বারমুডার রহস্য

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:৫৬ পূর্বাহ্ণ

আজকের এই লেখাটি একজন পাঠিকার অনুরোধে লেখা হলো কৌতুহলি মানুষজন মেরিনারের সাক্ষাৎ পেলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্ন করে; কিন্তু সেগুলোর মাঝে কয়েকটা প্রশ্ন খুবই কমন প্রায় সকলেই সেটা করে থাকে। যেমন জাহাজে বোরিং লাগে না? রাতের বেলায় কী জাহাজ চলে নাকি? ঝড় হলে কী করেন? পানামা ক্যানেলে গিয়েছেন কিনা? ইত্যাদি। তবে একটা প্রশ্ন বেশ অনেকবারই শুনতে হয়েছেবারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে গেছেন নাকি? সেখানে তো খুবই খারাপ অবস্থা। আপনাদের জাহাজের কিছু হয়েছে নাকি?

বরাবরের মতই আমার উত্তর থাকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল একটা বোগাস জিনিস, এইটা নিয়ে সময় নষ্ট করার কোনই মানে নাই। সকলের এত উত্তেজনাকর টপিকে আমি এমনি করে জল ঢেলে দেই, আর দেখতে পারি, প্রশ্নকারীর মুখ ফুটাবেলুনের মতই চুপসে যায়। সে ধরেই নেয় যে, হয় আমি সেখানে যাই নাই, কিন্তু মুখরক্ষার জন্যে চাপা মারছি। অথবা আমি বারমুডা কী সেটাই চিনিই না। কিন্তু, আমি কী করবো? যা সত্যি তাইই বলছি। হ্যা, অবশ্যই স্বীকার করি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে অনেক জাহাজপ্লেন হারিয়ে গেছে, কিন্তু সেরকম ঘটনা/দুর্ঘটনা (বা কেউ কেউ বলে আধিভৌতিক ঘটনা); বিশ্বের অন্যান্য অনেক স্থানেই হয়, অহরহই হয়। তাই বলে তো সবগুলোকেই রহস্যময় করে তোলা উচিৎ না। আর বারমুডাকেই বা ফার্স্টপ্রাইজ দিতে হবে কেনো? যদি পরিসংখ্যান ঘাঁটা হয়, তাহলে দেখবেন অন্য অনেক জায়গাতেই বারমুডার তুলনায় অনেক বেশী জাহাজ বা প্লেন দুর্ঘটনা হয়েছে বা হারিয়ে গেছে। কিন্তু ঐযে, কিছু কিছু লেখকসাংবাদিক, নিজেদের লেখার কাটতি বাড়ানোর জন্যে কলমের সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত রঙ (সেইসঙ্গে কিছু কিছু ধুঁয়া) মিশিয়ে মানুষের দৃষ্টি কাড়তে চায়। আসল কথা হলো আদিকাল থেকেই মানুষ রহস্যরোমাঞ্চ পছন্দ করে। ভৌতিক, আধিভৌতিক, অস্বাভাবিক যে কোনো কিছুর দিকেই আমাদের আকর্ষণ বেশী। আর সেই সুযোগ পেয়ে লেখকগোষ্ঠির কেউ কেউ যত ধরনের রঙ লাগানো সম্ভব, সব তো লাগায়ই; তার উপরে আরো যতকিছু সম্ভব মাথা থেকে বের করে করে লিখে ফেলে। আমি নিজেও এর উপরে বেশ অনেকগুলো বই পড়েছি। স্কুলকলেজে থাকতে রোমাঞ্চিত হতাম; জাহাজের জীবনে বহুবার বারমুডা পার হয়ে হয়ে, সেই ভুল ভাঙ্গে। এটাকে ডেভিল’স টায়াঙ্গেলও বলে।

এই বছরখানেক আগেই, টলিডোতেই, বাংলাদেশীদের এক উইকএন্ডের পার্টিতে এক ভদ্রলোক বারমুডা প্রসঙ্গ তুললেন। তিনি উচ্চশিক্ষিত, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ ডক্টরেট; বর্তমানে Intelএ চাকরি করেন। ভদ্রলোক টিভিতে ডিস্কভারি চ্যানেল বা ন্যাশানাল জিওগ্রাফির কোন প্রোগ্রাম দেখে এসে, আড্ডার মাঝে বারমুডা নিয়ে মহা এক গল্প ফেঁদে বসলেন। টেবিলে সবার সঙ্গে তর্কবিতর্ক চালালেন। থিওরি দিলেন মিথেন গ্যাসের বুদবুদ সৃষ্টি হয়ে জাহাজ বা প্লেন খেয়ে ফেলে (বা গায়েব করে দেয়)। আমি দূরে বসে মিটিমিটি হাসছিলাম। একসময়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি নিজে বারমুডায় গিয়েছেন কখনো? উত্তর তো স্বাভাবিক না যাই নি। কেউ গিয়েছে, এরকম কারো সঙ্গে কথা বলেছেন? না, তাও বলিনি; কিন্তু টিভির প্রোগ্রাম তো দেখলাম, তারা তো বললো। আমি বললাম, আপনি এখন কথা বলছেন এমন একজনের সঙ্গে, যে জীবনে অনেকবার বারমুডা পাড়ি দিয়েছে; কিন্তু কিচ্ছুই দেখে নাই। প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খায়; বুঝতে পারে নাই। পরে বুঝতে পারলো। আশেপাশের যারা আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জানে, তারা পরিচয় করিয়ে দিলো ইনি প্রাক্তন মেরিনার। ভদ্রলোক একটু দমে গেলেও, নিজের পয়েন্ট থেকে নড়লেন না। আমিও, বনের গাধাকে ঘাস যে নীল নয়, সেটা বুঝানোর বেশী চেষ্টা করি না। সে ঘাসকে নীল বলুক, মেজেন্টা বলুক, যা খুশী বলুক।

আপনাদের বলি সমুদ্র একটা ভয়াল, ভয়ানক জায়গা। এর রূপ ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে পারে। শান্ত পুকুরের মতও থাকেমনে হবে মোজাইক করা ফ্লোর। আহ্‌! জীবন কী সুন্দর। কিন্তু, আবার সেই একই সমুদ্রই কয়েকঘন্টা পরে এমন রুদ্ররূপ নিতে পারে যে, সবই লন্ডভন্ড করে দিয়ে চলে যাবে। এতে আমরা মেরিনাররা একদমই বিস্মিত হইনা, ভড়কে যাই না। আমরা সমুদ্রে কীভাবে চলবো বা জাহাজ কীভাবে চালাবো, সে ব্যাপারে ভুড়ি ভুড়ি আইনকানুন আছে। কিন্তু সমুদ্র নিজে কী করবে সে জন্যে তো কেউ কোনো আইনকানুন, রুল্‌স্‌রেগুলেশান তৈরী করে নাই। দুনিয়ার এক এক জায়গায়, এক এক কারণে সমুদ্রের রূপ শান্ত বা ভয়াল হতে পারে। বাতাসের গতি ও গতিপথ, বাতাস ও পানির তাপমাত্রা (আসলে দুইটার তাপমাত্রার মধ্যের পার্থক্য), সেইসঙ্গে সমুদ্রের তলদেশ সমতল না পাহাড়িয়া, প্রবাল পাথর, নানান কারণে কিছু কিছু জায়গা সবসময়ই উত্তাল থাকে। যেমন ধরুন সাউথ চায়না সী, বে অফ বিস্কে, নর্থআটলান্টিক, কেইপ অফ গুড হোপ ইত্যাদি। এগুলো সবগুলোই আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের প্রধান রুটের মধ্যে পড়ে। আর আমাদের জাহাজগুলোও সেই জায়গাগুলোতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে; কিন্তু কিস্যু করার নাই। জাহাজ তো চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বারমুডাও এইরকমই একটা ব্যস্ত সীরুট। অন্যান্য জায়গার মতই এখানেও জাহাজ নাজেহাল হয়ে, নাকানিচুবানি খায়; ডুবেছেও বেশ কয়েকটা। এই ব্যাপারটা অস্বীকার করছি না; কিন্তু তাই বলে সেগুলো রহস্যময় না কোনোমতেই। প্রত্যেকটারই পিছনে যুক্তি বা প্রতিকূল আবহাওয়া আছে।

ঘটনার শুরু আদিকালে, হয়তো সেই কলম্বাসের আমলেই। কিন্তু তখনো নাবিকেরা সেই অঞ্চলকে স্রোতআবহাওয়ার জন্যে দোষারোপ করতো। ১৯১৮ সালে অ্যামেরিকার ইউ.এস.এস. সাইক্লোপ জাহাজ এবং এর পরে ১৯৪৯ সালে নেভীর পাঁচটা বিমান, তারপরে ১৯৬৩ সালে সালফার কুইন জাহাজ এবং আরো অনেকগুলো জাহাজই নিখোঁজ হলো। এর ফলে যা হওয়ার তাইই হলো, কিছু লেখক সাংবাদিক সেগুলোকেই ফুলিয়েফাঁপিয়ে ছাপিয়ে দিয়ে নিজেদের লেখার কাটতি বাড়ালেন। তারা কিন্তু, লেখার সময়ে, অনেককিছুই উহ্য রাখলেন তখনকার আবহাওয়া কেমন ছিলো, জাহাজগুলোর নিজেদের কন্ডিশান কেমন ছিলো, পাইলটক্যাপ্টেনদের দক্ষতা অনেককিছুই। অথবা এমনও হয়েছে, পরে জাহাজ খুঁজে পেলেও, সেটার আর উল্লেখ করে নাই। ভীষণ ঝড়ঝঞ্ঝার মাঝে জাহাজের ক্ষতি হলেও বা ডুবে গেলেও, লিখে দিলো উজ্জ্বল ঝকঝকে দিনে জাহাজটা হারিয়ে গেলো। সাধারণ মানুষ তো তাইই চায়। বোরিং খবর কয়জনা গিলবে? সময়কালের দিকেও খেয়াল রাখবেন দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের পরে, অ্যামেরিকা তখন সুপারপাওয়ার হিসাবে বিশ্বের শীর্ষে। অন্যান্য সবকিছুর ব্যুমিংএর সঙ্গে সঙ্গেই হলিউড, মিডিয়া, টিভির জগতে অ্যামেরিকান আধিপত্য। সেখানের সাংবাদিকলেখকরা হুজুগে অ্যামেরিকানদের জন্যই যুৎসই প্লট নিয়ে লিখে দিলোআর সেটাই বাজারে চললো হটকেকের মত।

বিশ্বের নামকরা শিপিং ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লয়েড’স অফ লন্ডন বা অন্যান্যরা বারমুডার ব্যাপারে সোজাসাপ্টা বলে দেয় এখানে অসাধারণ কিছুই নাই; বিশ্বের অন্যান্য সমুদ্রের বিপজ্জনক জায়গাগুলোর মতই, বারমুডাও একটা। এর নামের গুজব ছাড়া এর আর বেশী কিছুই নাই। আর জোর করে বলা যায় যে, বিপজ্জনক হিসাবেও এইটা নাম্বার ওয়ান হয়তো না। তবে গুজবের মোহজাল ছড়িয়ে মানুষকে বোকা বানানোর ব্যাপারে মনে হয় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল অনেক অগ্রগামী। ইম্পর্ট্যান্ট ঘটনাকে ইন্টারেস্টিং বানানো একধরনের পজিটিভ দক্ষতা; আর অন্যদিকে ইন্টারেস্টিং ঘটনাকে আরো রঙ দিয়ে ইম্পর্ট্যান্ট করে তুলার ব্যাপারটা আমার কাছে তেমন বেশী পজিটিভ কিছু বলে মনে হয় না। আপনারাই বিচার করুন। আপনি নির্বিঘ্নে বারমুডা ঘুরে আসতে পারেন। অবশ্য কিছু যদি ঘটেই যায়, তাহলে আমাকে দোষ দিয়েন না। অযাচিত কিছু ঘটলে, অবশ্য আপনিই তো ফেরত আসবেন না, তাই না?

টলিডো, ওহাইও, ২০২২

rafayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনশ্রু ঈশ্বর
পরবর্তী নিবন্ধচিটাগাং সংবাদপত্র হকার্স সমিতির সাধারণ সভা