মিরকাত)

হযরত আয়েশা (রা.) বিবাহ শাওয়াল মাসে সম্পাদিত হয়েছে। এবং স্বামী গৃহে গমনও শাওয়াল মাসে হয়েছে। তিনি বলেন, আমি রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের মধ্যে নবীজির নিকট অধিক প্রিয় ছিলাম। এ বিবাহ যদি বরকতময় না হতো, আমি নবীজির নিকট এতো অধিক প্রিয় কিভাবে হতে পারলাম? সুতরাং শাওয়াল আসে বিবাহ মুস্তাহাব। (মিরাতুল মানাজীহ, শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, ৫ম খন্ড, পৃ: ৪৪৪৫)

অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় বিয়ে:

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বিবাহ ছয় বছর বয়সে হওয়াটা মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মুজতাহিদ ইমামগনের সর্ব সম্মতিক্রমে নাবালেগ সন্তানের বিবাহ বৈধ। পিতা কিংবা দাদা নাবালেগা অবস্থায় মেয়ে বা নাতিকে বিয়ে দিলে বালেগা বা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে পিতা বা দাদার করানো বিবাহ বাতিল করতে পারবেনা। তবে অন্যান্য অভিভাবকের প্রদত্ত বিবাহ বাতিল করতে পারবে। (মিরকাতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, খন্ড:৫ম, পৃ: ৩৬)

কোন কোন অবস্থায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক না বালেগ সন্তানের বিয়ে করানো আবশ্যক হয়ে যায়। যেমন পিতা মৃত্যু পথে যাত্রী মেয়ে ছোট হলেও তার অন্তিম ইচ্ছে তার জীবদ্দশায় মেয়ের বিবাহ দিয়ে যাবেন যাতে তার মৃত্যেুর পর মেয়েটি সমস্যার সম্মুখীন না হয়। শরয়ী দৃষ্টি কোনে এ অনুমতিতে অসংখ্য হিকমত রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইন এটাকে সমর্থন করে না।

হযরত আমীরে মু’আবিয়া (রা.)’র প্রতি হযরত আয়েশা (রা.) এর লিখিত বাণী:

হযরত আয়েশা (রা.) দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামকে উপদেশ দিতেন একবার হযরত আমীরে মুআবিয়া (রা.) হযরত আয়েশা (রা.) কে লিখেছিলেন আমাদের কিছু উপদেশ দিন। আমরা যেন তা মেনে চলতে পারি, তখন হযরত আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহর এ বাণীটি লিখে প্রেরণ করলেন। “যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে আল্লাহ তাকে মানুষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন। মানুষ তার কোনো ক্ষতিই করতে পারেনা। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে হলেও মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে আল্লাহ তাকে মানুষের হাতেই সোপর্দ করেন। (তিরমিযী, খন্ড:৪র্থ, পৃ: ৬০৯)

হাদীস সংরক্ষনে হযরত আয়েশা (রা.)’র অবদান:

উম্মাহাতুল মু’মিনীদের মধ্যে হাদীস হাদীস সংরক্ষনে হযরত আয়েশা (রা.)’র অবদান ও ভূমিকা সবার উর্ধ্বে তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তি, অসাধারণ ধীশক্তি, অতুলনীয় মেধার অধিকারী ছিলেন। অধিক সংখক হাদীস বর্ণনাকারী সাতজন সাহাবীর মধ্যে তিনি তৃতীয়। ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে তাঁর বর্ণিত হাদীস পাওয়া যায় নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দানসাদকা, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, পবিত্রতা, বিয়ে, তালাক, ইসলামী শরীয়তে, প্রতিটি বিষয়ে তাঁর বর্ণিত হাদীস রয়েছে।

হযরত আয়েশা (রা.)’র জ্ঞানের প্রশস্ততা:

হযরত আয়েশা (রা.) জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ে গভীর বুৎপত্তি অর্জন করেন, তিনি বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন একাধারে তাফসীর, ফিকহ, ইসলামী সাহিত্য, কবিতা ও চিকিৎসা পদ্ধতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। ইমাম যুহরী (.) তাঁর জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে বলেন, যদি সকল মানুষের ও নবীজির স্ত্রীগণের ইলম একত্র করা হত, তাহলে আয়েশা (রা.)’র ইলম অধিকতর প্রশস্ত হতো। (আল ইলম ওয়াল উলামা, পৃ: ২৬৬)

হযরত আয়েশা (রা)’র বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা:

হযরত আয়েশা (রা.) থেকে ২২১০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম শরীফে ৩১৬ টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। মুত্তাফাকুন আলাইহি হাদীসের সংখ্যা হলো ১৭৪টি ইমাম বুখারী এককভাবে বুখারী শরীফে ৫৪টি আর ইমাম মুসলিম, এককভাবে মুসলিম শরীফে ৬৯ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এক বর্ণনা মতে বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস ৩০০টি। (দাইরাতুল মা’আরিফ আলইসলামী, ১৫শ খন্ড, পৃ: ৪২৪)

সহীহ মুসলিমে ৬০৮, তিরমিযী শরীফে ২৬৬, আবু দাউদ শরীফে ৪১৭, নাসাঈ শরীফে ৬৫৬, ইবনে মাযাহ শরীফে ৩৯৩টি, মুয়াত্তা ইমাম মালেকএ ৩৭০টি হাদিস উল্লেখ হয়েছে। (মুসনাদে আহমদ, খন্ড: ৬ষ্ঠ)

হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত কয়েকটি হাদীস:

হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত কয়েকটি হাদীস আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি কালো জিরা মৃত্যু ব্যাতীত সব ধরণের রোগের প্রতিষেধক। (সহীহ বুখারী, খন্ড: ৪র্থ, হাদীস: ৫৬৮৭)

মহান আল্লাহ আমাদের কে আম্মাজান উম্মুল মু’মিনের আদর্শ অনুসরণ করার তাফফিক নসীব করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান রুবেল

মাদামবিবিরহাট, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: বর্তমান প্রজন্মের স্কুল কলেজ, ভার্সিটির অনেক ছেলেরা টুপি ছাড়া নামায আদায় করে থাকে, এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননা, এ বিষয়ে শরয়ী বক্তব্য জানালে উপকৃত হব।

উত্তর: টুপি ইসলামী পোশাকের প্রতীক। টুপি পরা সুন্নাত। এক হাদীসে এসছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদা টুপি পরতেন। (তাবরানী)

হযরত কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টুপি অথবা পাগড়ি দ্বারা মাথা ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। নামাযে মাথা খালি রাখতে নিষেধ করেছেন। (কাশফুল গুম্মাহ, খন্ড: ১ম, পৃ: ৮৫, ফতোওয়ায়ে নঈমীয়া, খন্ড :৪র্থ, পৃ: ৪৮৭)

হযরত হাসান (রা.) থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম সর্বদা পাগড়ি অথবা টুপি পরিধান করেই নামায আদায় করতেন। ( বোখারী শরীফ, খন্ড: ১ম, পৃ: ৫৬, ফতোয়ায়ে নঈমীয়া খন্ড: ৪র্থ, পৃ: ৪৮৮)

হানফী মযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ফতোওয়ায়ে আলমগীরিতে উল্লেখ আছে, খালি মাথায় নামায পড়া মাকরূহ। (আলমগীরি, খন্ড: ১ম, পৃ: ১০৭)

খালি মাথায় নামায পড়ার বৈধতা সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোনো দলীলের অস্তিত্ব খুঁ্বজে পাওয়া যায়নি। হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আজ পর্যন্ত নবীজির সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তবে তাবেঈন, মুজতাহিদ ইমামগণ, উম্মতের সব ওলামায়ে কেরাম টুপি পরে নামায আদায় করেছেন যা আজো বিদ্যমান। হাদীস ও ফিকহ এর উল্লেখযোগ্য সব কিতাগুলোতে এর অসংখ্য দলীল বিদ্যমান আছে।

টুপি বিহিন নামায পড়া নিন্দনীয়। আদবের পরিপন্থি, সুন্নতের বিপরীত, ইংরেজদের কৃষ্টিকালচার। ইসলামী শরীয়তে টুপি পড়া একটি সুন্নাত আমল। (ফতোওয়ায়ে নঈমীয়া, খন্ড: ৪র্থ, পৃ: ৪৮৮৪৮৯)

পূর্ববর্তী নিবন্ধবীর মুক্তিযোদ্ধার সামাজিক নিরাপত্তা ও উত্তরাধিকারীর কল্যাণ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে