বিদায় বার্মা

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২২ at ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

মিয়ানমার, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া জুড়ে যখন যার যার নিজের নববর্ষ উদযাপনের আনন্দ, আমাকে তখন আনন্দ ফেলে ফিরে যেতে হচ্ছে অফিসের কাজে। মিকা রয়ে যাবে মিয়ানমারে আরও কিছুদিন। মিকা কথা দিল আমি যখন বাংলাদেশে থাকবো, সে তখন বেড়াতে আসবে। আমি রাতের ট্রেনের তৃতীয় শে্রিণর কামরায় চড়ে বসেছি ইয়াঙ্‌গুন যাবার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে পরের দিনের ফ্লাইট।

ট্রেনে আমার ঠিক উলটো দিকের সিটে বসেছে বার্মিজ এক বৌদ্ধ ভান্তে, পাশে ভারতীয় চেহারার একজন মধ্যবয়স্ক লোক। ওনার পরনে বাংলাদেশের ডিজাইনের লুঙ্গি। বার্মিজ লুঙ্গির সাথে বাংলাদেশের লুঙ্গির নকশা এবং বুননে পার্থক্য আছে। আমার কোনাকুনি বসেছে রোহিঙ্গার মত দেখতে, এবং রোহিঙ্গার মত পোশাক পরা এক নারী সাথে তার ৫/৬ বছর বয়সী সন্তান। রোহিঙ্গার মত দেখতে হলেও কথা বলছিলেন বার্মিজ ভাষায়। ভারতীয় মতো দেখতে লোকটাও বার্মিজ ভাষায় কথা বলছে। যে দেখতে যেমনই হোক না কেন, যে জাতিরই হোক না কেন, এদের সবাইকে মিয়ানমার সরকার বাস করার অনুমতি দিয়েছে। কেননা, তা না হলে এদের কেউই ট্রেনে চড়ে বসতে পারতো না। ট্রেনের টিকেট করার জন্য অবশ্যই পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। তারপর, ট্রেনে ওঠার পর আবার পরিচয়পত্র চেক করা হয়। এত চেকিং পেরিয়ে ট্রেনে পড়া কোন অবৈধভাবে মিয়ানমারে বসবাসকারীর পক্ষে সম্ভব না।

এই পরিচয়পত্র আবার বিভিন্ন রঙ-এর। সহজ করে বললে, যাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আছে তাদের পরিচয়পত্রের রঙ হালকা লাল, আবার কেউ বলে একে গোলাপি কার্ড; যেসব বিদেশিকে মিয়ানমার সরকার বৈধভাবে থাকার অনুমতি দিয়েছে, এবং যাদের একদিন নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভবনা আছে, তাদের পরিচয়পত্রের রঙ সবুজ; আর যেসব মানুষ অনেকদিন ধরে মিয়ানমারে অবৈধভাবে বাস করছে এবং যাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনও সম্ভবনাই নেই, তাদের সাদা কার্ড। সাদা কার্ডধারী ব্যাক্তিরা নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে হলে প্রশাসন থেকে তাদের স্পেশাল অনুমতি নিতে হয়। তবে, সেই অনুমতি দেখিয়ে তারা ট্রেনে করে ইয়াঙ্‌গুন যেতে পারে না। রোহিঙ্গা বলে যারা পরিচিত আমাদের কাছে, মিয়ানমার সরকার তাদেরকে রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করে না। মিয়ানমার সরকারের কাছে তারা হলো বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী।

তাদেরকে সাদা কার্ড দেয়া হয়েছিল। তবে ২০১৮ তে এই সাদা কার্ড বাতিল করে দেয়া হয়। একসময় যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছিল, ১৯৮২ সালে সামরিক জান্তা কর্তৃক তৈরিকৃত নাগরিকত্ব আইনে সেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এর ফলে একটি বড় জনগোষ্ঠী নাম লেখায় ‘দেশবিহীন’ মানুষের তালিকায়। তবে ১৯৮২ সালের আইনের মাধ্যম আরও অনেকেই যেমন- গুর্খা, তামিল, বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু এবং মুসলিমরা সহ আরও অনেকই ‘দেশবিহীন’ মানুষ হয়ে যায়। কোন দেশ এদের নিজের মানুষ বলে স্বীকৃতি দেয় না। তবে, পরবর্তীতে জান্তা শাসক সকলকে সবুজ কার্ড নিতে বলে, এতে করে তারা বৈধভাবে মিয়ানমারে থাকতে পারবে, আর হয়তো ভবিষ্যতে কখনো নাগরিকত্ব পেলেও পেতে পারে। তবে রোহিঙ্গারা সরকারের এই প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা পূর্ণ নাগরিকত্ব দাবী করে। এতেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত। অন্যদিকে বাংলা ভাষাভাষীরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করে বলে তাদের দেয়া হয় সবুজ রঙের কার্ড, যেখানে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে। আবার, বাংলা ভাষাভাষীরা সবুজ কার্ড নিয়েছে বলে, রোহিঙ্গারা তাদের বেঈমান ভাবে। তবে, অনেক রোহিঙ্গা অন্যান্য জাতির মুসলিম ধর্মের মানুষ যারা মিয়ানমারের নাগরিক তাদের বিয়ে করে নিজের জাতিগত পরিচয় রোহিঙ্গা বাদ দিয়ে, স্বামী বা স্ত্রীর জাতিগত পরিচয় নিয়ে নাগরিকত্বের লাল কার্ড নিয়ে, মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে বাস করছে এবং সমগ্র মিয়ানমারে তাদের ঘোরার অধিকার আছে। অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে যেতে হলেও প্রশাসনের অনুমতি লাগে।

আমি যখন ২০১৭ তে মিয়ানমার ভ্রমণ করেছিলাম, তখন আং সাং সুচির দল সামরিক সরকারের সাথে ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছে। কিন্তু, আজ ২০২২- এ বসে যখন সেই ভ্রমণের গল্প লিখছি তখন মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতা আবার সামরিক জান্তার হাতে। ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে সামরিক জান্তা আবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। মিয়ানমার উত্তাল গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দাবীতে। চাইনিজ অভিবাসীদের দখল করে নেয়া মান্দালে শহরে সামরিক জান্তার হাতে মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। ইয়াঙ্‌গুনের সুলে প্যাগোডা চত্বরে ক্ষুব্ধ জনতার সমাবেশের গুলিতে এবং পুরো ইয়াঙ্‌গুনে মারা গেছে দুই হাজারের বেশি মানুষ।

আজ ১৬ এপ্রিল ২০২২-এ আমরা যখন করোনা মহামারীর পর একটু আনন্দ করতে পারছি বাংলা নববর্ষকে ঘিরে, মিয়ানমারে মানুষ হাহাকার করছে একটু খাবার পানির জন্য। নতুন বছরে বলবো পুরানো ভ্রমণের আর এক গল্প।
rupsbd@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবেশের ক্ষতিকারকরা দেশ ও মানুষের শত্রু : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধশেকড়ের কাছে