‘বাংলা সাহিত্যের ঝরাপালক’

করবী চৌধুরী | শনিবার , ২২ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

ত্রিশ বছর বয়সে বাংলাসাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলেন ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সৃষ্টির ভরা যৌবন চলছিলো তখন কবি গুরুর। তারও চল্লিশ বছর পর যখন সাহিত্যের সব ডাল মাড়িয়ে একেবারে মগডালে বসে আছেন তিনি, তখন এক অখ্যাত কবি নিজের একখানা কবিতার বই হাতে গুটি গুটি পায়ে এলেন কবিগুরুর কাছে।
এই বই পড়ে কবিগুরুর অভিব্যক্তি কেমন ছিল!
কী সব লিখেছেন এই নতুন কবি? কিছু কি হলো কবিতার!

আসলে সে সময়ে সাহিত্যিকদের কাছে ‘আধুনিক কবিতা’ কনসেপ্টটাই ছিলো ম্যাক্সিম গোর্কির মায়ের প্রচারিত গোপন লিফলেটের মতো, যা অধিকাংশ বাঙালি কাব্য রসিকদের কাছেই ছিলো ঠাট্টা-তামাশার বিষয়। এমনকি নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় লেখকও হাস্যরসের প্রয়োজনে ‘সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস’ বলে প্যারোডি করে ছাত্রদের হাসাতেন। অথচ ‘আকাশলীনা’ কবিতাটি যে পরাবাস্তববাদের কতবড় গোলা, তা তৎকালীন পাঠকেরা না বুঝলেও আজকের পাঠকেরা খুব ভালোভাবেই বোঝেন।এখনকার পাঠকমাত্রই জানেন যে, ‘জীবনানন্দ দাশ’ মানেই সময়ের চেয়ে তিন প্রজন্ম এগিয়ে ছিলেন যে কবি। ত্রিশের দশক। কবি হিসেবে জীবনানন্দ দাশের তখন স্বল্প পরিচিতি। রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক কবিগোষ্ঠীর অন্যান্য কবিরা তখন সুপ্রতিষ্ঠিত।

‘পঞ্চপাণ্ডব’ খ্যাত কবিদের মধ্যে বয়সে সবার বড় হলেও পত্র-পত্রিকা থেকে তাঁর কবিতা ফেরত আসে। সংকলনের সূচিতে তাঁর স্থান হয়না। দৈনিক আহার বাবদ তিন থেকে ছয় পয়সা ব্যয়ে থাকেন কলকাতার এক মেসে। ব্যক্তিগত জীবন পৌঁছেছে তখন এক অসহনীয় পর্যায়ে! বিবাহিত হলেও দাম্পত্য জীবনে চরম অসুখী! চালচুলো-উপার্জনহীন সম্পূর্ণ বেকার এক কবি তিনি! নিরুপায় হয়ে কবিতার বিনিময়ে ১০০ টাকা চেয়ে সুহৃদদের কাছে চিঠি লিখেছেন। একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন!

ব্রাহ্ম হয়েও ব্রাহ্মদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। ব্রাহ্মদের নীতি-কঠোরতা, বিভিন্ন বিষয়ে ছুঁৎমার্গ একেবারেই পছন্দ করতেন না তিনি। কিন্তু ব্রাহ্মদের পছন্দ না করলেও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত, অপারগ কবি আবার তাদের সুবাদেই পাওয়া সিটি কলেজের চাকরিটা গ্রহণ করেছিলেন।

সরস্বতীপুজো উদযাপন নিয়ে সেবার ছাত্রদের সাথে কলেজ কর্তৃপক্ষের এক গন্ডগোল লাগে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যখন ছাত্রদের ধিক্কার দিয়ে এক প্রবন্ধ লেখেন, তখন অভিযোগ ওঠে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে। ছাত্রদের প্রতি তিনি নাকি সহানুভূতিশীল। আর এই অভিযোগ খণ্ডানোর কোন চেষ্টাও করেননি কবি। ফলশ্রুতিতে খোয়া যায় সিটি কলেজের চাকরিটাও। এবার উদ্যোগী হয়ে আত্মীয় পরিজনেরা চাকরি ঠিক করেন পাঞ্জাব আর শিলং-এ। চাকরি নিয়ে যে কোন এক জায়গায় চলে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেন তারা। কিন্তু বেকার জীবনে শত কষ্ট সত্ত্বেও তিনি কোলকাতা ছেড়ে কোথাও যাননি। পরবর্তীতে অবশ্য দিল্লির এক কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু অল্প কিছুদিন পরে সেখান থেকেও পালিয়ে বাড়ি চলে আসেন তিনি।

আসলে জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন ঘরকুনো মানুষ, যিনি প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতেই ভালোবাসতেন। পঞ্চাশের দশক। তখন কবি জীবনানন্দ দাশের সর্বসাকূল্যে বই বেরিয়েছে পাঁচটি। তার মধ্যে ‘ঝরা পালক’ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ ‘বনলতা সেন’ ‘মহাপৃথিবী’- এসবের কোন কপিই ছাপানো নেই। পাওয়া যায় শুধু ‘সাতটি তারার তিমির’। আপাতদৃষ্টিতে তিনি ঐ একখানা বইয়েরই কবি। কবির বন্ধু বুদ্ধদেব বসু তখন তরুণ কবিদের কবিতা ছাপাতেন। ষোল পৃষ্ঠার বই চার আনা দামে। একটা কবিতার দাম পড়তো এক পয়সা। সে সময়ে বুদ্ধদেব বসু তিন আনা দামে বের করলেন ‘বনলতা সেন’। ছিলো বারোটি কবিতা।

ছাপা- বাঁধাই কিছুই ভালো না হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই যথারীতি সেই বই অবলুপ্ত! টিকে থাকার এই সংগ্রাম যেন কোনমতেই পিছুই ছাড়তে রাজি নয় কবির!
পরবর্তীতে সংকটতারণ হয়ে এগিয়ে আসে সিগনেট প্রেস। মূলত জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে প্রকৃত মর্যাদা দেয় এই সিগনেট প্রেসই। প্রেসের কর্তধার দিলীপকুমার গুপ্ত সেই বই খুঁজে বের করে তার সঙ্গে আরো আঠারোটা কবিতা যুক্ত করলেন, একটা সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এই নবীন কবির কবিতাকে যে ‘চিত্ররূপময়’ বলেছিলেন সেই প্রশংসাবাণীটিও জুড়ে দেয়া হলো। সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদপট, অসাধারণ প্রোডাকশনে দীলিপকুমার গুপ্ত বের করলেন ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের নতুন সংস্করণ। বইমূল্য নির্ধারণ হলো দু’টাকা।

এবারে হলো বাজিমাৎ! যদিও অনেকেই প্রথম চিনলেন কবি জীবনানন্দ দাশকে, তারপরেও কাব্যাঙ্গনে দ্রুত থেকে দ্রুততর পরিচিতি ঘটতে লাগলো তাঁর। ১৩৫৯ সালের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই হিসেবে পুরস্কারও জিতে নেয় ‘বনলতা সেন’।

‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশের পর কবি জীবনানন্দ দাশের খ্যাতি অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু সেই খ্যাতি তিনি বেশিদিন উপভোগ করতে পারেন নি। কারণ এর ছয়মাস পরেই ঘটে গিয়েছিলো সেই প্রহেলিকাময় ট্রাম দুর্ঘটনা!

কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা কখনও বাস্তবচ্যুত নয়। মাঝে মাঝে বিমূর্ততার ছায়া এসে রহস্যের বাতাবরণ দিলেও পরক্ষণেই আবার ফিরে আসে চেতনার জগতে। অনুপ্রাস অর্থাৎ, একই পংক্তির বা শব্দের বারবার ব্যবহারের ফলে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন তন্ময়তা।

তাঁর কবিতায় নেই কোন আঁটসাঁট বাঁধন। জীবনের মতোই এঁকেবেঁকে বয়ে চলা অচেনা পথ, মাঝখানের গলি- ঘুপচির মতো ফাঁকগুলোতেও রয়ে গেছে অনেক ইশারা- ইঙ্গিত। তাঁর কবিতার মনোভঙ্গি সততই রোমান্টিকতায় উজ্জ্বল, প্রেম-সৌন্দর্য-প্রকৃতিতে নান্দনিক আর স্মৃতিভারাতুর। রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে জীবনানন্দের কবিতার আঙ্গিক অনেক দূরে, আর সেটাই পাঠকদের অদ্যাবধি মুগ্ধ করে রেখেছে।

কোন বিত্তবান পরিবারে কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম হয়নি, ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটিতে তাঁকে ডাকা হতো না। বিশ্বভ্রমণে বেরোনোর কোন সামর্থ্য ছিলো না। তবু্‌ও তাঁর রচনার ব্যাপ্তি মিশর, লিবিয়া ছেড়ে মহাকাশের অনন্ত নক্ষত্ররাজিতে, যা আজও সগৌরবে দেদীপ্যমান!

পরিশেষে এটাই বলা যায়, চলে যাবার ৬৮ বছর পরেও পাঠক মাত্রেরই দৃঢ় বিশ্বাস যে, কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা সময়- কাল এবং যুগচেতনায় পাঠকের হৃদয়ের গভীরে যে প্রোথিত হয়ে আছে আপন মহিমা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়, তার কোন ক্ষয় নেই বিনাশ নেই!

‘কোনোদিন জাগিবে না আর / জানিবার গাঢ় বেদনার, অবিরাম- অবিরাম ভার-/ সহিবে না আর’।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসৌদামিনীরা ভালো নেই
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে