তৈরি পোশাক শিল্প ও চট্টগ্রাম

রেজাউল করিম | রবিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগের যোগানদাতা তৈরি পোশাক শিল্প। যে শিল্পের যাত্রা শুরু এই চট্টগ্রাম থেকেই। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা নুরুল কাদের ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে নয় একর জায়গায় গড়ে তোলেন দেশ গার্মেন্টস। ভদ্রলোক কারখানা শুরুর আগে ১৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দক্ষিণ কোরিয়ায় ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
যেখানে তৈরি পোশাক শিল্পের গোড়াপত্তন, সেখানে ওভাবে পোশাক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেনি। বন্দর, কাস্টমস সুবিধা, পণ্য পরিবহন ব্যয় কম হওয়া সত্ত্বেও ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে চট্টগ্রামে পোশাক শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার ক্ষেত্রে। এর অন্যতম কারণ, এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যেসব মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন তার সবকিছুই রাজধানীকেন্দ্রিক। লালফিতার দৌরাত্ম – সেটা তো আছেই। চট্টগ্রামে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প পিছিয়ে পড়লেও পণ্য রপ্তানি ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির পুরোটাই চট্টগ্রাম বন্দরনির্ভর। বন্দর সুবিধার পরও সেটিকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না। তৈরি পোশাক মালিকেরা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রামে পোশাকশিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হলে তাতে এ খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। কারণ তাতে পণ্য পরিবহনের খরচ যেমন কমবে, তেমনি সময়েরও সাশ্রয় হবে।
বদলে যাচ্ছে দিন। জন্মভূমে তৈরি পোশাক বিস্তৃতি লাভ না করলেও দেশজুড়ে হয়েছে। বিপুল বিস্তৃত হলেও চট্টগ্রামে সেই হারে হয়নি। বরং যতই দিন যাচ্ছে, এ খাতে চট্টগ্রাম পিছিয়ে যাচ্ছে। তথ্য-উপাত্তে দেখা যায় , ‘৯০-এর দশকেও দেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ৪০ শতাংশেরও বেশি হিস্যা ছিল চট্টগ্রামের। এখন সেটি কমে ১২ থেকে ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে। দীর্ঘ চার দশকেও চট্টগ্রামে হয়নি সম্প্রসারণ সেই দেশ গার্মেন্টসের। বিজিএমইএর সূত্রমতে, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালে চট্টগ্রামে প্রায় ৪০০ নতুন তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছিল। সেই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৪০টি করে নতুন কারখানা স্থাপিত হয়েছে চট্টগ্রামে। এর বিপরীতে পরবর্তী দশ বছরে গড়ে উঠেছে ১৭৪টি কারখানা। উদ্ধৃত দুই দশকের মধ্যে ব্যবধান অর্ধ্বেকের চেয়ে বেশি, অর্থাৎ ক্রমহ্রাসমান।
যদ্দূর জানা যায়, চট্টগ্রামে নিবন্ধিত মোট রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ৭৬৯টি। এর মধ্যে সচল আছে ৪৬৮টি আর বন্ধ বা অস্তিত্বহীন কারখানার সংখ্যা ৩০১টি। আবার যে ৪৬৮টি গার্মেন্টস কারখানা সচল রয়েছে তার মধ্যে ফি বছর গড়ে রপ্তানি করে তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান। ২০১৩ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য চট্টগ্রামের বিজিএমইএ থেকে ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) নিয়েছিল ৩৪৩টি কারখানা। ৬ কোটি ৮ লাখ ২২ হাজার ডজন তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশের বিপরীতে এ ইউডি নেওয়া হয়। ২০১৪ সালে এসে রপ্তানির জন্য ইউডি নিয়েছে ২৯৭টি প্রতিষ্ঠান আর ২০১৫ সালে ইউডি নিয়েছে ২৬৫টি কারখানা। অর্থাৎ প্রতিবছরই রপ্তানিকারক প্রিিতষ্ঠানের সংখ্যা পড়তির দিকে।
এদিকে বৈশ্বিক মহামহারী করোনাভাইরাসের ঢেউ সব সেক্টরে আঘাত হেনেছে। চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোতেও লেগেছে। টালমাটাল অবস্থার মধ্যে এক দশক পর পোশাক রপ্তানিতে প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় অবস্থান হারাল বাংলাদেশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা- ডব্লিউটিও প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিক্যাল রিভিউ ২০২১’ এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সমপ্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে ২০২০ সাল শেষে বাংলাদেশের অবস্থান তিন নম্বরে। বরাবরের মত শীর্ষে রয়েছে চীন। বেশ কয়েক বছর থেকে বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে একেবারে কাছাকাছি রয়েছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। প্রতিযোগীর চেয়ে পিছিয়ে পড়ার বিষয়ে অবশ্য দুশ্চিন্তার কিছু দেখছে না তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। ভিয়েতনামে মহামারীর ধাক্কার কারণে উৎপাদন ও রপ্তানি খুব বেশি একটা বাধাগ্রস্ত হয়নি। দ্বিতীয়ত, তারা নন কটন (মেনমেইড ফাইবার) আইটেমের পণ্য তৈরি করে আগে থেকেই শক্ত অবস্থানের দিকে আসছিল। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে ওই বাজারে তারা সব সময় অগ্রাধিকার পাচ্ছে -এটা বিজিএমইএর অভিমত। ২০২০ সালে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের পোশাকপণ্য রপ্তানি করে শক্তিশালীভাবে প্রথম অবস্থান ধরে রেখেছে চীন। বিশ্ববাজারে তাদের অংশীদারিত্ব ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসা ভিয়েতনামের রপ্তানির পরিমাণ ২৯ বিলিয়ন ডলার, বিশ্ববাজারে অংশীদারিত্ব ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর গত বছর বাংলাদেশ ২৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে, যা মোট বিশ্ব রপ্তানিতে অংশ ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ মনে করেন, বিকেন্দ্রীকরণ করা না হলে এ খাতে শুধু নয়, প্রায় খাতে চট্টগ্রামের অবদান হবে ক্রমেই নিম্নমুখী হতে বাধ্য। চট্টগ্রামের এক পোশাক শিল্পের মালিক জানান, শুধু বিকেন্দ্রীকরণ করলে এই খাতে প্রতিষ্ঠান বাড়বে না। বাড়াতে হবে ভৌত অবকাঠামোগত সুধিধা। চট্টগ্রামের এখন যে হাল সড়কের একপাশ চার বছরেও সংস্কার হয় না, প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন হয় ঘন ঘন, ছয় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে লাগে ঘন্টা দুয়েক, সেখানে বিনিয়োগকারী আসবেন! ঢাকায় শিল্প-কারখানা বা ব্যবসার ক্ষেত্রে সমস্যা হলে তা যত দ্রুত সমাধান হয়, চট্টগ্রামের বেলায় তা হয় অনেক পরে। নীতিনির্ধারকরাও চট্টগ্রামের প্রতি সুদৃষ্টি দেন না।
এতসব হতাশা আর নিম্নগামীতার মাঝে আশা দেখাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শিল্পজোন, অর্থাৎ মীরসরাইয়ে গড়ে উঠা বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর। এ শিল্পনগরের ৫০০ একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে বিজিএমইএ গার্মেন্টস পল্লী। এ পল্লীতে বিনিয়োগ হবে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কর্মসংস্থান হবে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের। ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে গার্মেন্টস পল্লীর ভূমি উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ। সংযোগ সড়ক ও গ্যাস নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার কাজও শেষের পথে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর প্রতিষ্ঠা করছে। বেজাকে ইতোমধ্যে ১০০ কোটি টাকা দিয়েছে বিজিএমইএ। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য পরিকল্পিত পল্লী প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। জানা যায়, এখানে প্রায় ৮০ টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো শিগগিরই স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে। আর এটি হবে দেশের দেশের বৃহত্তম গার্মেন্টস শিল্প জোন। গার্মেন্টস শিল্পে এটি একটি বড় সংযোজন। নেতিয়ে পড়া চট্টগ্রামের তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান এখানে দেখবে আলো। যেখান থেকে শুরু, সেখানে আবার শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে, হবে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান। চট্টগ্রাম বদলে দেবে বাংলাদেশকে।
লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধআঁরার বেলা বিস্কুট আঁরার ঐতিহ্য
পরবর্তী নিবন্ধবাংলা-বাঙালি এবং বাংলাদেশ