হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২২ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

ব্রিটিশ রাজনীতিতে নাটকীয় মোড় : প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের পদত্যাগ

শেষ রক্ষা হলোনা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন টোরি পার্টি নেতা ৪৭ বছর বয়েসী লিজ ট্রাসের। যা অনুমান করা হয়েছিল তাই হলো শেষ তক। ক্ষমতা থেকে তাকে চলে যেতে হবে সে অনেকটা ধরে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এবং এমন অসম্মানজনক ভাবে, বোধকরি তা অনেকেই ভাবেনি। ভাবেননি খোদ লিজ ট্রাসও। কেননা গত ১৯ অক্টোবরও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিরোধী দলের পদত্যাগের দাবির মুখে তিনি বলেছিলেন, ‘আই এম এ ফাইটার, নট কুইটার।’ এই কথা বলে তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি যোদ্ধা, সহজে হার মানার নয়, লড়ে যাবেন। কিন্তু সেই লড়াইয়ে এমন পিছুটান দেবেন এবং তা এত সহসা তা বোধকরি রাজনীতি-বোদ্ধারাও ধারণা করেননি। কেবল বিরোধী দলের বিরোধিতা হলে এক কথা ছিল। তেমনটি হলে হয়তো কিছুটা সামাল দেয়া সম্ভব হতো, কিন্তু তার বিরোধিতা এবং পদত্যাগের দাবি খোদ নিজ দলের ভেতরও দিন দিন তীব্র ও জোরালো হচ্ছিল। পদত্যাগের আগ মুহূর্ত তক তার দলের ১০০ এমপি তার নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন। এর আগে দলের কয়েক এমপি প্রকাশ্যে ও টেলিভিশন-পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে লিজ ট্রাসের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। অথচ মাত্র মাস কয়েক আগে অনিয়ম, মিথ্যাচার ও আইন ভঙ্গের অভিযোগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পদত্যাগ করতে বাধ্য হলে, লিজ ট্রাস তার স্থলাভিষিক্ত হন। সে সময় তিনি নিজেকে দ্বিতীয় আয়রন লেডি মার্গারেট থেচারের সাথেও তুলনা করেছিলেন বলে জানা যায়। আসলে ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। বরিস জনসনের পদত্যাগের পর দলীয় প্রধান পদের জন্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অর্থমন্ত্রী ঋষি সুন্‌ক। তাকে হারিয়ে লিজ ট্রাস দলীয় প্রধান ও সে সূত্রে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার নতুন মন্ত্রিসভায় চমক আনলেন। মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ক্ষমতাশীল আসন, অর্থমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দিলেন আফ্রিকীয় বংশোদ্ভূত কোয়াশি কোয়ারতেনকে। সেখান থেকেই সমস্যার শুরু।

২. লিজ ট্রাসকে চলে যেতে হলো কেন? প্রথমত বরিস জনসনের পদত্যাগের পর তিনি নির্বাচনে জয়ী হলেও দলের আইন প্রণেতাদের একটি বৃহৎ অংশ তার নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেননি। তিনি দলকে এক করতে পারেননি। ক্ষমতায় বসার দিন কয়েকের মাথায় তড়িঘড়ি করে তিনি ও তার নতুন অর্থমন্ত্রী কোয়াশি কোয়ারতেন যে ‘মিনি বাজেট’ দিলেন তার তড়িৎ নেতিবাচক প্রভাব পড়লো ব্রিটেনের অর্থনৈতিক বাজারে। ঘোষিত সেই মিনি-বাজেটে ৪৫ বিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড ছাড় দেয়ার প্রস্তাব ছিল, যা ধারের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে বলে উল্লেখ ছিল। ট্রাসের মিনি-বাজেট পরিকল্পনা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে, যার ফলে পাউন্ডের মান ও সরকারি বন্ডের মূল্য হ্রাস পেতে থাকে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বাজারে নতুন প্রাণ সঞ্চারের লক্ষ্যে ৬৫ বিলিয়ন পাউন্ডের কর্মসূচি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। সাধারণ জনগণও তার এই বাজেটকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মাঝে তার এবং টোরি দলের জনপ্রিয়তায় ধস নামে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন দলীয় এমপিরা। কেননা তার (লিজ ট্রাস) ভুলের মাশুল তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় দিতে হতে পারে। দু-বছর বাদে ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচন। সমপ্রতি সাধারণ জনগণের মাঝে পরিচালিত এক জরিপে ২১১৩ ভোটারের মতামত চাওয়া হয়। দেখা যায়, সাধারণ নির্বাচন যদি আগামীকাল অনুষ্ঠিত হয় তবে তাদের মধ্যে অর্ধেক বিরোধী দল, লেবার পার্টিকে ভোট দেবেন। লেবার পার্টি প্রায় ৫০% আসন পেয়ে এগিয়ে থাকবে বলে এই জরিপে উল্লেখ করা হয়। রাজনৈতিক গবেষক ক্রিস হপ্‌িকন্সের মতে, ‘যদি নির্বাচন হয় তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীন টোরি পার্টি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে এবং লেবার পার্টি এমনভাবে জয়ী হবে যা টোরি পার্টিকে কয়েক জেনারেশনের জন্য ক্ষমতা থেকে বাইরে রাখবে।’

৩. বেচারা অর্থ মন্ত্রী কোয়াশি কোয়ারতেন। মন্ত্রী পরিষদে ক্ষমতার দিক থেকে তিনি দ্বিতীয়, প্রধানমন্ত্রীর পর। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটন। সেখানে গিয়েছিলেন গ্লোবাল ফাইন্যান্স মিনিস্টার্স মিটিংয়ে যোগ দিতে। দেশে যখন লিজ ট্রাসের সমর্থিত ও তার-প্রস্তাবিত মিনি বাজেট নিয়ে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা তুঙ্গে, তখন তাকে দেশে তলব করে পাঠান লিজ ট্রাস। ওয়াশিংটনের মিটিং শেষ না করেই তাকে ফিরে আসতে হয় ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে। তাকে জানানো হলো তার চাকরি নট। অথচ কথা ছিল কোয়ারতেন ৩১ অক্টোবর মধ্যবর্তী বাজেট পেশ করবেন। নিজ গদী বাঁচাতে লিজ ট্রাসকে মারতে হলো সহযোদ্ধা কোয়ারতেনকে। কোয়ারতেন মন্ত্রিত্ব হারালেন। লিজ ট্রাস নতুন অর্থমন্ত্রী নিয়োগ দিলেন জেরেমি হান্টকে। মজার ব্যাপার হলো, দলীয় প্রধান লড়াইয়ে জেরেমি হান্ট লিজ ট্রাসের বিপক্ষে গিয়ে ঋষিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। রাজনীতি বলে কথা, সেখানে শেষ-কথা বলে যেমন কোন কথা নেই, ঠিক তেমনি চির শত্রু বা চিরকালের মিত্র বলে কোন কথা নেই। রাজনীতিতে আজকের বন্ধু যেমন আগামী দিনের শত্রু হতে পারে, তেমনি আজকের শত্রু আগামী দিনের বন্ধু হতে দেখা যায়। নতুন অর্থ মন্ত্রী ১৪ অক্টোবর নিয়োগ পাবার সাথে সাথে লিজ ট্রাসের মিনি-বাজেট থেকে ‘ইউ-টার্ন’ নেন। তিন সপ্তাহ আগে লিজ ট্রাসের মিনি-বাজেট প্রায় সম্পূর্ণ বাতিল করে তিনি (জেরেমি হান্ট) জানান, ন্যূনতম আয়কর ২০ শতাংশেই থাকবে (ট্রাস ১৯ শতাংশে কমিয়েছিলেন)। উল্লেখ্য, লিজ ট্রাস এমন এক সময় ক্ষমতায় এলেন যখন তাকে ইউরোপ সহ ইংল্যান্ডে বিদ্যুৎ সমস্যা, উর্ধ্বগতি বিদ্যুৎ বিল, উর্ধ্বগতি দ্রব্যমূল্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। লিজ ট্রাস তার মিনি বাজেটে আগামী দুই বছরের জন্য বিদ্যুৎ বিলের উর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। জেরেমি হান্ট সেই অবস্থান থেকে সরে এসে জানালেন, ‘এই নিয়ম আগামী এপ্রিল পর্যন্ত চালু থাকবে। তবে এর পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ বিদেশি পর্যটকদের জন্য ‘ভ্যাট’-ছাড়ের যে প্রস্তাব লিজ দিয়েছিলেন সেখান থেকে সরে এসে নতুন অর্থমন্ত্রী তা বাতিল করে দেন। ফলে আগে যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের কেনাকাটার পর ভ্যাট-ছাড়ের জন্য আবেদন করতে হতো, এখন তাই করবে হবে। তিনি এই বলে সবাইকে আস্বস্ত করতে চাইলেন যে, নতুন বাজেট অর্থনৈতিক বাজারে হাবুডুবু খাওয়া ব্রিটেনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হবে।

৪. মোটকথা, লিজ ট্রাস তার আগের দেয়া ‘মিনি-বাজেট’ থেকে ‘ইউ’ টার্ন নিতে বাধ্য হলেন। সেখানেই প্রশ্ন এবং সেই-প্রশ্ন গড়াতে গড়াতে তার পদত্যাগে এসে থামলো। যে বাজেটের স্বপ্ন দেখিয়ে লিজ ট্রাস ক্ষমতায় বসেছিলেন, সেই বাজেট তিনি সপ্তাহ কয়েকের মাথায় বাদ দিলেন। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার (লিজ) বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকে কোথায়? ক্ষমতায় থাকার তার কোন যৌক্তিকতা থাকে না- এমনটাই দাবি ছিল বিরোধী লেবার পার্টি, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস ও গ্রীন পার্টির। দু-দিন আগে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেইনবো মারি স্থানীয় এক পত্রিকায় লেখেন, ‘জনগণ তাকে আর সম্মান করেন না, তারা তাকে বিশ্বাস করেন না এবং বর্তমানে সরকার চলছে মূলতঃ একজন অর্থমন্ত্রীর দ্বারা যার অবস্থান প্রধানমন্ত্রীর নীতিমালার বিরুদ্ধে।’ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যা হয়। হয় ভুল স্বীকার করে জনগণের কাছে ক্ষমা চাও, নয়তো বা ক্ষমতা ছাড়ো। গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেন বলে কথা। এতো আর এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ নয় যে, একটি নয়, দুটি নয়, শত ভুল করেও গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকা যাবে। লিজ ট্রাস বিবিসি-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, তড়িঘড়ি করে মিনি-বাজেট দেয়া ছিল ভুল এবং এই ভুলের জন্যে অর্থনৈতিক-বাজারে যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে এবং বিনিয়োগকারীদের যে আস্থা নষ্ট হয়েছে তার জন্য তিনি ক্ষমা চাইলেন। বললেন, ‘আমি সমস্ত দায় স্বীকার করে যে ভুল হয়েছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। উচ্চ কর হারের সমস্যা মোকাবেলার পাশাপাশি জ্বালানির মূল্য হ্রাস করে জনগণকে সাহায্য করতে চেয়েছি, কিন্তু সে বড্ড তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। তবে আমি পদ ছাড়ছি না।’ কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! তাকে পদ ছাড়তে হলো। ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার অনুসৃত নীতিমালা যখন আমি অনুসরণ করতে পারছি না, তখন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোই উত্তম।’

লিজ ট্রাসের পদত্যাগের পর ব্রিটিশ রাজনীতি এখন প্রতি মুহূর্তে নাটকীয় মোড় নিচ্ছে। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি সামনের দিকে- কে হতে যাচ্ছেন টোরি পার্টির পরবর্তী নেতা ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী? মন্ত্রী সভার দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি, অর্থমন্ত্রী (চ্যান্সেলর) জেরেমি হান্ট ইতিমধ্যে জানিয়েছেন তিনি প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। তাহলে কে? ভোটে লিজ ট্রাসের কাছে দলীয় প্রধান আসনের লড়াইয়ে হেরে যাওয়া ঋষি সুন্‌ক? দলের মধ্যে তার বেশ সমর্থন থাকলেও তাকে ঘিরে কিছু বিতর্কও রয়েছে। কেননা বরিস জনসন যখন দলের মধ্যে তীব্র বিরোধিতার মুখে তখন ঋষি সুনক প্রথম মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন, যা বরিস জনসনের পদত্যাগকে ত্বরান্বিত করে বলে দলের অনেকের ধারণা। এদিকে শোনা যাচ্ছে বরিস জনসন হয়তো আবার মঞ্চে ফিরে আসতে পারেন। ইতিমধ্যে দলের কোন কোন নেতা তার নাম উল্লেখ করে বলেন, তিনি (বরিস) জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং একমাত্র তিনিই দলকে এক রাখতে সক্ষম হবেন। এই দুজন ছাড়াও আরো যে কটি সম্ভাব্য নাম সামনে আসছে তা হলো, লিজ ট্রাস ক্যাবিনেটে হোম মিনিস্টার সুয়েলেন ব্রাভারম্যান। ইতিমধ্যে টোরি পার্টি নতুন দলীয় প্রধান খুঁজে পেতে জোরেশোরে কাজ করে চলেছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী সপ্তাহের শুক্রবারের মধ্যে নতুন নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে। দেখা যাক কে হয় ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী। তদ্দিন আমাদের অপেক্ষার পালা।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘বাংলা সাহিত্যের ঝরাপালক’
পরবর্তী নিবন্ধদুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ‘বঙ্গবন্ধু মডেল’ বিশ্বস্বীকৃত