১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর সৃষ্টি হয় দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুটো অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ বলেই দিলেন উর্দুই হবে দেশের রাষ্ট্রভাষা।
এনিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের চরম উত্তেজনা দেখা দেয়, সে ইতিহাস অনেকেই জানেন। এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে প্রকাশ্য ঘোষণা দেন উর্দু হবে দেশের রাষ্ট্রভাষা। এতে ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, না না ধ্বনি দিয়ে প্রতিবাদ জানায়। শেষ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষার জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাজপথে প্রাণ হারায় সালাম, রফিক, বরকতসহ আরো অনেকে। উল্লেখ্য যে, সে সময় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জেলে। কিন্তু জেল থেকেই ছাত্রদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে ভূমিকা পালন করে।
ঢাকার বুকে পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে এক বিশাল প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় দুদিন পর। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। ওই কলেজের ছাত্র ছিলেন আব্দুল্লাহ আল হারুনও। তার সাথে আবার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তার নেতৃত্বে লাল দিঘির মাঠে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় আমরা ছাত্ররা চট্টগ্রাম কলেজ থেকে মিছিল সহকারে সভায় যোগদান করি। পথে পথে স্লোগান দিয়েছি। হারুন ভাই আমাকে মিছিলের অগ্রভাগে স্লোগান দেওয়ার দায়িত্ব দেয়, স্লোগান দিতে দিতে সভায় এসে পড়ি। বিরাট প্রতিবাদ সভা হয়। তখন তো এতো কলেজ ছিল না। আমাদের প্রতিবাদী মিছিল চট্টগ্রামবাসীকে প্রাণীত করে। কেউ কেউ মিছিলেও যোগ দেন।
মনে পড়ে, ওই প্রতিবাদ সভায় চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা নিবাসী জনাব মাহবুব আলম চৌধুরী (কবি) যোগ দেন এবং একুশের উপর প্রথম কবিতা আবৃত্তি করেন। তিনি বলেন কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। পাঠের সময় মুহুর্মুহু ধ্বনি স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। গা এখনো শিহরিয়ে ওঠে। মুখরিত হয় চট্টগ্রামের আকাশ বাতাস। উল্লেখ্য যে আমি আর আব্দুল্লাহ আল হারুন একই বছর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএ করেছি। মার্কসিটে দেখি, অর্থনীতিতে আমি ভালো নম্বর পেয়েছি। সেজন্য অভিভাবকেরা আমাকে অর্থনীতি নিয়ে এম এ করার পরামর্শ দেন। আমি কিন্তু বাংলা ভাষার কথা ভুলিনি, অর্থনীতি ছেড়ে চলে আসি বাংলায়। আমাদের শিক্ষকেরা ছিলেন ধ্বনিতত্ত্ববিদ অধ্যাপক আবদুল হাই, নাট্যকার অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, গবেষক অধ্যাপক আহমদ শরীফ, অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম, অধ্যাপক অভয় ভট্টাচার্য ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তারা সকলেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন অঙ্গনে তাদের অভিসার ঐ ভাষা আন্দোলন আমাকে এম.এতে বাংলা পড়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল।
উল্লেখ্য পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর বাঙালিরা কিছুতেই উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নেয়নি। পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়, তবে তা গৃহীত হয়নি। দেখা যাচ্ছে ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা গড়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। এতে ছাত্র সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
বেতারে টিভিতে রবীন্দ্র সংগীত গাইতে দিত না, আমাদের খ্যাতিমান কবিদের ডেকে নিয়ে বলা হত রবীন্দ্র সংগীত কী? আপনারা রবীন্দ্র সংগীত দেখতে পারেন না। আবার বলা হত উর্দু আসরে বাংলা লিখতে। কতই না প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল বাংলাভাষার বিরুদ্ধে। কিন্তু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহল ছাত্র সমাজ এবং প্রগতিশীল নেতাদের ক্রমাগত বিরোধিতার মুখে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সুধীজনের অভিমত রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই–এই দৃঢ় প্রত্যয় আর সর্বস্তরের মানুষের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হয়।
আমরা ছাত্র জীবনে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাত বারোটার পর শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়েছি, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি এবং গানও গেয়েছি অনেক অনেকবার।
আজও যেন মনে হয় কেউ কেউ ইংরেজি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কাছে বাংলা এখনো মনের মন্দিরে অভিষিক্ত হয়নি। একথা সত্য যে, আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য এবং বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়া ও গবেষণার জন্য ইংরেজি প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য মাতৃভাষাকে হেয় করা চলবে না। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজগুলো লিখতে হবে তাই বলে বাংলাকে অবহেলা করা যাবে না। আব্দুল গাফফার চৌধুরী‘র সেই অমর গান আজও আমাদের প্রদীপ্ত করে, তার একটি লাইন হল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’।
আরো যখন শুনি ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’– ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’ তখন সুস্থ চেতনার গভীরে মন প্রবেশ করে।
প্রতিবছরের মতো এবারও একটি ২১ শে ফেব্রুয়ারি এসেছে, তাই সেই প্রত্যয়ী চেতনায় আমরা যেন, জাতির পিতা পরম শ্রদ্ধেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হই, সেই হাতে তার সুযোগ্য কন্যা, গণতন্ত্রের বলিষ্ঠ প্রবক্তা, দার্শনিক, রাষ্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করি।
ভাষা আন্দোলন এক সুদূর প্রসারী সংগ্রামী চেতনার মহতি প্রেরণা। এই আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেছিল। সে চেতনার পথ ধরেই আমাদের মহান নেতা বাঙালির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বর্তমানে তার সুযোগ কন্যা বিশ্ব মানবতার প্রতিভু ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিশ্বে এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। আজ দেশের মানুষ স্বাধীনতার সুফল পাচ্ছে, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম পরিচালিত হচ্ছে জনগণ মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে, দেশের অগ্রগতি হচ্ছে, উন্নয়নের চাকা চলমান। গৃহীত হয়েছে নানামুখী কল্যাণকামী কর্মসূচি যারা দেখেও দেখেন না তারা চিরকালই অন্ধের মত পথ হারাবে।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ।