বাংলা-বাঙালি এবং বাংলাদেশ

মযহারুল ইসলাম বাবলা | রবিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের এক বৈচিত্র্যময় দেশ ভারতবর্ষ। বহুভাষা, সংস্কৃতি ছড়িয়ে আছে উপমহাদেশটি জুড়ে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সকল বিষয়াদির ক্ষুদ্র সংরক্ষণ হলেও ভারতবর্ষে রয়েছে। ভারতবর্ষকে তাই মিনি ওয়ার্ল্ডও বলা হয়। মানুষের খাদ্য, আহার, পোশাক, রুচি অঞ্চলভেদে সম্পূর্ণ ভিন্ন; যেটা বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায় না। ভাষা-সংস্কৃতির ভিন্নতার ন্যায় বিশাল ভারতবর্ষের অঞ্চলসমূহের আবহাওয়া বা প্রাকৃতিক পরিবেশও ভিন্নতর। কোথাও তীব্র শীত, কোথাও গরম, কোথাও সহনীয়, কোথাও সব ঋতুতে সামান্য হেরফেরে একই রকম আবহাওয়া। সুউচ্চ পাহাড়, সমুদ্র, নদী-নালা, হ্রদ, বন-জঙ্গল, মালভূমি, মরুভূমি, সমতল-অসমতল ভারতবর্ষের সর্বত্রেই বৈচিত্র্যে ঠাসা। সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোও অঞ্চলভেদে ভিন্নতর। কোন অঞ্চলের সঙ্গে অপর অঞ্চলের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতবর্ষের অংশ আমাদের দেশও। ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের পূর্বপর্যন্ত ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার এক রাষ্ট্রাধীনে আমরাও ছিলাম। অর্থাৎ এখনকার ভারত, পাকিস্তান পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হয় ১৯৪৭-এ। পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ১৯৭১-এ। এরপূর্বে দীর্ঘ ১৯০ বছর ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে একই রাষ্ট্রাধীনে ছিল গোটা ভারতবর্ষ। ব্রিটিশদের পূর্বে সুলতানী, মোগল আমলে ভারতবর্ষকে এক রাষ্ট্রাধীনে পরিণত করা সম্ভব হয় নি। একমাত্র ব্রিটিশরাই ভারতবর্ষকে এক রাষ্ট্রাধীনে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল।
সুলতানশাহী, মোগল সম্রাটগণ দিল্লিকেন্দ্রীক ছিলেন। ভারতবর্ষের অসংখ্য অঞ্চল বা রাজ্যগুলো তাদের প্রত্যক্ষ শাসনের আওতায় ছিল না। স্থানীয় শাসকেরাই অঞ্চল কিংবা রাজ্যসমূহের শাসনকর্তা ছিলেন। তবে দিল্লির শাসকদের বশ্যতা স্বীকার করে। বাৎসরিক ধার্যকৃত কর প্রদানের ভিত্তিতে। কোনো স্থানীয় শাসক দিল্লির বশ্যতা অস্বীকার করলে দিল্লির শাসকদের সামরিক হস্তক্ষেপের কবলে পড়তে হতো। স্থানীয় শাসকদের সামরিক শক্তির স্বল্পতায় তাদের পক্ষে দিল্লির সম্রাটদের বিশাল সামরিক শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না। পরাজিত হলে যুদ্ধক্ষতিসহ শর্ত পূরণে রাজ্যের শাসনভার ফিরে পেত। অনেক স্থানীয় শাসক পরাজয় নিশ্চিত জেনে পালিয়ে যেত। বাৎসরিক করধার্য করে নতুন শাসক নিয়োগ করতো দিল্লির শাসকেরা। প্রতিটি রাজ্যে দিল্লির শাসকদের প্রতিনিধি থাকারও বিধান ছিল। অসংখ্য রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায়শ বিদ্রোহ ও যুদ্ধের ঘটনা ঘটতো। সুলতানী আমলে সুলতান-শাহীরা যথেষ্ট সংগঠিত ছিল না। অপর দিকে মোগল শাসনাধীন ভারতবর্ষকে তারা কয়েক শত বছর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল। এর মধ্যেও অসংখ্য বিদ্রোহের ঘটনাও ঘটেছে। যেগুলো মোগলরা কঠোর হস্তে দমন করেছে। মোগল শাসনের শেষভাগে ক্ষয়িষ্ণু মোগল সাম্রাজ্যের পক্ষে অতীতের ন্যায় রাজ্যসমূহের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয়নি। যার মোক্ষম সুযোগটি হাতিয়ে ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রহসন যুদ্ধে জয়ী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসন ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে। বণিকের ছদ্মবেশে আগত ইংরেজ শাসকেরা পর্যায়ক্রমে ছলে বলে কৌশলে পুরো ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করে। অবিভক্ত বঙ্গের শাসনক্ষমতা ইংরেজদের করতলগত হবার পরও মুর্শিদাবাদের ক্ষমতাহীন নামসর্বস্ব নবাবদের ইংরেজরা মাসোহারা দিয়ে বহাল রেখেছিল। মীর জাফর যেমন নবাবী পেতে ইংরেজদের অঢেল অর্থ প্রদান করেছিল। পরবর্তীতে তার-ই জামাতা মীর কাশেম অঢেল অর্থ এবং চট্টগ্রাম জেলাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুকূলে হস্তান্তরের বিনিময়ে নবাবী ক্রয় করেছিলেন। মীর কাশেমের স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। বক্সার যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মীর কাশেম অদৃশ্য হয়ে যায়। পুনরায় নবাব হন মীর জাফর আলী খান। মীর জাফরের বংশধরেরা পর্যায়ক্রমে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের কাগুজে নবাব রূপে রাষ্ট্রের আর্থিক আনুকূল্য পেয়ে এসেছিল, ব্রিটিশদের থেকে যেমন তেমনি স্বাধীন ভারত সরকার থেকেও। ১৯৬৮ সালে ভারত সরকার মুর্শিদাবাদের নবাবীত্ব বাতিল করে এবং আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দেয়। মীর জাফরের বংশধরদের দীর্ঘ মেয়াদে মুর্শিদাবাদের নবাবী লাভে একে অপরের বিরুদ্ধে শঠতা, ষড়যন্ত্র, দেন-দরবার সহ নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হবার কাহিনীও কম ছিল না।
ইংরেজ শাসনাধীনে বঙ্গের রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে স্থানান্তরিত হয়। সূতানটি, গোবিন্দগঞ্জ এবং কলকাতা নামক তিনটি গ্রামকে একত্রিত করে ইংরেজরা কলকাতা শহর গড়ে তোলে, অনেকটা লন্ডনের আদলে। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার শাসনামলে কলকাতায় প্রথম স্থাপনা গড়েছিল ছদ্মবেশী বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফোর্ড উইলিয়ম দুর্গ নামক ওই স্থাপনাকে কেন্দ্র করে নবাব সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। নবাব সিরাজের ফোর্ড উইলিয়ম দুর্গ আক্রমণের পরই ঘটে ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের সূচনা। পরিণতিতে নবাবের সভাসদদের নিয়ে ইংরেজরা গভীর চক্রান্ত আঁটে। যার শেষ পরিণতি ঘটে পলাশীর প্রহসন যুদ্ধে।
বঙ্গের রাজধানীর মর্যাদা হারিয়ে মুর্শিদাবাদ ক্রমে ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। অথচ মুর্শিদাবাদের চাকচিক্য ইংরেজদের হতবাক করে দিয়েছিল। মুর্শিদাবাদের জৌলুস দেখে তারা বঙ্গ দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে। বঙ্গ দখলের পর একে একে সারা ভারতবর্ষ ইংরেজ শাসনাধীনে চলে আসে। গোটা ভারতবর্ষকে তারা পর্যায়ক্রমে এক রাষ্ট্রাধীনে অন্তর্ভুক্ত করে। ঔপনিবেশিক শাসকদের রাজধানী হয় কলকাতা। কলকাতাকে কেন্দ্র করে ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, লুণ্ঠনে পারঙ্গম ইংরেজরা ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
১৭৫৭ সালের পর হতে ১৯১২ সাল নাগাদ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী ছিল কলকাতা। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা বঙ্গদেশে হবার সুযোগে বাঙালিরা ভারতের অপরাপর জাতির তুলনায় নিজেদের অগ্রসর জাতি হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ লাভ করে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি হতে সকল ক্ষেত্রেই অগ্রসর হয়ে ওঠে বাঙালিরা। বাঙালি জাতির এই অগ্রসর হয়ে ওঠাকে ব্রিটিশরা সুনজরে দেখেনি বলেই ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গ বিভাজনের উদ্যোগটি গ্রহণ করেছিলেন। Richard M. Eaton-Gi The rise of Islam and the Bengal Frontier গ্রন্থে জানা যায়, ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব এইচ এইচ রিযলী ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও ডিসেম্বর মাসে পৃথক দু’টি নোটে লিখেছিলেন, “Bengal United is a Power. Bengal divided will Pull in Several different ways. That is perfectly true and is one of the merits of the Scheme.” পরে আরো চূড়ান্ত ভাবে…one of our main bojects is to split up and thereby weaken a Solid body of opponents to owr rule.
বাংলা বা বাঙালিকে খণ্ডিত করার অভিপ্রায়ে ভাইসরয় কার্জন পূর্ববাংলা চষে বেরিয়েছেন। স্থানীয়দের ইন্ধন জুগিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিপত্য মুক্ত হবার সুযোগ গ্রহণে বঙ্গভঙ্গের স্বীকৃতি প্রদানে। পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের উপকার করার প্রচারের নেপথ্যে কার্জনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করা। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে ফেরার পথে ট্রেনে বসেই কার্জন ভারত সচিবকে চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতেই কার্জনের অভিপ্রায়টি নগ্নভাবে প্রকাশ পায়। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ সালে কার্জনের লেখা সেই চিঠিটি ছিল এরূপ, “বাঙালিরা নিজেদেরকে যারা একটি জাতি বলে ভাবতে পছন্দ করে এবং যারা এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যখন ইংরেজদেরকে বিদায় করে দিয়ে কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউজে একজন বাঙালি বাবুকে অধিষ্ঠিত করবে, তারা অবশ্যই তাদের ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নে হস্তক্ষেপ ঘটাতে পারে এমন যে কোনো প্রতিবন্ধকের ব্যাপারে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করবে। আমরা যদি তাদের হৈ চৈ-এর কাছে নতি স্বীকার করার মতো দুর্বলতা প্রকাশ করি, তাহলে আগামীতে বাংলাকে কখনোই খণ্ডিত বা দুর্বল করতে পারবো না, এবং ভারতের পূর্ব পার্শ্বে আপনি এমন একটি শক্তিকে সংযুক্ত ও দৃঢ় করবেন যেটি ইতিমধ্যেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতে তা ক্রমবর্ধমান গোলযোগের নিশ্চিত উৎস হয়ে দাঁড়াবে।” [অনূদিত]
১৯২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর কোকনদে কংগ্রেস অধিবেশনে প্রতিপক্ষদের প্রবল বিরোধিতার পরও বেঙ্গল প্যাক্ট গৃহীত হয়। বিরোধীরা সমবেত ভাবে চিৎকার করে বলে, ্তুউবষবষব ঃযব ইবহমধষ চধপঃ্থ, চিত্তরঞ্জন দাশ দাঁড়িয়ে বিরোধীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “Ton Can delele the Bangal Pact from the resolution, but you cannot delete Bengal from the history of the Indian National Congress. Bengal demands her ritht of having her Suggestion considered by the National Assembly… I cannot understand the argument of those ‘Delete Bangal Pact’ It  you do, Bangal can take Care of itself, you cannot refuse Bengal to make a Suggestion.” অনুপা ঘোষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, পৃ ৩২৫, ৩২৬]
চিত্তরঞ্জন দাশ যতটা ছিলেন ভারতীয় তার চেয়ে অধিক ছিলেন বাঙালি। হিন্দু-মুসলমানের দৃঢ় ঐক্যে তিনি আস্থা রাখতেন। ওই ঐক্য ব্যতীত ইংরেজদের বিতাড়ন সম্ভব হবে না। এই সত্যটি তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। বাংলার প্রকৃত সমস্যা কোথায়! সেটা তিনি যেমন অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ঠিক তেমনি সমাধানের পথটিও চিহ্নিত করে সে পথেই এগুচ্ছিলেন। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার বৈষম্যের মূলেই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। সেটা দূর করা না গেলে ঐক্য প্রয়াস সফল হবে না। সে চিন্তা থেকেই তিনি বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তিটি অধিবেশনে পেশ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ করিয়েছিলেন
বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপ :
সিদ্ধান্ত করা যাইতেছে যে, বাংলাদেশে যাহাতে স্বায়ত্তশাসনের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে সেজন্য প্রদেশের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে একটি চুক্তি অত্যাবশ্যক; যখন স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে তখন এই চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ অধিকার পাইবে। লোকসংখ্যার অনুপাতে ও স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথায় বাংলাদেশ ব্যবস্থাপক পরিষদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হইবে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রত্যেক জিলার সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় শতকরা ৬০টি আসন পাইবে এবং সংখ্যলঘু সম্প্রদায় শতকরা ৪০টি আসন পাইবে। সরকারি দফতরে মুসলমানদের জন্য শতকরা ৫৫টি চাকুরি সংরক্ষিত থাকিবে এবং যে পর্যন্ত তাহারা এই সংরক্ষিত পর্যায়ে না পৌঁছে সে পর্যন্ত তাহাদের মধ্য হইতে শতকরা ৮০ জনকে সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ করা হইবে। যে পর্যন্ত চাকুরি ক্ষেত্রে মুসলমানদের হার উপরোক্ত পর্যায়ে না আসে সে পর্যন্ত তাহাদেরকে ন্যূনতম যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হইবে, ইহার পর মুসলমানগণ চাকুরির শতকরা ৫৫টি ও অমুসলিম শতকরা ৪৫টি পাইবে, মধ্যবর্তীকালে হিন্দুগণ শতকরা ২০টি চাকুরি পাইবে। কোন সম্প্রদায়ের ধর্ম সম্পর্কীয় কোন আইন ব্যবস্থাপক পরিষদে পাশ করিতে হইলে যে সম্প্রদায়ের আইন সভায় নির্বাচিত তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থন থাকিতে হইবে। মসজিদের সম্মুখে গান-বাজনা সহকারে মিছিল করা হইবে না। এবং গরু জবাই করার ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা হইবে না। [মুহম্মদ আবদুর রহিম, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃ ২২]
পিছিয়ে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়কে হিন্দু সম্প্রদায়ের সমকক্ষে পরিণত করার অভিপ্রায়ে চিত্তরঞ্জন কতটা উদার-অসাম্প্রদায়িক এবং বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল ছিলেন। বাংলা প্রদেশকে অখণ্ডিত রাখার অভিপ্রায়ে চিত্তরঞ্জনের ভূমিকা অসামান্য কেবল নয় বাংলার রাজনীতিকদের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কিন্তু বাংলা ও বাঙালির দুর্ভাগ্য তাঁর অকাল মৃত্যুতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথটি উন্মোচিত হয়ে যায়। আর রাজনৈতিক খেলোয়াড়েরা সেটা গ্রহণ করে বাঙালি জাতিকে ধর্মের বিভাজনে পৃথক করে অখণ্ড বাংলাকে চূড়ান্তে খণ্ডিত করতেও ছাড়েনি।
চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনৈতিক জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। মাত্র আট বছরের। একমাত্র তাঁর অকাল মৃত্যুই বাঙালি জাতির জীবনে সংকটের সূত্রপাত ঘটে। ভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালিদের সকল সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিয়েছিল। তাঁর মত করে বাংলা ও বাংলার জন্য নিবেদিত অন্যকোন নেতার পক্ষে অমন ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। নিজ প্রদেশের প্রধান সমস্যাটিকে চিহ্নিত করে সেই সমস্যা নিরসনে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু তাঁর অকাল প্রয়াণেই সকল প্রচেষ্টা ভেস্তে গিয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে চিত্তরঞ্জনের প্রখর দূরদর্শিতায় বাংলার মূল সমস্যা শনাক্তে ন্যূনতম ভুল ছিল না। তাঁর অবর্তমানে অখণ্ড বাংলাকে খণ্ডিত করা হয়েছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজনে। যেটা জীবদ্দশায় তিনি বুঝতে পেরেই হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের জন্য বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তিটির উত্থাপন করে দুই সম্প্রদায়ের দূরত্ব নিরসনে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বেঙ্গল প্যাক্টেরও মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। কংগ্রেসই বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল করে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির সকল সম্ভবনা বিলীন হয়ে যায়। পরিণতিতে দুই ভ্রাতৃপ্রতীম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘটে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা এবং মর্মান্তিক দেশভাগ। অখণ্ড বাংলাকে আর কেউ রক্ষা করতে পারলো না।
কংগ্রেস নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ যথার্থই বলেছেন, “ভারত বিভাজনের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলার হিন্দু-মুসলমানের নেতৃত্বের ভেতর সমতার ভিত্তিতে যে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ প্রণয়ন করেছিলেন, কংগ্রেস নেতৃত্ব দ্বারা সেটা নাচক হয়ে গেল তখন থেকেই।” চিন্তরঞ্জন দাশ সম্পর্কে মওলানা আজাদ লিখেছেন যে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস চিত্তরঞ্জনের অকাল মৃত্যু না ঘটলে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি নতুন আবহাওয়া তৈরি হতো। [গড়ঁষধহধ অনঁষ কধষধস অুধফ, ওহফরধ ডরহং ঋৎববফড়স, ঢ়. ৫]
কংগ্রেস নেত্রী ঢাকার বিক্রমপুরের সরোজিনী নাইডু জিন্নাহর ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য তাঁকে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের দূত বলেছিলেন। ১৯২৫ সালে সরোজিনী নাইডু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই বছরই চিত্তরঞ্জন দাশ মারা যান। সরোজিনী নাইডুর জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে কলকাতায় কংগ্রেস কর্মীদের বৈঠকে এক বাঙালি তরুণ কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে বাঙালির বেশ অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করলে, জবাবে সরোজিনী নাইডু টেবিলে চাপড়ে রাগতস্বরে তীরস্কারের ভাষায় বলেন, “ওহে যুবক, বাংলার কথা ভুলে ইন্ডিয়ার কথা ভাবো, কারণ বাংলা পৃথক নয়, ইন্ডিয়ার অংশ বিশেষ বটে।” [বিক্রমপুরের কন্যা সরোজিনী নাইডু, পৃ ৭৭]
১৯৩৭ সালে উত্তর প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠনে মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের সাথে যুক্ত না করার জন্য মওলানা আজাদ নেহেরুকেই দায়ী করেন। তাঁর ধারণা ছিল প্রদেশে অত্যন্ত দুর্বল মুসলিম লীগ নিজেদের অস্তিত্ব রাখতে না পেরে শেষে কংগ্রেসে যোগ দিতে বাধ্য হতো, বাংলায় ওই নির্বাচনে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনে আপত্তির জন্য তিনজন কংগ্রেস নেতাকে দায়ী করা হয়। মওলানা আজাদ, রাজনীতিক-ব্যবসায়ী নলিনী সরকার এবং শিল্পপতি ঘনশ্যাম দাস বিড়লাকে। বাংলা কংগ্রেসের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা শরৎ বসু এবং সুভাষ বসু উভয়েই আগ্রহী ছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাবের। কংগ্রেসের আপত্তির কারণেই ফজলুল হক তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ নীতি পরিহার করে বাংলায় মুসলিম লীগের সঙ্গে যৌথ মন্ত্রিসভা গঠন করে বাংলায় মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। সেখান থেকেই বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ রোপিত হয়। ফজলুল হক পরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হন। এবং জিন্নাহর নির্দেশে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠনে বাংলার রাজনীতির হাত বদল হয়ে যায়। বাংলার নিজস্ব রাজনীতির স্থায়ী পতন ঘটে।
বাংলা ভাগ ঠেকাতে অনেকেই ভূমিকা রেখেছিলেন। আবার অনেকে সেই অবস্থান থেকে সরে গিয়ে বাংলা ভাগের পক্ষে গিয়ে চরম বিশ্বাসঘাতকতারও প্রমাণ দিয়েছেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক মনেপ্রাণে ছিলেন নির্ভেজাল বাঙালি এবং অসাম্প্রদায়িকও। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির মোহে পড়ে তিনি বাংলা ভাগ রুখতে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারেননি। ১৯৩৭ সালে বাংলায় যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনে কংগ্রেসের কাছে প্রস্তাব দিলে কংগ্রেস সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তিনি মুসলিম লীগকে প্রস্তাব দেন, যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনের। মুসলিম লীগ ওই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করে। বাংলায় মুসলিম লীগের কোন ভিত্তিই ছিল না। যৌথ মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে মুসলিম লীগ বাংলার রাজনীতিতে নিজেদের ভিত্তিপ্রস্তুত করতে সমর্থ হয়। বাংলা ভাগে মুসলিম লীগের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। অর্থাৎ হক সাহেবের হাত ধরেই বাংলায় মুসলিম লীগের আগমন ঘটেছিল।
বাংলা প্রদেশের মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম বাংলা বিভাজনের প্রবল বিরোধী ছিলেন। অপরদিকে মুসলিম লীগের রাজনীতির যুক্ততায় সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বেরও পক্ষে ছিলেন। পরস্পর বিরোধী দুই মেরুতে অবস্থানের পরও তিনি বাংলা ভাগ রুখতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পক্ষে শরৎ বসুর ন্যায় ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি, মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে।
দেশভাগের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পি সি যোশী এবং বাংলা প্রদেশের সম্পাদক ভবানী সেনের বিবৃতিটি তাৎপর্যপূর্ণ, লন্ডনে ভারত বিভাগের ষড়যন্ত্র চলিতেছে। এই পরিকল্পনা যদি কার্যকরী হয় তাহলে ভারতের সকল সম্প্রদায় ও সমগ্র জনসাধারণের ভাগ্যে এক মহা-বিপর্যয় ঘটবে। বাংলাকে অখণ্ড রাখার প্রচেষ্টাকে কমিউনিস্ট পার্টি অভিনন্দন জানিয়েছিল।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাগের বিরোধিতাকারীদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। তিনি কলকাতায় বসবাস করলেও বাংলাভাষী ছিলেন না। মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের প্রস্তাব নিয়ে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্বে কলকাতায় বাংলাভাগের বিরোধীরা সম্মিলিত ভাবে সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়-মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাব তারা সম্মিলিত ভাবে বিরোধিতা করবে। সভাটি হয় সোহরাওয়ার্দীর বাস-ভবনে। অধিবেশনের পূর্বেই সোহরাওয়ার্দী দিল্লি যান এবং জিন্নাহর নির্দেশে মাউন্টব্যাটনের ঘৃণ্য প্রস্তাবের পক্ষে অপরাপর প্রতিনিধিদের রাজি করিয়ে বাংলা ভাগে চরম বিশ্বাসঘাতকতার নজির স্থাপন করেন। জিন্নাহর পেশকৃত প্রস্তাবটিতে অধিবেশনে সর্বাধিক ভোট যায় বাংলাভাগের পক্ষে। সোহরাওয়ার্দীই হাত উঁচিয়ে ভোট গণনা করে জিন্নাহকে বিজয়ীবেশে বলেন, ‘কায়দে আজম, আমাদের বিপক্ষে মাত্র ১১টি ভোট পড়েছে’। অথচ বাংলাকে অখণ্ড রাখতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তাঁদেরই একজন। সোহরাওয়ার্দীর ঘৃণ্য ভূমিকায় আবুল হাশিম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, ‘খবরটা শুনে মনের পর্দায় পলাশীর ট্র্যাজেডির ছবিটি ভেসে উঠলো।’
শিবশঙ্কর রায়ও বাংলা ভাগের বিরোধিতায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তিনিও শরৎ বসু ন্যায় অবিচল থাকতে পারেননি। কংগ্রেসে থেকেও কংগ্রেসের বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে তিনি নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু শেষ পরিণতিতে তিনি বিধানচন্দ্র রায়ের বিভক্ত পশ্চিম বাংলার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রিত্ব লাভের পর দু’টি ঘৃণিত কাজ করেছিলেন। এক. কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ। দুই. সীমান্ত অঞ্চল থেকে নিরাপত্তার অজুহাতে মুসলিমদের তাদের আবাস থেকে উচ্ছেদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ক্ষমতার দাপটে তাঁর নানাবিধ কার্যকলাপ শাসক প্রতিনিধি ভিন্ন অন্য কিছু ছিল না।
বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে পুরোধা ব্যক্তিটি ছিলেন নেতাজী সুভাষ বসুর অগ্রজ শরৎ বসু। তাঁর ন্যায় অনন্য ভূমিকা পালন আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি সাম্প্রদায়িকতার সমাধান দেশভাগে বিশ্বাস করতেন না। ভাষার ভিত্তিতে বিভাজিত প্রদেশগুলোকে সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রে পরিণত করার মধ্যেই সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন। শরৎ বসুকে ব্রিটিশ শাসকেরা পছন্দ ও বিশ্বাস কোনোটিই করতো না, অনুজ সুভাষ বসুর কারণে। সেজন্য তাঁকে বারবার কারারুদ্ধ করা হতো। কারাবাসের কারণে তাঁর চলমান কাজ বারবার ক্ষতির সম্মুখীন হতো। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের পক্ষে সর্বোপরি বাংলা-ভাগ রোধে তাঁর ভূমিকা অপরদের সঙ্গে তুলনা চলে না। বাংলাকে অখণ্ডিত রাখার ক্ষেত্রে শরৎ বসুর ভূমিকা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
বাংলার কর্তৃত্ব ক্ষমতা চলে গেল বিভাজিত বাংলার পূর্বাংশ পশ্চিম পাকিস্তানিদের অধীন আর পশ্চিমবাংলা দিল্লির শাসকগোষ্ঠীর অধীন। অর্থাৎ বাংলা ও বাঙালিরা অবাঙালিদের করতলগত হয়ে যায়। ’৪৭-এর তথাকথিত দেশ বিভক্তির স্বাধীনতায়। এক সময়কার ভারতীয় জাতিদের মধ্যে অগ্রসর বাঙালিরা অবাঙালি শাসনের বৃত্তে মাথা তুলে দাঁড়াবার এবং নিজেদের যোগ্যতার ভিত্তিতেও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদায় তাদের স্থান হয়নি। ব্রাত্যরূপেই দুই দেশে বাঙালিদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে যায়। কংগ্রেসের শাসনামলে কংগ্রেসের প্রবীণ বাঙালি নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি পদ পেলেও এরপূর্বে তাঁকে আক্ষেপে-শ্লেষে বলতে হয়েছিল, ‘সকল যোগ্যতার পরও দলে এবং সরকারের শীর্ষ পদে আমি যেতে পারিনি, কেবল বাঙালি বলেই। হিন্দিভাষীদের ন্যায় আমার হিন্দি উচ্চারণও নির্ভুল নয়, সেটাও অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।’
আমরা এক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অবাঙালি শাসকদের পরাজিত করে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গদেশের পূর্ব বাংলা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। অপর অংশ পশ্চিম বাংলা ভারত রাষ্ট্রের প্রদেশ মাত্র। প্রদেশের রাজধানী কলকাতা। অথচ প্রদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব বাঙালিদের অধীনে নেই। ১৯৪৭-এর পর হতে ক্রমেই অবাঙালিদের দখলে চলে যায়। কলকাতার জনসংখ্যায়ও বাঙালিরা সংখ্যালঘুতে দাঁড়িয়েছে। অবাঙালি বিভিন্ন জাতিসমূহ কলকাতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। রাজ্যে বাঙালি শাসন জারি থাকলেও সারা ভারত রাষ্ট্র এককেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন। রাজ্য সরকারের ক্ষমতা খুবই সংকীর্ণ এবং সাংবিধানিক ভাবেই সমস্ত রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা খর্ব করে কেন্দ্রের অধীন করা হয়েছে। দুই বাংলার পরিণতি ছিল অভিন্ন। কিন্তু আমরা অতিক্রম করে নিজেদের পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এর জন্য আমাদের চড়া মাসুলও দিতে হয়েছে। ২৩ বছরব্যাপী সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ এবং অগণিত নারী তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানিদের নয় মাস ব্যাপী গণহত্যাকালীন সময়ে। আমরা রুখে দাঁড়িয়ে নয় মাসের ওই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাভূত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম।
বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিসত্তার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হবো যদি আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুফলের অংশীদার সকল মানুষদের করতে পারি। সেজন্য সর্বাগ্রে জরুরি হচ্ছে সকল মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। সেটাই হোক আমাদের প্রত্যাশিত লক্ষ্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক; নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

পূর্ববর্তী নিবন্ধতৈরি পোশাক শিল্প ও চট্টগ্রাম
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে করোনায় নতুন আক্রান্ত ৩২ জন, মৃত্যু ১