বাজারে নজরদারি বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ

| রবিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোজ্যতেল, চিনির ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলেও দাম কমছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পণ্য আমদানির বিপরীতে এলসি কমিশন ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতকিছুর পরও বাজার লাগামহীন। নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জীবনযাত্রার অন্যান্য সেবা, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয়ও। প্রায় সব খাতেই বাড়তি ব্যয় সামাল দেওয়ার মতো আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কমাতে হচ্ছে খাদ্য, বিনোদন ও অন্যান্য চাহিদা। করোনার সংক্রমণ কমার পর হঠাৎ করে চাহিদা বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের কারণে আন্তর্জাতিকসহ দেশীয় বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে বলে মানুষ দিশেহারা।
এদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সয়াবিন তেল, পাম তেল ও চিনি বিক্রিতে কোম্পানিগুলো যে মুনাফা করছে, তা আরেকটু কমানোর সুযোগ আছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। সংস্থাটি গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া এক অন্তরবর্তীকালীন প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। ৯ পণ্য অর্থাৎ চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, মসুর ডাল, এমএস রড ও সিমেন্টের দাম বেঁধে দেওয়া হবে বলে গত ৩০ আগস্ট সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে বিটিটিসি প্রতি মাসে এসব পণ্যের দাম নির্ধারণের কাজ করবে এবং ১৫ দিনের মধ্যে কাজটি শুরু হবে বলে ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। দুই সপ্তাহ শেষ হওয়ার পর বিটিটিসি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। তারা বলেছে, সয়াবিন, পাম তেল ও চিনির সরবরাহব্যবস্থায় (সাপ্লাই চেইন) মুনাফা কিছুটা সংকুচিত করার সুযোগ আছে। এ সুপারিশ করার আগে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে বিটিটিসি। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, বৃহস্পতিবার বাজারে এক লিটার সয়াবিন তেল ১৯০ থেকে ১৯৫, এক লিটার সুপার পাম তেল ১৪৫ থেকে ১৫০ আর এক কেজি চিনি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা দরে কেনাবেচা হয়েছে। অন্তরবর্তীকালীন প্রতিবেদনে চালের দাম বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারে কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে বিটিটিসি। বিটিটিসি বলেছে, এ ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব পালন করতে পারে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া মসুর ডাল, আটা ও ময়দার বিষয়ে সুপারিশ করতে ১৫ দিন সময় চেয়েছে বিটিটিসি। রড ও সিমেন্টের জন্য সংস্থাটি সময় চেয়েছে এক মাস। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে ১৯ সেপ্টেম্বর আবার বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বৈঠকে বিটিটিসি, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, টিসিবি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনকে (এফবিসিসিআই) থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি বা পণ্যমূল্য নিয়ে আমরা যত কথা বলছি, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা নিয়ে তত বলছি না। আমাদের বাজারের মনিটরিং শক্তিশালী নয়। কিন্তু মনিটরিং শক্তিশালী করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। মজুত আইন ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এক সময় চালের বড় আড়তদারদের হাতে অনেক ক্ষমতা ছিল। গত ছয় মাস চাল মজুত ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চালের বাজার আর ভোজ্যতেলের বাজার এক রকম নয়। ভোজ্যতেলের বাজার গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বলা হচ্ছে, সয়াবিন ও পাম অয়েলের সরবরাহ আছে। কিন্তু বাজারে নেই। সরবরাহ থাকলে বাজারে থাকবে না কেন। এ ক্ষেত্রে কারা সম্পৃক্ত, কোন পর্যায়ে গিয়ে পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না, সেগুলো বের করা দরকার। যারা সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ ব্যাহত করে বাজার অস্থিতিশীল করবে, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বর্তমানেও বাজারে মনিটরিং হচ্ছে, তবে তা হচ্ছে এডহক ভিত্তিতে। এটি এডহক ভিত্তিতে রাখা যাবে না। কৃষি, বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ও জরুরি। সঠিক তথ্য-উপাত্তও জরুরি। বাজার মনিটরিং বা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সংস্থা দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। একটি সংস্থা বা কমিশন করা যেতে পারে বা প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন তাঁর এক লেখায় বলেছেন, দেশে ভোজ্যতেল নিয়ে তেলেসমাতি দীর্ঘদিনের। গুটিকয়েক আমদানিকারক ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক। শুধু ভোজ্যতেল নয়, সব ধরনের ভোগ্যপণ্যসামগ্রী নিয়ে বেশকিছু তথাকথিত মৌসুমি ব্যবসায়ী দেশের বাজারব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। এসব গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে সাধারণ মানুষসহ সর্বস্তরের মানুষের জীবন ও জীবিকা অস্থির হয়ে উঠেছে। এই নীতি-নৈতিকতাহীন ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ভার অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। পুরো দেশের মানুষ নীতিহীন, সুবিধাবাদী, মজুতদার, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সীমিত আয়ের মানুষ, হতদরিদ্র, দিনমজুর, স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী, সৎভাবে জীবিকা নির্বাহকারী মানুষ অসাধু ব্যবসায়ীদের অনৈতিক ও হঠকারী ব্যবসাকাণ্ডের কারণে স্বাভাবিক সংসার চালাতে পারছে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’বেলা পুষ্টিকর খাবার তাদের কপালে জুটছে না। এ অবস্থায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে বাজারে নজরদারি বাড়ানোই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধচিলির স্বাধীনতা দিবস ও বিশ্বনৌ দিবস