বালিসোনার মহাকাব্য

ওমর কায়সার | শুক্রবার , ১ জুলাই, ২০২২ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

বালিসোনা একটি গ্রামের নাম। সেই গ্রামের পশ্চিমে জলের অতীত নিয়ে শুয়ে আছে সুদীর্ঘ এক নদী। এক শতাব্দী আগে সে-নদী জীবন্ত ছিল। কেউ কেউ তাকে আদিগঙ্গা বলে ডাকে। এখন সে অতীত। হয়তো কোনোদিন আবার কবর থেকে উঠে এসে স্রোত ফিরে পাবে। তাকে তখন কেউ ডাকবে পাতালগঙ্গা নামে, আবার কেউ কেউ মিতাম্বর বা শাখানদীও ডাকতে পারে। সেই ঘুমিয়ে পড়া নদীটির পূর্ব দিকে বালিসোনা গ্রামে বর্তমান বয়ে যাচ্ছে জীবনের মহাসমুদ্রের দিকে। ওখানে জীবনের কোলাহল। কত শত বছর ধরে এখানে মানুষ আসে, কিছুদিন কাটিয়ে চলে যায় অনন্তকালের দিকে। বালিসোনা যেন আমাদের এই সবুজ পৃথিবীর একটা প্রতীক। এখানে মানুষের জন্ম হয়, তারপর নানা বাঁক পেরিয়ে, সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার নানা ঘটনা ঘটিয়ে, দুর্ঘটনার শিকার হয়ে, দৈবদুর্বিপাকে পড়ে, অপঘাতে, দারিদ্র্যে, ঐশ্বর্যে, সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে একটি জীবন কাটিয়ে দিয়ে কোথায় যেন চলে যায়। আবার নতুন মানুষ আসে। বালিসোনার শত শত বছরের জীবনের প্রাণবন্ত উপাখ্যানের নাম বিষাদগাথা। এই উপখ্যানের রচয়িতা অমরেন্দ্র চক্রবর্তী।

আজ থেকে প্রায় প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই নামটির সঙ্গে আমি পরিচিত হয়েছি। তাঁর লেখা ছোটদের বই ‘পাখির খাতা’ আমাকে দেখিয়ে মোমেন ভাই (কবি, প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন) বলেছিলেন, শিশু সাহিত্য এরকমই হওয়া উচিত। এটা পড়ে দেখ। আর এই বইতে চট্টগ্রামের কথা উল্লেখ আছে। প্রথমেই বইটির প্রচ্ছদ দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। পড়ার পর মনে হলো আরেকবার পড়ি। দ্বিতীয়বার পড়া শেষ করে মনে হলো আবার পড়ি। প্রিয় কোনো গান যেমন বারবার শুনতে ইচ্ছে করে, তেমনি প্রিয় বইগুলোও বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। এমন মন মজিয়ে রাখার মতো শিশুসাহিত্যের উদাহরণ দেখে আমি লেখকের ভক্ত হয়ে গেলাম। সেই থেকে সংগ্রহ করে পড়েছি তার ‘হীরু ডাকাত’, শাদা ঘোড়া, গৌর যাযাবর, তালগাছের ডোঙা, হরিণের সঙ্গে খেলা, আমার বনবাস সহ আরও কত কী। এর কদিন পর জানলাম আমার প্রিয় শিশু সাহিত্যিক দারুণ দারুণ সব ভ্রমণকাহিনিও লেখেন। সময় গড়িয়ে যায়, আর আমি নতুন নতুন অমরেন্দ্র চক্রবর্তীকে আবিষ্কার করি। তিনি কখনো শিশু সাহিত্যিক, কখনো পর্যটক, কখনো ভ্রমণকাহিনী রচয়িতা, কখনো ছোটগল্পকার, কখনো চিত্রশিল্পী। সব্যসাচী আক্ষরিক অর্থেই তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত করা একেবারে যথার্থ হবে। আমি জানতাম না একজন পাঠক হিসেবে আমার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছে। সেই বিস্ময়ের নাম বিষাদগাথা।

বালিসোনা নামে একটি গ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাসের বিস্তার। সেই বালিসোনায় যতদিন আমি ভ্রমণে ছিলাম, ততদিন এই পার্থিব পৃথিবীর অন্যসব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। বুঁদ হয়ে আটকে ছিলাম মন্থরোর মায়ের মায়ার জালে। হারিয়ে গিয়েছিলাম সামন্ত প্রভু ভুবনমোহন শেষ জীবনের সঙ্গে। তিনমাসের জন্য ত্যাজ্যপুত্র হওয়ার বেদনা প্রৌঢ় হয়েও ভুলতে না পারা অবনীমোহনের সংসার ত্যাগে যেমন বিষণ্ন হযেছিলাম, তেমনি লক্ষীপ্রতিমার জন্ম, কলকাতায় গিয়ে পড়ালেখা, অতপর ভারতসুন্দরী হয়ে তারকাখ্যাতি লাভ করে বালিসোনার প্রেমে ফিরে আসার পর বিস্মিত হয়েছিলাম। স্বরস্বতীর জন্ম, তার বেড়ে ওঠা, ধর্ষণের শিকার হওয়া, গয়ানাথ নামে এক মেথরের কাছে অপমানিত হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর অম্বরীশ এসে স্বরস্বতীর উপর নৃশংস আচরণের প্রতিশোধ নিয়ে আবার চলে যাওয়ার মতো অসংখ্য ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়েছিলাম। বালিসোনা যেন এক অতিকায় সজীব সচল এক মহাকালের মঞ্চ। ওখানে অবিরাম মঞ্চস্থ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক নাটক। বহু মানুষ, বহু জীবন, বহুকালের ঘটনা নানা সূত্রে এসে বালিসোনায় মিলেছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ক্ষীণ থেকে শুরু করে খর, ক্ষীণ, প্রশস্ত বহু জলধারা যেমন সাগরে এসে মিলেছে, তেমনি বহু জীবনের ধারা এই বালিসোনায় এসে মিশে গেছে। এত মানুষ, এত কাহিনি, এত ব্যাপ্ত প্রত্যেকের জীবন ঠিক শুরু থেকে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কাকে ঘিরে মূল কাহিনিটা এগিয়ে যাবে। না, প্রধান চরিত্র বলতে এখানে কাউকে তেমন খুঁজে পেলাম না।

উপন্যাসের প্রথম সিকি অংশেই দেখলাম মন্থরোর মা, অবনীমোহন, ভুবনমোহন, অম্বরীশ, সরোজিনীর জীবনের উত্থান এবং পরিণতি। যার প্রসঙ্গ আসে তাকেই মনে হয়েছে বোধয় এটাই প্রধান চরিত্র। এটা ঠিক, প্রতিটি মানুষই তো যার যার জীবনকাহিনিতে মুখ্যচরিত্র। পৃথিবীতে যত কোটি মানুষ আছে, তত কোটি জীবনের কাহিনি আছে। বালিসোনার প্রতিটি মানুষের বেলায়ও তো একই ব্যাপার। প্রত্যেক মানুষের জীবন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। জমিদারের যেমন জীবন আছে, জমাদারেরও জীবন আছে, ভিক্ষাবৃত্তি করে যে জীবন চালায় তারও জীবনের কাহিনি আছে। তাই প্রতিটি চরিত্রই মুখ্য হয়ে আলো ছড়ায় বিষাদগাথার পাতায়-পাতায়। নানা মানুষের জীবনের আদ্যোপান্ত কাহিনির মহামিলনে, মহাজীবনের প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পেয়েছি এই সাহিত্যকীর্তিতে মহাকাব্যের আমেজে। পড়তে পড়তে তাই মনে হয়েছে বিষাদগাথার প্রায় প্রতিটি চরিত্র নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উপাখ্যান তৈরি হতে পারত। হতে পারত আলাদা আলাদা গল্প কিংবা উপন্যাস। প্রত্যেকটা চরিত্রের বেড়ে ওঠা, উত্থান আর পরিণতি দেখে সেরকমই মনে হলো। মন্থরোর মায়ের কথাই ধরি। এই মানুষটার পুরো একটা জীবন এখানে বর্ণিত আছে।

একেবারে জন্ম থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। শুধু তার বৃত্তান্ত নয়, তার পূর্বপুরুষ বালিসোনায় এসে কীভাবে বংশপত্থন করেছিল তাও পাওয়া যায়। একটি মানুষের জীবনের ভিতর দিয়ে উপন্যাসে উঠে আসে একটা পুরো লোকালয়ের উত্থানের কাহিনি ‘মন্থরোর মা’র ‘নানা’ ভাতের সন্ধানে মুর্শিদাবাদের লালবাগে গোরুর মেটের মতো পাতলা ইটের জরাজীর্ণ আব্বানানার ভিটে আর তাদের পরিবারের নিজস্ব কবরস্থানের মায়াত্যাগ করে ঘুরতে-ঘুরতে বালিসোনার এই পশ্চিম সীমানায় এসে যখন ডেরা বাঁধে তখন এখানকার এইসব গ্রাম বলতে ছিল শুধু বন-জঙ্গল।’ সেই জঙ্গলে মন্থরার মায়ের পূর্বপুরুষেরা লালবাগ নামে একটি এলাকার পত্তন করে। উপন্যাসের ৪৬টি পর্বের মধ্যে প্রথম ছয়টি পর্বেই মন্থরোর মায়ের পুর্বপুরুষের আবির্ভাব, তার জন্ম, বিয়ে, জীবিকা এবং জীবনের অবসান ঘটে। কিন্তু পুরো উপন্যাস জুড়ে তার রেশ থেকে যায়। অবাক লাগে হতদরিদ্র এই নারী যে প্রাণ হারিয়েছে সাপের ছোবলে, যার দুটো সন্তানও মারা গেছে সাপের কামড়ে, যার জীবন দারিদ্রে জর্জরিত, জীবনের শেষ দিকে যে বাধ্য হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিতে, সেও চরিত্রে আশ্চর্য মহিমাময়ী। কাউকে ঠকানো যার স্বভাবে নেই, বরং নিজেই ঠকবার জন্য স্বভাবটিকে বাগিয়ে রেখেছে। উপোস করে কিন্তু কখনও মুখ ফুটে দুটো পয়সা চাইত না। মন্থরোর মা সারা জীবন একটা কাজ করে গেছেন যেভাবে হোক সংসারের দুটো ভাত যোগাড় করা। সেই মন্থরোর মা মারা যাওয়ার বহু বছর পর তার ছেলে মন্থরো আশি বছর বয়সেও কপাল চাপড়ে কাঁদে আর বলে, ‘আম্মা ভেন্ন কে আমার ক্ষুদার অন্ন জোগাবে’। সেই কান্না যেন অন্নপূর্ণার জন্য এই পৃথিবীর কান্না, বালিসোনার কান্না। মন্থরোর মায়ের জীবন অবসানের মধ্য দিয়ে একটা উপকাহিনির শেষ নয়, বরং উপন্যাসের ভেতর আরেকটি উপন্যাসের যেন সমাপ্তি ঘটল। বিষাদগাথার প্রতিটি পর্ব অবিচ্ছিন্ন থেকেও প্রতিটির আলাদা আলাদা জৌলুষ আছে। সেই জৌলুষ জীবনের জৌলুষ। তাতে মানুষের মাহাত্ম্য যেমন আছে, তেমনি আছে বিষাদ।

উপন্যাসের শুরুতে মনে হয়েছিল আখ্যানের কেন্দ্র বুঝি লক্ষী প্রতিমা। জমিদারের বংশধর হয়েও যাকে জন্ম নিতে হযেছিল গ্রামের সাধারণ একটি হাসপাতালে। কিন্তু উপন্যাসের গতি সে দিকে যায়নি। নানা শাখা-প্রশাখা বেরিয়ে সেটি সুবিশাল অশ্বত্থের মতো বিস্তৃত জায়গায় ছায়া ফেলেছে। জন্মের পর লক্ষীপ্রতিমা মিস ইন্ডিয়া হতে লেগেছে মাত্র কয়েকশ শব্দ। সংক্ষিপ্ত বিবরণে তাকে জন্ম থেকে যৌবন পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে। লেখক শুরু করেছেন অন্যগল্প। বালিসোনার অন্য মানুষ উঠে এল সেই গল্পে। কারণ লক্ষ্মী প্রতিমা তখন বালিসোনায় ছিলেন না। সব ঘটনার স্থান কিন্তু বালিসোনাই। পরে অবশ্য ভারতবিখ্যাত লক্ষীপ্রতিমা যখন বালিসোনায় ফিরে আসেন তখন তার কাহিনি আবার শুরু হয়। আসার পরই তার বাবা সন্ন্যাস ধর্ম নিয়ে কোথাও নিরুদ্দেশ হন। যে অনুন্নত হাসপাতালে তার জন্ম হযেছিল, সেটিকে মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেন তিনি। হাসপাতাল গড়ে তোলা সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে সেখানে সংসার শুরু করেন এক ভিনদেশিকে নিয়ে।

আবার বলেছি বিষাদগাথার প্রতিটি চরিত্রই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র। পড়তে পড়তে প্রতিটি চরিত্রের প্রতি কৌতূহল সৃষ্টি হয়। পাঠকের আগ্রহ জন্মায় তার পরিণতি কোন্‌ দিকে গেছে তা জানার। পাঠক গভীর আগ্রহে নিমগ্ন হয় কোনো এক চরিত্রের ভেতর। ঠিক তখনই উড়ে আসে অন্যকাহিনির মানুষ। পাঠক নতুন মানুষের সান্নিধ্যে আসে। এইভাবে একের পর এক চরিত্রের উত্থান পতনের স্রোতের ভেতর পাঠক ভাসতে ভাসতে জীবনের মহাসমুদ্রে হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় তবে তলিয়ে যায় না, মজে যায়। কারণ অমরেন্দ্র চক্রবর্তী এই উপন্যাসের জন্য এমন একটা ভাষা তৈরি করেছেন যে ভাষা আমাদের টানে কাহিনির পরিণতির দিকে। একরৈখিক নয়, বরং বহু বিচিত্র পথে এগিয়ে যায় গল্পগুলো। ভাষা যা কখনো কবিতার মতো, কখনো আবার সংবাদ ভাষ্যের মতো, কখনো ছোট ছোট বাক্যে চিত্ররূপময়, কখনো সুদীর্ঘ বাক্যের মায়াজালে বাঁধা। কখনো কখনো চলচ্চিত্রের মতো চারপাশের নিখুঁত, অনুপুঙ্খ ছবি তুলে ধরা হয়েছে। চারপাশের পরিবেশ, প্রতিবেশ, চরিত্রের চিত্রন, আমেজ ফুটিয়ে তুলতে তিনি ভাষাকে নিজের মতো ব্যবহার করেছেন। বিষাদগাথার কিছু কিছু বাক্য যদি আলাদাভাবে কাউকে শোনাই তবে মনে হবে কোনো কবিতার অংশ।

কিন্তু এই বিশাল সৃষ্টির পুরোটাকে কিছুতেই কাব্যাক্রান্ত বলা যাবে না। কয়েক প্রজন্মের, বহু বছর ধরে বিস্তৃত পটভূমিতে কাহিনিপুঞ্জের বর্ণনায় সক্ষম একটা গদ্যশৈলী অনিবার্য ছিল বিষাদগাথার জন্য। সেই যথার্থ ভাষায় আমরা পেয়ে যাই বহু মানুষের জীবনের উত্থানপতনের নানা কাহিনি। এই ভাষা অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর নিজস্ব ভাষা। উপন্যাসের অনেক জায়গায় দেখি প্রলম্বিত বাক্য। চলচ্চিত্রে ওয়াইডএঙ্গেলে যেরকম আমরা অনেক বড় একটা এলাকা বা বহু মানুষের কর্মযজ্ঞ একসঙ্গে দেখি তেমনি এই উপন্যাসেও আমরা সেরকম দৃশ্য দেখতে পাই। সেরকম দৃশ্যের বর্ণনার জন্য দীর্ঘ বাক্যের কোনো বিকল্প ছিল না। পাঠক বুঝতে পারে না কখন কাহিনির ঘোরের ভেতর দীর্ঘ এক বাক্যের ভেতর ডুবে গেছেন। অবনীমোহন সন্ন্যাসী হয়ে বাড়ি ছাড়ার পর হঠাৎ করে ভুবনমোহন বাকশক্তি ফিরে পায়। তার মৃত্যুর ঠিক আগে বাদার জলে বালিসোনার নানা বয়সের মানুষের মাছ ধরার অসাধারণ দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে ১১ লাইন দীর্ঘ একটি বাক্যে। সবমিলয়ে এই উপন্যাসের গদ্যে একটা ভিন্ন স্বাদ পেয়েছি। আমার পাঠস্মৃতির মধ্যে বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসগুলোর যে একটা ছোট তালিকা আছে, সেগুলোর মধ্যে বিষাদগাথা এক অন্যরকম উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

বালিসোনার জল মাটি হাওয়ায় গড়ে ওঠা সংস্কৃতিকে যারা লালন করেন, এসব মানুষকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করে ভাবা যায় না। মানুষের কথা বলতে গিয়ে তাই বিষাদগাথায় বার বার এসেছে প্রকৃতির কথা। বাংলার ছয়টি ঋতু যেমন বছর বছর ঘুরে ঘুরে এসে মানুষের জীবনাচরণে প্রভাব ফেলে তেমনি এই উপন্যাসের নানা পর্বে নানা ঋতুর কথা বার বার এসেছে।

চিরকালের বাংলার এই প্রকৃতির চেহারা আমরা উপন্যাসের প্রথম দিকে দেখতে পাই। পাশাপাশি সময়ের তালে-তালে লক্ষ্য করি বালিসোনার বিবর্তন। চারপাশে ঘনজঙ্গলে ভর্তি একসময়ের বালিসোনা ক্রমশ নগরায়ন ও শিল্পায়নের শিকার হয়। প্রযুক্তির হাত ধরে বালিসোনা এবং তার মানুষ এগিয়ে যেতে থাকে। পেছনে পড়ে থাকে সেই বনাঞ্চল ঘেরা বাদা। সেই ফেলে আসা দিন হয়তো কারো কারো স্মৃতির মধ্যে থাকে। সেই স্মৃতিকেই আঁকড়ে ধরে মানুষ কেউ কেউ। যাদের মুখে স্মৃতি নিয়ে দার্শনিকের মতো উক্তি উচ্চারিত হয়। এরকম একটা অমোঘ উচ্চারণ পাই আমরা সপ্তম পর্বে। তার আগে এই পর্বে এক অলৌকিক ঘটনার কথা বলি। এই ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়েছে অবনীর ভাই, পরিক্ষীতের বাবার অম্বরিশের। একদিন রাতে সে দেখল জানলা টপকে একটা কঙ্কাল এসে ঘরে ঢুকছে। পিছনে আরেকটা, তার পিছনে আরও একটা। অম্বরিশ সারারাত ধরে তাদের সঙ্গে কথা বলে। সেই সময় তার ভাই অবনির মুখ থেকে শুনি সেই বাক্যটি ‘কারও জীবন আসলে তার সারাজীবনের স্মৃতিপুঞ্জ ছাড়া আর কিছু নারে। বর্তমানের সঙ্গে অতীতের নাড়ির যোগ। সব স্মৃতি হয়ে বিস্মৃতির সিন্দুকে রাখা থাকে।’

অতীতের এইসব স্মৃতি বিস্মৃতি নিয়ে বর্তমান চলতে থাকে বালিসোনায়। ঘটনা, দুর্ঘটনা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, দাঙা, হাঙামা, প্রেম, খুন প্রেম বিয়ে, জন্ম মৃত্যু জীবনের সকল অনুষঙ্গ পৃথিবীর আর সব জনপদের মতো বালিসোনার বর্তমানেও আছে। লৌকিক এই পৃথিবীর ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই তো এখন মানুষকে ঘিরে। তাই তার প্রতিক্রিয়াও ঘটতে থাকে মানুষের অবচেতনে। সেই অবচেতনের চিত্রগুলো আমরা এই উপন্যাসে দেখতে পাই অলৌকিক ঘটনাবলীর মাধ্যমে। এটা কী একধরনের যাদুবাস্তবতা? যাই হোক, বিষাদগাথায় যে অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী আমরা হয়েছি তার বর্ণনার কৌশলে তা লৌকিক ঘটনার মতোই স্বাভাবিক এবং সত্য বলে মনে হয়। আর তাতে করে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চরিত্রের মানসিক অবস্থা পরিমাপ করে নিতে পারি। বুঝে নিতে পারি মানুষের অমোঘ পরিণতির বিষয়টি। সঙ্গে সঙ্গে অনুধাবন করতে পারি সময় গড়িয়ে যেতে যেতে বালিসোনার মতো আমাদের পৃথিবীটা কেমন বদলে যাচ্ছে। চারপাশের জগতটা কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। সন্ন্যাস ধর্ম নিয়ে ফিরে আসার পর আফসোস করে তাই অবনি বলেছিল, ‘যে বালিসোনা আমি ছেড়ে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে সেই বালিসোনাকে আর খুঁজে পেলাম না। অম্বরীশের পায়ের ক্ষত দেখলেই বোঝা যায় বালিসোনায় পচন কতদূর ছড়িয়েছে।’ অবনির এই আক্ষেপের সঙ্গে পাঠকের অন্তরও বিদীর্ণ হয়। এই মুহূর্তে আমরা স্মরণ করতে পারি সেই ভয়াবহ রাতের ঘটনা ‘দেওয়ালির রাতে আকাশ জ্বালিয়ে বাজি পুড়িয়ে, বাতাস কাঁপিয়ে পটকা ফাটিয়ে, তৃপ্তিসহকারে পানভোজন শেষ করে অনেক রাতে সবাই ঘুমে অচেতন, সেই ফাঁকে ওপরের দুটি তলা থেকে তিপান্নটি ঝুলবারান্দা সমেত হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল।’ পৃষ্ঠা ২১৯
তখন আমার মতো পাঠকের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়ে বালিসোনার আদিবাসী বৃদ্ধরা বলতে লাগল ‘নদী আকাশ চায়, বাতাস চায়, দুই তীর তার বৃক্ষশিকড়বন্ধন চায়, বুকের ওপর ঘরবাড়ির এত জঞ্জালভার সেই সইবে কেন!’

শুরুতে বলেছিলাম বালিসোনা যেন আমাদের পুরোনো এই পৃথিবীর একটি প্রতীক। বালিসোনার ভেতর দিয়ে আমরা পৃথিবীকে আর তার মানুষগুলোকে দেখি। বিষাদগাথা মূলত মানুষের মহাকাব্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযৌবনের জয়গীতি ওড়ায় পতাকা
পরবর্তী নিবন্ধসরকার কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে