দূরের দুরবিনে

হতাশা ও অন্ধকারের বিপরীতে উজ্জ্বল জীবনের গল্প

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

দেশের মিডিয়ায় নেগেটিভ খবরের ছড়াছড়ি। বাঙালি কেন জানি আনন্দের চাইতে বিষাদ আর শান্তির পরিবর্তে কলহে মগ্ন থাকতে পছন্দ করে। আমি আমার এই ৬৪ বছর বয়সে হিসেব করে দেখি আমরা কেন জানি সবসময় নেগেটিভ কিছুতে বেশি আগ্রহী ছিলাম। এর কারণ হয়তো বারবার পরাধীন থাকা সু শাসনের অভাব, হয়তোবা আমাদের রক্তেই ঢুকে গেছে নৈরাজ্য আর প্রতিবাদের নামে নেগেটিভিটি। অথচ উন্নত নামে পরিচিত দেশগুলোর মিডিয়া এ বিষয়ে সতর্ক। তারা যে কোনও নেগেটিভ নিউজকেও পজিটিভ উপস্থাপন করতে পারঙ্গম। সম্প্রতি বিশ্বকাপ ফুটবলে অভাবনীয় সফলতার পর অস্ট্রেলিয়া হার মেনেছিল মেসির নৈপুণ্যের কাছে। সে খবরটি চমৎকার ভাবে পরদিন সকালে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়া এখানকার মিডিয়া শ্যাম ও কুল দুটোই রক্ষা করেছিল। একদিকে যেমন আত্মসম্মান অন্যদিকে বহুজাতিক সমাজে যেন আর্জেন্টিনার সমর্থকদের ওপর কেউ চড়াও না হয় এ দুই দিক বাঁচিয়ে করা হয়েছিল সংবাদ শিরোনাম। আমাদের দেশে প্রচুর ভালো খবর থাকলেও তা চোখের অগোচরে থেকে যায়।

যেমন ধরুণ সেঁজুতি সাহার খবরটি। সেঁজুতি শব্দের অর্থ বা তার নামের অর্থ দিয়ে চমৎকার একটা ট্যুইস্ট নিউজ হতে পারতো না? সন্ধ্যাপ্রদীপ যার নাম সে যে দেশময় বিজ্ঞান চর্চার অন্ধকারে একটি প্রদীপের মতো সে কথা লেখে নি কেউ। লিখলে কোমলমতি তারুণ্যের মনে হতো তারা ও একদিন দীপ হয়ে জ্বলে উঠতে পারবে । যেমন ধরুণ ভিপি নূর তার বিদেশে কী সব আবোল তাবোল ঘটনা নিয়ে কেমন মাতামাতি চলছে। ইউটিউবে দেখলাম তার প্রত্যাবর্তনের পর গলায় মালা দিয়ে বক্তব্য প্রচারের মহাসমারোহ। কিন্তু কেন? নূরু তার যোগ্যতা অনুযায়ী যা পাবার তা পাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের কাজ যেন নেগেটিভিটিকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা। এর কারণ কী অচলায়তন ভাঙার স্পৃহা? না মনোটোনাস দিনকাল ভেঙে নতুন কিছুর সন্ধান?

মোদ্দা কথায় আমাদের দেশের পাশপাশি বিদেশের বাংলাদেশীদের জীবনও হয়ে উঠছে কলহ নির্ভর। আমি এখন যে কোনও আড্ডা বা মজলিশে যেতে রীতিমত ভয় পাই। পরিচিতজন ব্যতীত অন্য কোথাও যেতে মন চায় না। এমনকি পরিচিতদের ভীড়েও নিজেকে অজানা অচেনা মনে হয়। দেশে রাজনীতি নেই বলে যারা দু:খ করেন তাদের একবার বিদেশে এসে সরেজমিনে দেখে যাওয়া উচিৎ। কাকে বলে কাহাকে বলে দেশের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ যেহেতু দেশ শাসনে এবং তা অনেক বছর ফলে দলের শাখা প্রশাখার কমতি নেই। অন্যদিকে তলে তলে যত স্বাধীনতা বিরোধী আর দালালেরা ঐক্যবদ্ধ। তাদের শাখা আছে কি নেই বড় কথা না বড় বিষয় তারা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।

যে কথা বলছিলাম যে কোন ঘরোয়া আড্ডা মানেই শেখ হাসিনার বিরোধিতা, লীগের নিন্দা। কারো মুখে আপনি পদ্মাসেতু বা ট্যানেলের গল্প শুনবেন না। শুনবেন না যোগাযোগ কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়নের গল্প। অথচ হিপোক্রেসিটা এই, এদের সামাজিক মিডিয়ার একাউন্ট জুড়ে দেশে গিয়ে পদ্মাসেতুতে বেড়ানো ইলিশ ভোজনের ছবিতে ভরা। এই দ্বৈততার কারণও বোঝা মুশকিল। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে অসুবিধা হয় না মানুষ কোথাও হয়তো ব্যতিক্রম চায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত আর কারো প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না তারা।

বলছিলাম পজিটিভ নিউজের কথা। এ লেখা যখন লিখছি তখন ওমান কে হারিয়ে চ্যম্পিয়ন হয়েছে যুব হকি দল। এতবড় একটা খবর পরিবেশন করতে গিয়ে দেশের সবচেয়ে চালু নামে পরিচিত দৈনিক লিখেছে : ‘বাংলাদেশের হকিতে আজ দারুণ এক সাফল্য এসেছে। হোক তা যুব পর্যায়ে, তারপরও এশীয় পর্যায়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়া বড় কৃতিত্বই। সেটিও ওমানের মাঠে, ওমানকে হারিয়ে।

আজ ওমানের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর এক ফাইনাল জিতেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ২১ হকি দল। এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) কাপ অনূর্ধ্ব২১ টুর্নামেন্টের রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে বাংলাদেশের কাছে ওমান টাইব্রেকারে হেরেছে ৭৬ গোলে’। প্রশ্ন হচ্ছে হোক তা যুব পর্যায়ে মানে কি? যুব পর্যায় কি ফেলনা কিছু ? আজ যদি না পারতো বা হারতো আপনারাই লিখতেন তীরে এসে তরী ডোবানো আমাদের স্বভাব। নেগেটিভে আগ্রহী সংবাদ মাধ্যমের রোগ এখন অনিরাময়যোগ্য। ভাইরে এই যুবপর্যায়ে এশিয়া চ্যম্পিয়ানর ই বড় দলে খেলবে। উপযুক্ত সবকিছু পেলে এরাই এশিয়া কাপ হকিতে হয়তো বিজয় ছিনিয়ে আনবে। সে কথা লেখায় অনাগ্রহের কারণ কী ? তা তো বুঝলাম না।

যখন চারদিকে কেবল দুর্ঘটনা মারামারি আর মৃত্যুর খবর তখন একটি অনুপম জন্মসংবাদ বড়ই প্রশান্তির। জন্ম সব সময়ই আনন্দের। একটি শিশুর জন্ম মানেই একটি সম্ভাবনার জন্ম। যে শিশুটি শিরোনাম হয়ে জন্মালো সে একদিন দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। রাজধানীর উত্তরা থেকে ধানমণ্ডির একটি হাসপাতালে যেতে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে স্বামী অনুপ সাহার সঙ্গে মেট্রোরেলে চড়েছিলেন অন্তঃসত্ত্বা সোনিয়া রানী রায়। কিন্তু কে জানত, পথেই শুরু হবে তার প্রসব বেদনা। আগারগাঁও মেট্রোস্টেশনে নেমেই আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন সোনিয়া। পরে তাকে স্টেশনের ফার্স্টএইড সেন্টারে নেওয়া হয়। সেখানে ধাত্রীর প্রশিক্ষণ থাকা সোনিয়া নামে এক রোভার স্কাউট সদস্য ওই অন্তঃসত্ত্বা নারীর সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন।

পরে রোভার সোনিয়ার সাহায্য নিয়েই এক ছেলেসন্তানের জন্ম দেন সোনিয়া রানী রায়। এদিন সকাল পৌনে ৯টার দিকে শিশুটির জন্ম হয়। এ সময় সোনিয়া রানীর স্বামী অনুপ সাহাও উপস্থিত ছিলেন। শিশুটির জন্মের পর মাসহ তাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয় ধানমণ্ডির রেনেসাঁ হাসপাতালে। সোনিয়া রানীর ওই হাসপাতালেই ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। এদিকে মেট্রোস্টেশনে এমনভাবে একটি শিশুর জন্মের ঘটনায় উচ্ছ্বসিত কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীরা। উপস্থিত লোকজন শিশুটির নাম ‘মেট্রো’ রাখার প্রস্তাব করেন। তবে সুকান্ত সাহা জানিয়েছেন, তাদের বাচ্চার নাম আগেই ঠিক করে রাখা আছে।

এই খবরটি আমার কাছে নতুন বছরের চমৎকার সূচনার একটি শিরোনাম মনে হয়েছে। এই ঘটনা একদিকে যেমন মানবিকতা আর যত্নের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে অন্যদিকে আছে আশা ও ভালোবাসা। কত শত তুচ্ছ কারণে আমরা ভেদাভেদ আর অশান্তি ডেকে আনি। ধর্ম বা সম্প্রদায়গত পরিচয় তার প্রধান একটি কারণ। নেগেটিভ প্রচারণার কারণে মাঝে মাঝে মনে হয় ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি বুঝি আর কোনও দায় মমতা বা ভালোবাসাই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এই ঘটনা তা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। আশা জাগিয়েছে, মানুষ মানুষের জন্য। এখনো নবজাতকের আগমনে প্রশান্তি আর ভালোবাসায় ঐক্যবদ্ধ আমাদের সমাজ।

এই সেদিন আমার মত ক্ষুদ্র একজন মানুষের সম্মানে সমবেত হয়েছিলেন সিডনির সুধিজন। সে সভায় জন্ম পরিচয়ে আমার স্বধর্মের মানুষ ছিলাম মাত্র তিনজন। আমি আমার স্ত্রী ও পুত্র। বাদবাকী আয়োজক ও আগতদের সবাই ছিলেন সংখ্যাগুরু নামে পরিচিত সম্প্রদায়ের মানুষজন। তাই আমি কোনওদিন আস্থা হারাই নি হারাবোও না। আমাদের দেশ জাতি ও বিদেশে বাংলাদেশীদের একটাই পরিচয় আমরা পদ্মাতীরের মানুষ। বাংলাদেশ আমাদের দেশ। জয় হোক সদাথর্ক ভাবনার জয়ী হোক পজিটিভিটি।

লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, ছড়াশিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধসময় গড়ায়, তবু হয় না কমিটি