বাধ্যতামূলক নয়, ঐচ্ছিক মাতৃত্ব এবং পিতৃত্ব

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

হ রূপা দত্ত | শনিবার , ৩০ জুলাই, ২০২২ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

আমরা থাইল্যান্ডের চ্যাংরাই শহরের শহরতলীতে সুপাকররে বাড়িতে উঠেছিলাম ৩ দিনের জন্য। কিন্তু, ৩ দিন পেরিয়ে আমরা ৭ দিন ছিলাম। সুপাকরণের সানন্দে আমাদের থাকতে দিয়েছিল। কেবল থাকতে দিয়েছিল তা নয়, খেতে দিয়েছিল এবং ঘুরতেও নিয়ে গিয়েছিল। আমরা থাকাকালীন পোল্যান্ডের দু’জন ভ্রমণকারীও উঠেছিল সুপাকরনের বাড়িতে। ১৮/১৯ বছর বয়সী পিটার এবং তার বন্ধু। ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রায় কয়েকমাস ধরে। থাইল্যান্ডে আসার আগে ওরা লম্বা ভ্রমণ করেছে নেপাল এবং ভারতে। কথায় কথায় পিটার বলছিল, ওরা আলুর খুব অভাববোধ করেছে থাইল্যান্ডে। পোল্যান্ডে ওদের প্রিয় খাবার আলু। নেপালেও খুব একটা আলু খেতে পারেনি, কিন্তু ইন্ডিয়াতে আলু খেয়েছে, যদিও একদম ভিন্ন প্রক্রিয়ায় রান্না করা। আর থাইল্যান্ডে এসে তো একদমই খেতে পায়নি। এই শুনে আমরা ঠিক করলাম আলু রান্না হবে। সুপাকরন সবসময় ফ্রিজে খাবার ভর্তি করে রাখতেন আমাদের জন্য। কাউচসার্ফিঙয়ের হোস্ট আন্তরিক হয় বলেই, ভ্রমণকারীদের নিজের বাড়িতে থাকতে দেয়, কখনও কখনও বেড়াতেও নিয়ে যায়। তবে এত খাবারদাবার খুব একটা দেখা যায় না। আমার বাসায় যখন আমি থাকতে দিতাম, আমিও খাওয়াতাম ভ্রমণকারীদের, কিন্তু সুপাকরনের আয়োজন অন্য লেভেলের। যদিও আমাদের নিজেদের রান্না করে খেতে হত, কেননা সুপাকরন এই বাড়িতে থাকতেন না, তিনি তাঁর স্বামী থাকতেন উনাদের অন্য বাড়িতে, এছাড়া ওনার নার্সিং পেশার জন্য খুব একটা সময়ও পেতেন না। আমরা সকালের আর দুপুরের খাবার একসাথে করে নিতাম, ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ মিলে এই সময়ে খাবারের নাম দেয়া হল ‘ব্রাঞ্চ’। ব্রাঞ্চের প্রথম এবং প্রধান সুবিধা হল আরামসে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানো যায়, আর রান্নাবান্নার ঝামেলা কমে যায়। রান্নার কাজ একেক দিন একেকজন করত। আমি আমাদের চট্টগ্রামের বিখ্যাত ডিম, আলু আর টমেটোর ঝোল রান্না করলাম একদিন। পিটার আলু সেদ্ধ করল, সেই আলু সেদ্ধ কিন্তু আমাদের মতো আলু ভর্তা না, কেবলই সেদ্ধ। নিনা একদিন করল স্ক্রেম্বেল এগ, মানে ডিমের ঝুরি ভাজি। এভাবে আমরা এক ঘরে থেকে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রান্নার সাথে পরিচিত হলাম। সুপাকরন সময় পেলে আমাদের সাথে যোগ দিতেন কখনও কখনও। একদিন সকালে সুপাকরনের সাথে আমি তাঁর অন্য বাড়িতে গেলাম। ছিমছাম পুরানো আবাসিক এলাকা। ওনার স্বামীর সাথে পরিচয় হল। ভদ্রলোক রিটায়ার্ড করে এখন ঘরে থাকেন, নিজের মতো সময় কাটান। ঘরের দেয়ালে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের নানান জায়গার ছবি ঝুলানো। সুপাকরনের স্বামী বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ জানেন। আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললাম। তারপর তিনি তাদের দেয়ালে ঝুলানো ছবির গল্প করতে লাগলেন। সুইজারল্যান্ডের বরফের মাঝে দু’জনের ছবি, কোন এক অফিসিয়াল কাজে গিয়েছিলেন, স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন। এক ছবিতে সমুদ্রের ধারে দু’জন দাঁড়িয়ে। গল্প করতে করতে বললেন, উনার ঘুরতে খুব ভালো লাগে। উনার সেই ঘুরে বেড়ানোর নেশা উনার স্ত্রী সুপাকরনের মধ্যেও সংক্রমন হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী দু’জন মিলে ঘুরে বেড়ান। এখন বয়স হওয়াতে একটু কমে গেছে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত, তাই তারা ভ্রমণকারীদের থাকতে দেন তাদের গল্প শোনার জন্য।
সুপাকরনের এবং তাঁর স্বামীর কোন সন্তান নেই। এ নিয়ে সুপাকরনের স্বামীর কোন আফসোস নেই। তাঁর মতে, তিনি তাঁর জীবন ভালোই কাটিয়েছেন। সন্তান থাকলে হয়ত অন্যরকম হতো, কিন্তু তা নিয়ে আফসোস করার কিছু নেই। কিন্তু, সুপাকরনের কাছে বিষয়টা একটু আলাদা। তাঁর একটা সন্তানের ইচ্ছে ছিল, কিন্তু হয়নি যখন তখন তো আর কিছু করার নেই। কম বয়সী ভ্রমণকারীরা যেন তাঁর সন্তান না থাকার অভাব পূরণ করে দিচ্ছে। কথা প্রসঙ্গেই জিজ্ঞেস করেছিলাম দত্তক নেবার বিষয়ে। সুপাকরন এবং তাঁর স্বামী দু’জনই জানিয়েছে দত্তক নেবার ব্যাপারে তারা খুব একটা স্বস্তি বোধ করেন না। সেদিন নানান বিষয়ে তাদের সাথে অনেক গল্প হয়েছিল।
সুপাকরন আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন চ্যাংরাইয়ের বিখ্যাত রাতের বেলায় রাস্তার উপরে জমে উঠা মার্কেটে। নানান রকমের জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল। এক দোকানীর সামনে সাজানো নানা রঙয়ের ফুল। জানা গেল, সাবান কেটে এইসব ফুল বানানো হয়েছে। পাশে বসে একজন সাবান কেটে কেটে রঙ্গিন ফুল সাবানের ফুল বানাচ্ছে। পুরো মার্কেট জুড়ে এমন সব শিল্পের সমাহার। মার্কেট থেকে আমাদের নিয়ে গেলেন বিখ্যাত রাতের রাস্তার খাবারের জায়গায়। মানুষে গমগম করছে, আমরা ঘুরে ঘুরে হরেক রকমের খাবার দেখতে লাগলাম। কি খাব তাই বুঝে উঠছিলাম না। সুপাকরনের উপর খাবার নির্বাচনের সব দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম। আমাদের এতগুলো মানুষকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, খাওয়ানোতে সুপাকরনের বেশ আনন্দ হচ্ছিল।
এই শহরেই আমার এক সিনিয়র সহকর্মীর শ্বশুরবাড়ি ছিল। তাঁরও কোন সন্তান ছিল না। একদিন এ প্রসঙ্গে কথা উঠার পর তিনি বলছিলেন, নিজের ইচ্ছেতে সন্তান নেয়নি। আমার সেই সহকর্মী যখন কেরিয়ার শুরু করেন, তখনও খুব বেশি মেয়ে জাতিসংঘের ঝুঁকিপূর্ণ চাকরি করতেন না। যারা জরুরি সাহায্যকে নিজের কেরিয়ার হিসেবে বেছে নেন, তাদের একটা বড় সময় কাটাতে হয় ‘নন-ফ্যামিলি’ ডিউটি স্টেশানে। মানে তাকে এমন জায়গায় কাজ করতে হয় যেখানে পরিবার নিয়ে থাকতে পারবে না, কারণ জরুরি সাহায্য সাধারণত যুদ্ধ বিধ্বস্ত কিংবা দুর্যোগাক্রান্ত এলাকাতেই করতে হয়। আবার এসব জায়গায় কাজ না করলে চাকরি ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ থাকে না। তাঁর স্বামীও নিজের কেরিয়ায় ছাড়তে নারাজ, তাই তিনি এবং তাঁর স্বামী চাকরিকেই বেছে নিয়েছেন, মাতৃত্বকে নয়। আবার আরেক সিনিয়র নারী সহকর্মীর স্বামী চাকরি করেন না, তিনি সন্তানদের দেখাশোনা করেন। স্ত্রীর যেখানে ট্রান্সফার হয়, তাঁর স্বামী সন্তান নিয়ে সেখানে চলে যায় বা কাছাকাছি কোথায় শিফট করেন। আমার আরেক নারী সহকর্মী এবং একজন পুরুষ সহকর্মী ভাবছেন সন্তান না নেবার কথা।
পরিচিত একজন বলেছিল, তার বন্ধু সন্তান না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ ডাক্তার বলে দিয়েছে তার যদি সন্তান হয়, সে-সন্তান প্রতিবন্ধী হবার সম্ভবনা বেশি। তিনি চান না, এই দুনিয়ায় একজন প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দিতে যেখানে তাকে প্রতি পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হবে।
ইচ্ছে করে কেউ সন্তান নিচ্ছেন না এটা হজম করা আমাদের সাধারণ বাঙালি জীবনে ভাবা বেশ দুষ্কর। শারীরিক সমস্যার জন্য যাদের সন্তান হয় না, তাদেরই সমাজের কটাক্ষ সয়ে চলতে হয়, আর কেউ ইচ্ছে করে সন্তান নিচ্ছে না জানালে জীবন তো ফানাফানা হয়ে যাবে। আমার যে সহকর্মী এবং তাঁর স্বামী কেয়ারকে বেছে নিয়েছিলেন, তিনি বলছিলেন, আমাদের সামগ্রিক ব্যবস্থা মেয়েদের কেরিয়ারের প্রতিকূল। মেয়েদের উৎসাহ দেয়া হয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য, কেরিয়ার গড়ে তোলার জন্য। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নারীদের প্রাধান্য দেয় চাকরিক্ষেত্রে নারীপুরুষের অসমতা দূর করবার জন্য। কিন্তু, একজন নারী যদি ‘মা’ হতে চান, তার জন্য যে ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ দরকার সেটি নেই বললেই চলে। কেউ কেউ বলে উঠতে পারেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি তো আছে। কিন্তু, একটি সন্তানকে জন্ম দেয়ার পর ঠিকমত বড় করতে ৩-৬ মাসের ছুটিই কি কেবল যথেষ্ট? পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা কি পর্যাপ্ত? বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানতো পিতৃত্বকালীন ছুটি কি জিনিস সেটিও জানে না। আমি এক এনজিও’র কথা জানি যারা মানবিক সহায়তা প্রদান করেন শরণার্থীদের, কিন্তু তার নারী কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেন না। কেউ যদি ছুটি নিতে চায়, হয় তাকে বিনা বেতনে নিতে হয়, না হয় চাকরি ছাড়তে হয়। শিশুদের জন্য ‘ডে কেয়ারের’ ব্যবস্থা আছে এমন প্রতিষ্ঠান হাতে গোনা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলাম, ‘ডে-কেয়ারে’র ব্যবস্থা রাখাটা কোন কোন ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। কিন্তু, সেটিও হাতে গোনা। তারপর শিশু যখন স্কুলে যেতে শুরু করে, স্কুল থেকে আনা-নেয়া করা একক পরিবারের বাবা-মায়ের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে। আমাদের সকলের পরিচিত অনেক নারী আছে যারা সন্তানের লেখাপড়ার জন্য নিজের কেয়ার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, এটি আমাদের সমাজে খুব চেনা বিষয়। কিন্তু, কেউ ভাবে না সেই সন্তানের মায়েরও নিজের কেয়িয়ার গড়তে ইচ্ছে করে। সবচেয়ে কৌতুকের বিষয় হল, যে কন্যা সন্তানের লেখাপড়ার জন্য মা তার কেয়িয়ার বিসর্জন দিচ্ছেন, সেই কন্যা সন্তানও দিনশেষে তার লেখাপড়াকে কাজে লাগান রান্না ঘরের পেছনে বা সন্তানকে অক্ষরজ্ঞান দেয়াতে। অক্ষরজ্ঞান এই জন্য বললাম, কারন বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানেরা প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে। তাহলে শেষপর্যন্ত কি দাঁড়ালো? নারীর লেখাপড়ার বাস্তবিক প্রয়োগ দুষ্কর হয়ে পড়ে, অথচ এর প্রয়োগ দেশ সমাজকে এগিয়েই দেবে।
আবার, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির দিকে যদি তাকাই, জনসংখ্যার বিপুলভারে নুয়ে পড়েছে পৃথিবী। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, আরেকদিকে আশংকাজনকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে খাদ্য এবং পানীয় জলের সংকটের দিকে। সবকিছু ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপি বিরাজ করছে মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ, মানুষ লিপ্ত একে অপরকে ধ্বংস করতে, যুদ্ধের পৈশাচিক উন্মাদনায় মানুষ অন্ধ। এই সব দেখে শুনে কিছু মানুষ এই ভয়ংকর পৃথিবীতে নতুন একটি মানব প্রাণের জন্ম দিতে চায় না। বাড়াতে চায় না পৃথিবীর জনসংখ্যা, তাই যারা মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের দায়িত্ব নিতে চায়, তারা সন্তান জন্ম না দিয়ে, দত্তক নিচ্ছেন।
এককথায় সহজ করে বললে, বর্তমান সময়ে, কিছু মানুষ কেবল বংশ বিস্তারে আগ্রহী নয়। তারা জীবনকে নিজের মতো করে যাপন করতে চায়। ‘মা’ হতে না পারলে নারীর জীবন ব্যর্থ বা ‘বাবা’ হওয়াই পুরুষত্বের প্রকাশ, এই বাক্সবন্দী ভাবনার বাইরে আসছে মানুষ। মানুষ হয়ে জন্মাছে বলেই সন্তানের জন্ম দিতে হবে, এই ভাবনার সাথে আন্যান্য প্রাণীর সন্তান জন্ম দেয়ার কোনও পার্থক্য নেই। মানুষ যদি নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশিত হবে তার কাজের মাধ্যমে। মানুষ তখনই ‘মাতৃত্ব’ বা ‘পিতৃত্ব’কে গ্রহণ করবে যখন সে নিজেকে প্রস্তুত মনে করবে এবং এর প্রয়োজনীয়তা বোধ করবে, সমাজের বা পরিবারের চাপে পড়ে নয় বা অন্যেরা দেখাদেখি নয়।
নোট: ২০১৭ সালের ভ্রমণগল্প

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেখ হাসিনার হাতেই দেশের মানুষ নিরাপদ
পরবর্তী নিবন্ধশিখরছোঁয়া অহংকার, শিখরছোঁয়া ওয়াসফিয়া