আঁরার বেলা বিস্কুট আঁরার ঐতিহ্য

রশীদ এনাম | রবিবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

‘বেলা বিস্কুট টুগুর গড়ি হঁর দিলি বুডুর গড়ি গুড়ি পড়ে। দুধ চার হাপত ভিজাই হাইলে বলে রসের গোল্লার মত লাগে, কেউ হদ্দে বেলা বিস্কুট আগের ঢইল্ল্যা নাই, হাইতো গেলি বলে দাঁত ভাঙ্গি ফেলার’। বেলা নিয়ে খনার বচন আছে ‘বেলার বর ঠেলার গাড়ি এক ঠেলাতে দোহাজারি’!
বাংলাদেশে চট্টগ্রাম জেলার মানুষদের নাম ভোজন রসিকতার খাতারে এক নাম্বারে। শুধু ভোজনে নয় অতিথি আপ্যায়নে সেরাদের সেরা চাটগাঁইয়ারা। মেজবান, শুটকি, বেলা বিস্কুট শব্ধগুলো আমাদের। বেলা কিংবা পরাটা, তন্দুরি রুটি চায়ের কাপে চুবিয়ে খেতে দেখলে বুঝে নিতে হবে চট্টগ্রামের মানুষ। ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বই এ লেখক আহমদ ছফাকে জাতীয় অধ্যাপক আব্দু রাজ্জাক স্যার বলেছিলেন, কোন নতুন জায়গায় গেলে আগে বাজারে যেতে যাতে বুঝতে পারে যে ঐ অঞ্চলের লোকজন কি খায়। আর বলছে লাইব্রেরীতে যেত যাতে বুঝতে পারে ঐ এলাকার লোকজন কি বই পড়ে। চাটগাঁশহরে কেউ ভ্রমণ করতে আসলে বুঝতে পারে যে মেজবান, শুটকি, বেলা বিস্কুট আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিরও অংশ।
কাক ডাকা ভোরে বেলা বিস্কুট না হলে কি চায়ের কাপে ঝড় উঠে? বেলা বিস্কুট কিছুটা শক্ত হওয়ার কারণে কুটুর মুটুর করে কামড় দিয়ে চায়ের কাপে ডুবিয়ে বা চুবিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা! বেলা বিস্কুট দিয়ে সবচেয়ে বেশি আপ্যায়ন হয় বিয়ে-শাদী, মেজবান, আকিকা ইত্যাদি অনুষ্ঠান করার আগের রাতে যে পানসল্লা বা পান বৈঠকে। চায়ের সাথে বেলা বিস্কুট পরিবেশন করা হয়। অন্যন্যা জেলার লোকজন চাটগাঁ শহরে বেড়াতে আসলে বিস্কুট দিয়ে যে চায়ের ভিতর চুবিয়ে চুবিয়ে খাই তাঁরা এটা দেখে বেশ কৌতুহলী হয়। চাটগাঁ শহর থেকে যাওয়ার সময় বেলা বিস্কুট ক্রয় করে নিয়ে যায়। আবার অনেকে প্রবাসে বেলা বিস্কুট নিয়ে যায় চা দিয়ে খাওয়ার জন্য।
আমার বাবা ছিলেন কৃষিবিদ তিনি চাকুরী সুবাদে কক্সবাজার থাকতেন। মাসের প্রথম দিকে বেতন পাওয়ার পর কক্সবাজার থেকে বাড়ি ফিরতেন। গাড়ি থেকে নেমে কলা পাউরুটির সাথে পটিয়া মুন্সেফ বাজারের খাজা বেকারি থেকে একশত বেলা বিস্কুট সাথে করে আনতেন। বিস্কুটের প্যাকেটে ঘি বা তৈল ভেসে উঠত। বেলা বিস্কুটের সুগন্ধ নাকে লাগত। বাড়ির আশে পাশের সবাই আসত বাসায় আম্মা চা দিয়ে সবাইকে বেলা বিস্কুট খেতে দিতেন। মাকে দেখতাম বেলা বিস্কুট ভেঙ্গে চায়ের মগে ভিজাতে দিতেন চা চামচ দিয়ে বিস্কুটগুলো মুখে দিতাম মনে হতো এ যেন ছানাইমুখী রসভরি আহা কী স্বাধ ! এখন বেলা আগের মতো নেই। সাইজেও ছোট হয়ে গেছে স্বাদ কেমন জানি কমে গেছে। তবে বেলা এখন আধুনিক গুণগত ও মানসম্মত করে বড় সাইজের করেছে অনেকে। বেলা অনেকটা ফোয়ান বিস্কুটের মতো হয়ে গেছে।
বেলা বিস্কুটের উৎপত্তি ইতিহাস জানতে গিয়ে জানায় যায়। উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট বেলা । আকারে কিছুটা গোলাকৃতির। প্রায় ২৫০ শত বছরের পুরানো বেলা বিস্কুটের ইতিহাস। ১৪০০ বছরের পুরানো আরাকানী শহর চট্টগ্রামে এক সময় পর্তুগীজরা বসবাস করত। চট্টগ্রামের লেখক আবুল ফজল রচিত রেখাচিত্র(১৯৬৬) গ্রন্থ থেকে জানা যায় চন্দনপুরার বেলায়েত আলী নামক এক বিস্কুট বিক্রেতার নামানুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। আবুল ফজলের আত্নজীবনী রেখাচিত্রে শৈশব কৈশোরকালে একটি কবিতার চরণ ছিল “ ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাতের বদলে খাচ্ছি গরম গরম বেলা কি কুকিজ নামের বিস্কুট দিয়ে। কুকিজ ইংরেজি নাম বেলা কিন্তু খাস চাটগাঁইয়্যা ”
বাংলা একাডেমির সহকারি পরিচালক লেখক ও গবেষক প্রয়াত আহমেদ মমতাজ বলেন, “মোগল পর্তুগীজদের খাবারের তালিকায় থাকত, আটা রুটি, পাউ রুটি, বেকারি পণ্যসহ বেলা বিস্কুট, ২৫০ বছর পূর্বে বেকারি শিল্পের যাত্রা শুরু হয় চাটগাঁ শহরে। আগেকার দিনে রুটি তৈরী করত বেকারিতে। কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে তৈরী হয় পাউরুটি, কেক, বেলা বিস্কুট। মোগল, পর্তুগিজ বা ইংরেজদের মতো বেকারি পণ্যেও অভ্যস্ত হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষ। বেকারি পণ্য তৈরির সময় তখনকার বেকারি ব্যবসায়ীরা বেলা বিস্কুট নামে বিশেষায়িত বিস্কুট তৈরি করেন। এ হিসেবে বেলা বিস্কুটের ইতিহাস ২০০ বছরের কম হবে না”।
বেলা বিস্কুট নিয়ে দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী প্রফেসর সবিহ্‌ উল আলম বলেন, “ছোট বেলায় যখন কাজেম আলী ইশকুলের ছাত্র ছিলাম, তখন দেখতাম বাসায় প্রায়ঃ সময় আব্বার কাছে মেহমান আসত। বাবা গণিবেকারি থেকে বেলা বিস্কুট কিনে আনতেন। আমার মা লেবুর চিনিপানা বা শরবত দিয়ে বেলা বিস্কুট কোন কোন সময় দুধ চা দিয়ে বেলা বিস্কুট পরিবেশন করতেন। ইশকুলের টিফিন ছুটিতে গণিবেকারিতে গিয়ে বেলাবিস্কুট কিনে খাওয়ার স্মৃতিটা আজও মনে পড়ে। বেলা বিস্কুটের ইতিহাস মানে গণিবেকারির নাম নিতে হবে। ছোট বেলা থেকে জেনেছি বেলায়েত আলী নামে বিস্কুট বিক্রেতা ছিলেন তাঁর নাম অনুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়”।
ইতিহাসের খসড়ার সম্পাদক লেখক গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, “বেলা বিস্কুট আমাদের ঐতিহ্য বহন করে। অনেকের ধারনা ১৫০ থেকে ২০০ বছর আগে আমরা কেউ বেলায়েত কে দেখিনি, বেলায়েত-র নামা যারা বলে তাঁরারও দেখেনি। অনেকে মনে করেন বেলিয়ে তৈরী করা হয় বলে বেলা বিস্কুট নামকরণ করা হয়। তবে আমার কাছে বেলায়ত নামে বেলা বিস্কুটের নামকরণটাই গ্রহণযোগ্য মনে হয়”।
যে সকল বেকারিতে বেলা বিস্কুট তৈরি হতো দেখা যায় বেকারির ভিতরে একটি বিশাল চুল্লি থাকে টিন এবং মাাটি ও ইটের তৈরি যাকে বলা হয় বিস্কুটের তন্দুর। তন্দুর অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। তন্দুরের বদলে আধুনিক বেকারিতে স্থাপন হয়েছে বৈদ্যুতিক ডিজিটাল ওভেন।
আবার অনেকে তাঁদের আদি ঐতিহ্য এবং বেলা বিস্কুটের গুণগত মান ধরে রাখার জন্য আজও তন্দুরীতে বিস্কুট তৈরী করে। তাঁর মধ্যে অন্যতম গণি বেকারি। গণি বেকারির নাম শুনলে যেন বেলা বিস্কুটের সুগন্ধ নাকে লাগে !
চট্টগ্রামে বৃটিশ বেনিয়া, মোগল, আরব দেশের সুফি সাধকরা নানা সময়ে এসেছিল তাঁদের খাদ্য অভ্যাস কৃষ্টি কালচার যেন আজও চলমান। সে সময়ে থেকে চট্টগ্রামে ঝুপড়ি টং দোকান কিংবা চায়ের দোকানে ধোঁয়া উড়িত চায়ের কাপে ঝড় তোলার জন্য বেলা বিস্কুটের বিকল্প ছিল না। অনেকে প্রাতঃরাশ সারতেন চা বেলা দিয়ে। বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তা চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে অন্যান্য জেলার মানুষের কাছেও প্রিয় হয়ে উঠেছে। বেলা বিস্কুট আমেরিকা, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়াসহ যেখানে চাটগাঁবাসীরা বসবাস করে সে সব দেশে রপ্তানি হচ্ছে ।
মোগল আমল থেকে বেলা বিস্কুট তৈরি করে আসছে গণি বেকারি। ভারতের বর্ধমান থেকে দেশে আসা ব্যক্তিরা বেলা বিস্কুট তৈরীর এবং বেকারি শিল্প শুরু করেন। আবদুল গণি সওদাগরের পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও তাঁর ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে বেকারির কেক বিস্কুট বন ইত্যাদি তৈরী হয়। গণি বেকারি আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে লাল খাঁ সুবেদার বংশধররা। ১৮৭৮ সাল থেকে গণিবেকারির যাত্রা শুরু। ১৯৭৩ সালে আবদুল গণি সওদাগর মারা যাওয়ার পর তাঁর পরবর্তী প্রজন্মরা গণি বেকারির তৈরি বেলাবিস্কুটের গুণগতমান ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। আজও মাটির তন্দুরে বেলা বিস্কুট তৈরি করে আসছে।
বেলা বিস্কুট তৈরির শিল্পী বা কারিগররা বলেন, বিস্কুট তৈরীতে অন্তত দুই দিন সময় লাগে। ময়দা, চিনি, লবণ, ভোজ্যতেল, ঘি, গুঁড়া দুধ, ডালডা, পানিতে মিশিয়ে খামি তৈরি করা হয়। খামিতে ইস্টের পরিবর্তে মাওয়া দেওয়া হয়। খামি তৈরি হলে বেলিয়ে বিস্কুট তৈরি করে দেড় ঘণ্টা তন্দুরিতে সেঁকা হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় সেঁকিয়ে বিস্কুট তৈরি করা হয়। তন্দুরিতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ কয়লা, গ্যাস বৈদ্যুতিক ওভেন ইত্যাদি মাধ্যেমে বিস্কুট তৈরি হয়ে থাকে। সে সময়ে গণি বেকারি থেকে বৃটিশিদের জন্য বেকারি খাদ্য দ্রব্য তৈরী হতো। পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালের দিকে চট্টগ্রাম নগরীতে বেকারি শিল্পে বিপ্লব ঘটে। ক্রেতা বিক্রেতাও দিন দিন বেড়ে যায় এবং বিভিন্ন বেকারি শিল্প গড়ে উঠে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোম্পানীগুলোও বেলা বিস্কুট তৈরি করে আসছে। তবে চট্টগ্রামের গণি বেকারির হাত ধরে বেলা বিস্কুটের প্রচলন শুরু।
তথ্যসূত্র : লেখক ও গবেষক আহমেদ মমতাজ, প্রফেসর সবিহ্‌ উল আলম, গবেষক মোহাম্মদ শামসুল হক ও সাংবাদিক মাসুদ মিলাদ।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্কুলগুলোকে আদর্শ বিদ্যানিকেতনে পরিণত করার এখনই সময়
পরবর্তী নিবন্ধতৈরি পোশাক শিল্প ও চট্টগ্রাম